০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ৭ শাবান ১৪৪৬
`

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য

-

সত্যিই কি যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধে জড়াতে যাচ্ছে? সে যুদ্ধের জন্য ট্রাম্প প্রশাসন এমন একটা সময়কে কেন বেছে নিচ্ছেন? সময়টা হয়তো রিপাবলিকান রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিবাচক, কিন্তু যুদ্ধ বাধানোর অজুহাতটা স্পষ্টত খোঁড়া ও সাদামাটাভাবে কৌতূহলোদ্দীপক। কারণ, অজুহাতটা এখন পর্যন্ত ‘পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধানো’র শামিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের পাঁড়-ভক্তরাও আটআনা আমলে নেয়নি। তা সত্ত্বেও ইরানের সাথে এখনই তাদের একটা ফিজিক্যাল ফ্যাসাদ দরকার, যা বজবজে ধরনের কিছু একটা হলেও চলবে। এ যুদ্ধে তাদের উৎসাহের জোগানদার বিষয়গুলো নিম্নরূপ হতে পারে :
কথিত আছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় হোয়াইট স্টাবলিসমেন্ট ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ভেতরে ভেতরে আড় নজরে দেখে থাকে। তাই তারা ব্রেক্সিটকে (ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসা) আন্তরিক সাধুবাদ জানাচ্ছে। কারণ, এ অবস্থায় ইরান যুদ্ধে যুক্তরাজ্যের সায় পাওয়া তাদের জন্য অধিকতর সহজ হয়েছে। অবশ্য, যুক্তরাজ্য এখনো উঠেপড়ে লাগার ফুরসত পায়নি। কারণ, তারা ব্রেক্সিট ইস্যুর খাড়ার পর নিজ ঘর সামলানো নিয়ে ব্যস্ত আছে।
জামাল খাশোগি (আরব নিউজ ও ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক) হত্যা কেলেঙ্কারিতে সৌদি সরকার ও তাদের ক্রাউনপ্রিন্স সালমানের এখন লেজেগোবরে দশা। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র সৌদি সরকারের মনস্তাত্ত্বিক ফাটলে অনায়াসে ঢুকে ইরান যুদ্ধে তাদের সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। আবার আগ থেকেই তো সৌদি-ইরান সুন্নি-শিয়াসংক্রান্ত ইস্যুতে পরস্পর চির বৈরীভাবাপন্ন। কিন্তু সৌদি যে যুক্তরাষ্ট্রকে এ যুদ্ধে আমন্ত্রণ করে আনছে না সেটা বিশ্বাস করার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ রয়েছে। অনেক কারণের একটা হচ্ছেÑ ইরাক, ইয়েমেন ও সিরীয় যুদ্ধের ঝাঁজ সৌদিবাসীর অন্তর-মনে মূর্তিমান হয়ে আছে। লেবানন, ফিলিস্তিন, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও আরো কিছু ইস্যু নিয়ে ইরান ও ইসরাইলের দীর্ঘ দিনের দ্বন্দ্ব ও এই সম্ভাব্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে উৎসাহের জোগান দিয়েছে। ইতোমধ্যে ইসরাইল আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় তাদের অধিকৃত গোলান হাইটে এক স্থানে ‘ট্রাম্প সিটি’ নামে একটা ফলক স্থাপন করেছে। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প সেখানে ইসরাইলিদের বসতি স্থাপনকে উৎসাহিত করেছেন। ট্রাম্প এ ধরনের জামাই আদরেও খানিকটা উৎসাহ বোধের রসদ পেয়ে থাকতে পারেন।
সর্বোপরি, এ রকম উৎসাহের মূল জোগানদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাক উঁচু আধিপত্যবাদী মনোভাবকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ট্রাম্প তো একবার রাখঢাক না করে সরাসরি বলে ফেলেছেন, ‘এখনো আমরাই নাম্বার ওয়ান। কোনোভাবেই চীনকে ছাড় দেয়া হবে না।’
তাহলে চীনকে ঠেকানোর জন্য কি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ নাটকের আয়োজন? এটা কি চীনকে রুখে দেয়ার পরোক্ষ কোনো উপায়? সাবেক ইরাকের মতো ইরানও চায় মধ্যপ্রাচ্যের তেল বাণিজ্য নীতিতে সবার আগে এশীয়দেরই প্রাধান্য থাক যা হোয়াইট হাউজ নির্বিবাদে মানতে নারাজ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সাথে নগ্ন বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত আছে, যেখানে চীনকে তারা একমাত্র প্রবল প্রতিপক্ষ ধরে নিয়েছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার কিছু স্টেজ বক্তৃতায় মার্কিনিদের চৈনিক বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। পরবর্তীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই স্টেজ থেকে নেমে বৈশ্বিক বাণিজ্য ভারসাম্যের নামে যেখানে-সেখানে অবরোধের বোমা ফাটাচ্ছেন। ইরান-চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ সুদৃঢ; রাশিয়ার সাথেও নিতান্ত কম নয়। অন্য দিকে, ইরানের মিত্র তুরস্ক ন্যাটোর দ্বিতীয় সমরশক্তি হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করে ফেলেছে। সৌদি আরবও রাশিয়ার সাথে অস্ত্র ক্রয় চুক্তি সম্পন্ন করেছে, যা চলমান আমেরিকান প্রশাসনের কাছে স্বাভাবিকভাবে বিস্ময়কর। এ অবস্থায় আমেরিকা বল প্রয়োগ কিংবা এটা প্রয়োগের হুমকির কথা ভাবছে।
কিন্তু চাইলেই আমেরিকা বল প্রয়োগ করতে পারে না। সেটা করার আগে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে তাদের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক হওয়া জরুরি। বৈশ্বিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ এ মুহূর্তে বিংশ শতাব্দীর ফরম্যাটে নেই। এখন জানা-অজানা বেশ কিছু উদীয়মান শক্তির (সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক কিংবা উভয়) উদ্ভব ঘটেছে। আমেরিকার এসব খুব ভালোভাবে জানা আছে বলে তারা এখন পর্যন্ত হুমকির পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রয়েছে এবং পাশাপাশি ইরানের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের সঠিক উদ্দেশ্য ও কারণ হাতড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে উদ্দেশ্য হিসেবে তারা ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হওয়া থেকে বিরত রাখার ব্যাপারটা দফায় দফায় উচ্চারণ করছে। কিন্তু তাদের এই উচ্চারণ এখন পর্যন্ত ঠিকমতো হালে পানি পায়নি। কারণ, এটা নিয়ে ইরানের সাথে আমেরিকাসহ ছয় জাতির একটা চুক্তি রয়েছে, যেখান থেকে আমেরিকা খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে বেরিয়ে গেছে।
আমেরিকা একসময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির টোপ ফেলে চীনকে ডব্লিউটিওতে অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহিত করেছে। তারা ভেবেছিল, এখানে চীনকে জড়াতে পারলে চীন সমাজতন্ত্র ছেড়ে পুঁজিবাদের মূল স্রোতে ভেসে যাবে। কিন্তু কার্যত ফলাফল তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছে। এখন তারা দেখতে পাচ্ছে, চীনের অর্থনৈতিক ইনফ্লো আউটফ্লো থেকে ঢের বেশি। অর্থাৎ Chinese export is far greater than their import. আবার আমেরিকা বিশ্বায়নে নেতৃত্ব দিয়ে একই ট্রেনে পুঁজিবাদীদের নিয়ে পৃথক কম্পার্টমেন্টের ব্যবস্থা করেছে এবং সেসব কম্পার্টমেন্টের যাত্রীরাই এখন তাদের বিরোধিতা করতে শুরু করেছে। একেই বলে নিজের করাতে নিজেই কাটা পড়া। ইতোমধ্যে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন আসন্ন। সেখানে ট্রাম্প নিজেকে আবারো প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। এই নির্বাচনে জিততে তিনি হয়তো নরেন্দ্র মোদির মতো পুলওয়ামা ও বালাকোট ঘটনার অনুরূপ কিছু একটা চাইছেন। তার পুলওয়ামা-বালাকোট হয়তো ইরান বনাম মধ্যপ্রাচ্য। এরই মধ্যে ট্রাম্প ‘হোয়াইট পাওয়ার’র সেøাগান তুলে মার্কিন মুলুকে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদের বিষাক্ত বীজ বুনে দিয়েছেন। বোকা বোকা কথার আড়ালে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ক্ষমতায় আশা, ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতাধর হওয়া। একজন বিলিয়নিয়ার মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর যাই হোক, বোকা হাবড়া হতে পারেন না। তার এই বোকা বোকা খেলাটা তার নিজস্ব কোনো কৌশল হতে পারে কি? মনে হয়, হরমুজ প্রণালীর তেলের ট্যাংকার নিয়ে এমন কিছু একটা হচ্ছে, যাকে যুদ্ধ বলা যাবে না। হ


আরো সংবাদ



premium cement