০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ৭ শাবান ১৪৪৬
`

গণপিটুনির প্রবণতা বন্ধ করতে হবে

-

একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় যখন বিরাজ করে, তখন সেখানে হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ গণপিটুনির বিভীষিকা মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তোলে। ওইসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা রাষ্ট্রে তখনই বিরাজ করে যখন শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতির লড়াই চলে। বিশ^ব্যাপী ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতার মগডালে থাকাকালীন অন্যের সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতাটুকু রাখে না। যারাই ক্ষমতাসীনদের গঠনমূলক সমালোচনা করেছে, তাদেরই ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার প্রয়োগ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের এই নিপীড়ন দেখে সাধারণ মানুষ যখন প্রতিবাদের ভাষা ভুলে যায় তখনই সেখানে হাজারো অপরাধ আবির্ভূত হয়। ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক গুম-খুন, অপহরণ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে গুজব আতঙ্ক সমাজে বিরাজ করছে। অন্য দিকে, ছেলেধরা সন্দেহে রাস্তায় উত্তেজিত জনতার হাতে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। গত ১৮ জুলাই নেত্রকোনায় এক যুবকের ব্যাগ থেকে এক শিশুর কাটা মাথা উদ্ধারের ঘটনা মূলত এসব গুজবে ঘি ঢালে। তবে নেত্রকোনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই গুজবের সাথে এ ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবেÑ এটা শয়তানও বিশ্বাস করে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেই চলছে। ছেলেধরা সন্দেহে ৩৬ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। এদের অধিকাংশই মানসিক ভারসাম্যহীন কিংবা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী। যারা অন্যদের কাছে নিজের বিষয় ব্যাখ্যা করতে পারে না। তবে রাজধানীর বাড্ডা ও নারায়ণগঞ্জের মর্মান্তিক দুটো ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে। বাড্ডায় তাসলিমা বেগম শিশুসন্তানকে স্কুলে ভর্তি করার বিষয়ে খোঁজখবর করতে গিয়েছিলেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাকে নিজের কক্ষে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিলেন। কিন্তু তার অসংলগ্ন কথাবার্তায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি ছেলেধরা। এরপর এলাকার একশ্রেণীর উৎসাহী লোকজন স্কুলঘরে ঢুকে তাকে গণপিটুনি দেয়। কিন্তু কেউ একবারও বিবেচনা করল না, তিনি আদৌ ছেলেধরা ছিলেন কিনা? শুধু কি তাই! খুনের সময় ও খুনের পরে অসংখ্য ক্যামেরা ছিল। অথচ সবাই গণপিটুনিতে নির্জীব মানুষটির ছবি তুলছিলেন। কিন্তু কেউ তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেননি। একই নিষ্ঠুরতা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি আল আমিন নগরের অতি উৎসাহী জনতা দেখিয়েছে। তারা ছেলেধরা সন্দেহে একজন বাকপ্রতিবন্ধী বাবাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। একজন বাকপ্রতিবন্ধী বাবা চুড়ি আর লিপস্টিক নিয়ে রাস্তায় মেয়ের অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক মানুষ সেই বাবাকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে। তবে সিদ্ধিরগঞ্জের ওসি শাহীন পারভেজ জানান, সিরাজ বোবা ও বধির ছিলেন। তিনি ছেলেধরা নন।
একের পর এক ঘটে চলেছে নৃশংস, বর্বরতার অমানবিক বীভৎস ঘটনা। উন্মোচিত হচ্ছে দেশ ও সমাজের বিকৃত চেহারার রূপ। দেশের আনাচে-কানাচে চুরি, ছিনতাই বা নিতান্ত কোনো অপরাধে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করার বিকৃত উল্লাস চলেছে। অথচ অধিকাংশ মানুষই নির্বিকার। মানুষ নিজের হাতে কেন আইন তুলে নিচ্ছে এ বিষয়ে কেসস্টাডি হওয়া দরকার। যেখানে আইনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা সেখানে আইনের প্রতি জনগণের চরম অনীহা কেন সৃষ্টি হয়েছে? বিচারহীনতা ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার জন্য কী নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? তবে যারা ক্রসফায়ারে আনন্দিত হন তারাই এখন গণপিটুনিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন। এ কথা তো একেবারে ফেলনা নয় যে, আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থার সঙ্কটের কারণে গণপিটুনির মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা বেড়েই চলছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের নিরাপত্তা, মানবিকতার অধঃপতনের ভয়াবহতার চিত্র সত্যিই স্তম্ভিত করে তোলে মানুষের বিবেক। এ ধরনের ঘটনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচার না হওয়া ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা বিচারের বাইরে অধরাই রয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়া ও ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতা না থাকা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি কারণে মানুুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। কোনো সুস্থ রাষ্ট্রের লক্ষণ এসব নয়! বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, রাষ্ট্র সব বৈধ ক্ষমতার মালিক। তার মতে, জনসাধারণের নিরাপত্তা ও সমাজের মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্র সে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, তবে শর্ত থাকে যে, ক্ষমতার প্রয়োগ করতে হবে নির্মোহভাবে এবং সমতার ভিত্তিতে। অন্যথায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগ নিয়েই সমাজে বিভাজন তৈরি হবে, যার লক্ষণ আমরা কয়েক বছর থেকে দেখছি।
বানের পানির মতো গুজব আসে এবং ছড়ায়। কিছু দিন পর আবার সেটি কালের স্রোতে হারিয়ে যায়। কিন্তু যে মানুষগুলো এই গুজবের শিকার হয়ে না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে এই সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের রেখে যাওয়া স্বজনের চোখের অশ্রু কি থামাতে পারবে? গণপিটুনি দিয়ে মানুষকে হত্যা করা বাংলাদেশে নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে একশ্রেণীর অতি উৎসাহী কিছু মানুষ ছিনতাইকারী, চোর বা ডাকাত ধরে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে। অথচ এটা ফৌজদারি অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। পৃথিবীর কোনো সভ্য জগতে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ না থাকলেও আমাদের দেশে উল্টো চিত্র প্রায়ই দেখা যায়। একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা ঘটলেও সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যদি নিতে পারত তাহলে একের পর এক ঘটনাগুলো এভাবে ঘটতে পারত না। পাঠকদের নিশ্চয় ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ও বিশ্বজিৎ হত্যার কথা মনে থাকার কথা। রিফাত হত্যার রেশ তো এখনো কাটেনি। মিন্নি গ্রেফতারের খবর এখনো পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। নিকট অতীতের গণপিটুনির পরিসংখ্যান মোটেও সুখকর ছিল না। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঢাকার সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশি গ্রামে শবেবরাতের রাতে ডাকাত সন্দেহে ৬ ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। কয়েক দিন লেখালেখি হয়। ওই পর্যন্তই শেষ। কারও শাস্তি হয়েছে সে সংবাদ দেখিনি। মিরপুরের কালশীতে একটি ঘরে জীবিত ১০ জন মানুষকে তালাবদ্ধ করে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমরা একটু টুঁ শব্দ পর্যন্ত করতে পারিনি। কারণ তারা মানুষ নয় বিহারি। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০১৮ সালে সারা দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬ মাসে ৩৬ জন নিহত হয়েছে এবং গত চার দিনে ৭ জন মিলিয়ে ৪৩ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, গণপিটুনিতে ২০১০ সালে ১২৭ জন, ২০১১ সালে ১৩৪ জন, ২০১২ সালে ১২৬ জন, ২০১৩ সালে ১২৭ জন, ২০১৪ সালে ১০৫ জন, ২০১৫ সালে ৬৯ জন নিহত হয়। গণপিটুনির শিকার ব্যক্তিদের পরিচয় পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারী, মানসিক রোগী, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধাসহ নিরীহ মানুষ গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থাকে তখন মানুষের মনে এমনিতে ফাগুনের বসন্ত হাওয়া শান্তির দোলা দেয়, তখন অপরাধের মাত্রা কম থাকে। আবার উল্টো দিকে রাষ্ট্রের শাসক যখন জনগণের মনের দ্রোহটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন তখন সমাজ ও রাষ্ট্রে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বাকস্বাধীনতার পথ যখন রুদ্ধ হয়ে পড়ে তখন প্রতিবাদী মানুষ বিড়ালের মতো মিউমিউ করা ছাড়া সিংহের মতো গর্জে উঠতে পারে না। তখন অপরাধীরা হয়ে ওঠে হিংস্র জানোয়ারের মতো। শুধু আইন করে গণপিটুনি বন্ধ করা যাবে না। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিতে আনতে হবে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্রমাগতভাবে বিভিন্ন পত্রিকায় এবং টেলিভিশনে গণপিটুনির বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপন প্রচার করে বলবে যে, তদন্ত করে দেখা গেছে গণপিটুনিতে নিহত শতকরা নিরানব্বই জনই নির্দোষ। সুতরাং আপনারা গণপিটুনিতে অংশ নেবেন না। অন্যদের প্রতিহত করবেন এবং তথাকথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশে দেবেন। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির উন্নয়নের চেয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সামাজিক রাজনৈতিক শান্তিশৃঙ্খলা সবার আগে নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। আসুন আমরা সবাই অসহায় নারী, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধদের জীবন রক্ষার্থে গণপিটুনির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করি। হ
লেখক : প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement