ভেজাল রোধে সামাজিক আন্দোলন
- হারুন-অর-রশিদ
- ২৩ জুলাই ২০১৯, ০০:০০
আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী, নাগরিকদের নিরাপদ খাদ্য, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা এবং সুস্থ পরিবেশের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের অন্যতম। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, বিশ্রাম-বিনোদনের ব্যবস্থাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করার নিশ্চয়তা দেয়া আছে সংবিধানে।
জনগণের পুষ্টিবিধান ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করা, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকের পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করার কথা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও জনগণের মৌলিক চাহিদা বিশেষ করে নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য, নিরাপদ ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা, সুস্থ পরিবেশ এখনো দেশে নিশ্চিত হয়নি। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম খাদ্য। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিরাপদ এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অথচ রাষ্ট্র এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ী, উৎপাদনকারী, মজুতদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা রসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে খাদ্যকে বিষময় করে তুলছে। দেশের মানুষ বাধ্য হয়ে এসব বিষাক্ত খাবার খাচ্ছেন। ফলে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, শুধু ভেজাল খাবার খেয়ে দেশে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ। কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, দেশের ১৬ শতাংশ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাবার খেয়ে কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি মাসে ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার রোগী দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। দীর্ঘ দিন বিষাক্ত খাবার খেলে গর্ভবতী মা ও পেটের ভ্রƒণের ক্ষতি হয়, সন্তানও ক্যান্সার, কিডনিসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।
২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে যেখানে গত শতকের আশির দশকে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ, সেখানে ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ৮০-৯০ লাখ । ওই পরিসংখ্যানে আরো দেখানো হয়, ২০-২২ শতাংশ লোক হৃদরোগে আক্রান্ত। এ ছাড়া ১০-১২ লাখ লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। নিয়ন্ত্রহীনভাবে ভোগ্যপণ্যে ভেজাল মিশ্রিত করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
তেল, নুন, হলুদ, মরিচ, লবণ, চিনি, আটা-ময়দা অর্থাৎ, কোনো কিছু বাদ নেই, যাতে ভেজাল মেশানো হয় না। মাছ, গোশত, তরিতরকারি, ফলমূলে মাত্রাহীন ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। এ অপকর্ম করছে মানুষ নামের অমানুষেরা। তারা ব্যক্তি স্বার্থে গ্রাহকদের বিষ খাওয়াচ্ছে। নামকরা বড় কোম্পানিও ভেজালের সাথে জড়িত। ভেজাল ও নিম্নমানের ৫২টি পণ্য বাজার থেকে তুলে নিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দেন। এখানে অনেক বড় কোম্পানির পণ্যও আছে, যা মানুষ সরল বিশ্বাসে কিনে থাকেন। শুধু খাদ্য নয়, বাজারের বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্যে ভেজাল অতিমাত্রায়।
যারা ভেজালের সাথে জড়িত তারা সমাজ ও দেশের জানি দুশমন। তাদের কারণেই কোটি কোটি মানুষ তথা গোটা সমাজ আজ ভেজালের রাহুগ্রাসে পরিবেষ্টিত। কাজেই তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ব্যাপারে কঠোর আইন আছে যেমনÑ খাদ্যে ভেজাল মেশানোর দায়ে ভারতে যাবজ্জীবন, পাকিস্তানে ২৫ বছর কারাদণ্ড, যুক্তরাষ্ট্রে সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে ভেজাল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর আইনের অভাব রয়েছে।
বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ (সংশোধিত ২০০৫) এ সর্বোচ্চ এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। অন্য দিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এ সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এ জরিমানা ও শাস্তির বিধান বাড়িয়ে পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান করা হলেও এখানে সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়নি। এ সব আইন ভেজাল নিয়ন্ত্রণে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে আমরা মনে করি। তাই ভেজালের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে অবশ্যই কঠোর শাস্তি দেয়া উচিত।
আমরা যদি এখনই ভেজালের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারি গোটা সমাজ ভয়ঙ্কর সঙ্কটে নিপতিত হবে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সমাজের সবাইকে ভেজালবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ভেজালের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বয়কট করতে হবে। কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষকে ভেজাল খাদ্য ক্রয় ও খাওয়া থেকে বিরত থাকতে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যে সব রাসায়নিক দ্রব্য মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর তা আমদানি, সংরক্ষণ, মজুদকরণ, বিতরণ, ব্যবহার ও উন্মুক্ত বিক্রির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
সমাজকে ভেজালমুক্ত করতে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে নৈতিক এবং মানবিক শিক্ষার বড় প্রয়োজন। নৈতিক এবং মানবিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের বিবেক জাগ্রত করতে হবে। বিবেক জাগ্রত না হলে ভালো কিছু আশা করা যায় না। কিছু ব্যক্তির স্বার্থ সিদ্ধির কাছে গোটা সমাজ অসহায় হতে পারে না। অবশ্য ভেজালের মতো ভয়ঙ্কর মারণ ফাঁদ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে রাজনৈতিক অঙ্গীকারও প্রয়োজন। প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিচর্চা ব্যতীত কোনো অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। তাই আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যাওয়ার হাত থেকে সমাজকে মুক্ত করতে গণতান্ত্রিক বলয় সৃষ্টির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এটি করা গেলে কিছুটা হলেও মুক্তির সম্ভাবনা থাকবে বলে বিশ্বাস করি। হ
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা