যুক্তরাষ্ট্র-ইরান : যুদ্ধের আশঙ্কা কম
- জালাল উদ্দিন ওমর
- ০২ জুলাই ২০১৯, ০০:০০
ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা দীর্ঘ দিনের। সেই ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে এ বৈরিতার শুরু। পারস্যের রাজা রেজা শাহ পাহলভির আমলে ইরান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। শাহ-পরবর্তী ইরান হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রু। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের বৈরিতা এখনো বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইসরাইলের প্রধান প্রতিপক্ষ ইরান। রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত অনেক দেশ ইরানকে নিজের জন্য বৈরী শক্তি মনে করে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের প্রধান শত্রু।
ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যকার বাকযুদ্ধ এবং সামরিক উত্তেজনা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ চলমান। কখনো ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা এতটাই বেড়ে যায় যে, মনে হয় এখনই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র হামলা না করলেও, হামলার আশঙ্কা থেকেই যায়। তবে ইরানে যুক্তরাষ্ট্র হামলা করবে না বলে মনে হয়। কারণ, তেহরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিজয়ী হওয়া শক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি এবং অর্থনৈতিক অবরোধ মোকাবেলা করেই ইরান টিকে আছে। আগামীতেও দেশটিকে পথ চলতে হবে।
ইরান মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। আয়তন, জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। দেশটিতে ক্ষমতায় একটি শক্তিশালী সরকার, যারা অত্যন্ত ঐক্যবদ্ধ। বিশ্বের দুই বৃহৎ পরাশক্তি রাশিয়া এবং চীনের সাথে তেহরানের রয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক মিত্রতা। এ ছাড়া তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনের হামাসের সাথে রয়েছে রাজনৈতিক সখ্য। তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ইরানের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিত দিয়েছে। রয়েছে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সমন্বয়ে আধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পাশাপাশি ইরান প্রযুক্তি এবং সামরিক খাতেও যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। তৈরি করছে গাড়ি এবং মেশিনারিজ। নিজস্ব প্রযুক্তিতে সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি করেছে কামান, ট্যাংক, রকেট ও ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। বিমানবাহিনীর জন্য তৈরি করেছে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এবং আকাশ থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করেছে অত্যন্ত দ্রুতগতির টর্পেডো আর অত্যাধুনিক ফ্রিগেট। স্বাভাবিকভাবেই সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইরানের সফলতা অনস্বীকার্য। এদিকে বিভিন্ন ধরনের সামরিক অস্ত্র তৈরির পাশাপাশি ইরান এখন মহাকাশ প্রযুক্তিতেও হাত দিয়েছে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে পাঠিয়েছে মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ। ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে চালু করেছে হেভি ওয়াটার তৈরির ইন্ডাস্ট্রি, যা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতিরই সাক্ষ্য বহন করে। ইরান ঘোষণা করেছে, উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম এবং পরমাণু জ্বালানি রফতানি করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় একটি অবস্থান তৈরি করেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত অতীতের দীর্ঘ অবরোধ মোকাবেলা করে ইরান এসব অর্জন করেছে। এ অবস্থায় ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন চালানো কঠিন। সেই যুদ্ধে বিজয় অর্জন আরো কঠিন। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া কোথাও যুক্তরাষ্ট্র বিজয় অর্জন করতে পারেনি। অথচ এ সব দেশের চেয়ে ইরান সবদিক দিয়ে শক্তিশালী। আর শক্তির বিরুদ্ধে কেউ কখনো যুদ্ধ করতে চায় না। এসব কারণে ইরানে হামলা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দুরূহ। তবে অর্থনৈতিক অবরোধ অব্যাহত থাকবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে ফের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। ইরানের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস জ্বালানি তেলের রফতানি তলানিতে নামিয়ে এনে অর্থনীতি দুর্বল করা এবং এর মাধ্যমে তেহরানে ক্ষমতার পটপরিবর্তন প্রধান লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের। ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত এ অর্থনৈতিক অবরোধকে ইসরাইল বরাবরের মতোই সমর্থন জানিয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞার জবাবে ইরান ঘোষণা করেছে, তেহরান এ অবরোধ মানবে না।
দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও চীন বরাবরই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধের নিন্দা জানিয়েছে। দেশ দু’টি ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানও এ অর্থনৈতিক অবরোধের বিরোধিতা করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ অবরোধের বিরোধিতা করেছে। এভাবে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে বিশ্ব বরাবরের মতো বিভক্ত। এটি ইরানের অবস্থান দৃঢ় করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ নিষেধাজ্ঞার প্রধান কারণ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের মতে, ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকা বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। ইরানের বক্তব্য, তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং এটি ইরানের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের আশঙ্কা, ইরান গোপনে পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্যই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদের বৈরিতা। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধে ২০১০ সালের ৯ জুন জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের বিরুদ্ধে চতুর্থ দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এর আগেও তিনবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। অবশেষে দীর্ঘ আলোচনা শেষে ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই ভিয়েনায় পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের বিশে^র ছয় জাতির সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির একপক্ষে ইরান, অন্যপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি। তবে ইসরাইল এ চুক্তির বিরোধিতা করে। চুক্তিটি ওই বছরের ২০ জুলাই জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ইরানের সাথে সম্পাদিত সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে আসার কথা বলতে থাকেন। ২০১৮ সালের ৮ মে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করে। ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ফের অর্থনৈতিক অবরোধের ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন। সম্পাদিত চুক্তির অবশিষ্ট পাঁচটি দেশ রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি এ চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাওয়ার এক বছর পর ২০১৯ সালের ৮ মে ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে আংশিক বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাবে এবং দেশটি দুর্বল হবে; এমনটি ভাবার অবকাশ নেই।
মনে রাখা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলসহ পশ্চিমাদের সাথে ইরানের বিরোধ থাকলেও, বিশ্বের অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে রয়েছে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা। রাশিয়া, চীন, কিউবা, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, পাকিস্তান, তুরস্ক, কাতার, মালয়েশিয়া, সিরিয়া ও ইরাকের সাথে ইরানের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ভারতের সাথেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভালো। এতগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে যার বন্ধুত্ব; অর্থনৈতিক অবরোধে দেশটিকে দুর্বল করা সহজ হবে না। ইরানের ব্যবসায়-বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বরাবরই কম। তা ছাড়া এবারের অবরোধ যুক্তরাষ্ট্রের একতরফাভাবে আরোপিত। ইসরাইল ছাড়া তেমন কেউ পাশে নাই। পরমাণু সমঝোতা চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়াটা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অন্য দিকে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির চুক্তি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে আরো দুর্বল করেছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা যুদ্ধে রূপ নেবে বলে মনে হয় না। হ
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ই-মেইল : [email protected].
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা