দেনমোহর নিয়ে অজ্ঞতা
- সিরাজ প্রামাণিক
- ০২ জুলাই ২০১৯, ০০:০০
দুই সন্তানের জননী সাথী (ছদ্মনাম)। গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্বামী রিকশা চালান, নেশা করে সাথীকে অত্যাচার করেন। এত কিছুর পরও তিনি সংসার করতে চান। তার ধারণা, সংসার ভাঙলে তিনি কিছুই পাবেন না। রিকশাচালক স্বামী এক রাতে সংসার করবেন না বলে জানিয়ে দেন। একই সাথে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চান বলে জানালেন। সাথীর মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হওয়ার উপক্রম। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন এক আইনজীবীর কাছে। তিনি সব কিছু শুনে দেনমোহর আদায়, সন্তানের ভরণপোষণ এবং অন্যান্য অধিকার বিষয়ে সাথীকে সচেতন করেন। সাথী এবার মোহরানা, ভরণপোষণসহ তালাক চাওয়ার সাহস অর্জন করলেন। তবে স্বামীকে দেনমোহর দেয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি বিষয়টি তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দেন। অবশ্য পারিবারিক আদালতে মামলা করে সাথীর সব অধিকার আদায় করিয়ে দেয়া হয়।
দারুণ স্মার্ট শিক্ষিতা রুমানা (ছদ্মনাম) নামকরা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ভালোবেসে বিয়ে করেন হ্যান্ডসাম শিক্ষিত ছেলেকে। বিয়ের সময় স্বামীর দেয়া উপঢৌকনকে দেনমোহর বলে মেনে নেন রুমানা। কাবিননামার ১৪ নম্বর কলামে ‘মোহরানা পরিশোধ’ বলে বিয়ে সম্পন্ন হয়। একসময় তাদের দাম্পত্য জীবনে ফাটল দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে সংসার ভেঙে যায়। বিয়ের উপঢৌকনের বিনিময়ে কাবিননামায় মোহরানার উল্লেখ না থাকায় তা থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হন রুমানা।
বিয়ের সময় দেয়া শাড়ি, গয়না ইত্যাদি কখনো দেনমোহরের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের সময় গয়না, শাড়ি ইত্যাদির মূল্য দেনমোহরের একটি অংশ ধরে ‘উসুল’ লিখে নেয়া হয়। আসলে বিয়েতে দেয়া উপহার বা উপঢৌকন দেনমোহর নয়। এগুলো দেনমোহরের অংশ বলে ধরা যাবে না এবং উসুল বলা যাবে না। (আবদুল কাদের বনাম সালিমা, ১৮৮৬, পৃষ্ঠা ১৪৯)।
সুজন ও ছন্দা একে অপরকে ভালোবাসেন। তাদের ভালোবাসাকে বাস্তব রূপ দিতে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তারা। সুজন এখনো বেকার। কাজী অফিসে গিয়ে এক হাজার টাকা দেনমোহরে বিয়ে করেছেন ছন্দা। ভালোবাসার আবেগে অধিকারের কথা ভুলে গিয়ে সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনেন ছন্দা। কিছু দিন না যেতেই দাম্পত্য জীবনে কলহ দেখা দেয়। দেনমোহর বাবদ এক হাজার টাকা আর তিন মাসের খোরপোশ বাবদ ৯ হাজার টাকা, মোট ১০ হাজার টাকা দিয়ে ছন্দাকে তালাক দিয়েছেন সুজন।
মুসলিম আইনে দেনমোহর স্ত্রীর প্রতি স্বামীর শ্রদ্ধার নিদর্শন। তা পরিশোধে স্বামীর ওপর দায় আরোপিত হয়েছে। দেনমোহর কত হবে; তা নির্ণয়কালে স্ত্রীর বাবার পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্যের ক্ষেত্রেÑ যেমন স্ত্রীর বোন, খালা, ফুফুদের ক্ষেত্রে দেনমোহরের পরিমাণ কত ছিল, তা বিবেচনা করতে হয় (হামিরা বিবি বনাম যুবাইদা বিবি, ১৯১৬, ৪৩ আই. এ. পৃষ্ঠা ২৯৪)। তা ছাড়া, স্ত্রীর বাবার আর্থসামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিগত যোগ্যতা, বংশমর্যাদা, পারিবারিক অবস্থা ইত্যাদির ভিত্তিতে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। অন্য দিকে বরের আর্থিক সামর্থ্যরে দিকও বিবেচনায় রাখা হয়। এসব দিক বিবেচনা করেই মূলত দেনমোহর নির্ধারণ করতে হয়। দেনমোহর নির্ধারণ করার পর এর পরিমাণ কমানো যায় না, তবে স্বামী ইচ্ছা করলে তা বাড়াতে পারেন (জহুরান বিবি বনাম সোলেমান খান, ১৯৩৩, ৫৮ ক্যাল.জে. পৃষ্ঠা ২৫১)। তবে দেনমোহর বিয়ের আগে, বিয়ের সময়, এমনকি পরও নির্ধারণ করা যেতে পারে। (কামরুন্নেসা বনাম হুসাইনি, ১৮৮০, ৩ অল. পৃষ্ঠা ২৬৬)। নির্ধারিত দেনমোহরের পরিমাণ কোনোক্রমেই দশ দিরহামের কম হবে না (সাহাবুদ্দিন বনাম উমাতুর রসুল, ৬০, পৃষ্ঠা ৫১১)। স্ত্রী দেনমোহরের দাবিতে মামলা করলে, দেনমোহরের পরিমাণ বেশি বা স্বামীর সামর্থ্যরে ঊর্ধ্বেÑ এমন কথা স্বামীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অজুহাত হিসেবে গ্রাহ্য হবে না (সুলতান বেগম বনাম সায়াজ উদ্দিন, ১৯৩৬, ১৬১ আইসি. পৃষ্ঠা ৩০০)। এমনকি কোনো বিয়েতে দেনমোহর ধার্য না হয়ে থাকলেও স্ত্রী মর্যাদামাফিক দেনমোহর পাওয়ার অধিকারিণী (২০ ডিএলআর, পৃষ্ঠা ২৭)। দেনমোহর এত বেশি হওয়া উচিত নয়, যা স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা অসম্ভব। আবার এত কম হওয়াও উচিত নয়, যা স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে না।
পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় রিপার। রিপার বাবা কৃষক। তিনি লেখাপড়া জানেন না। ছেলে ভালো চাকরি করেনÑ এমন সংবাদে খুশি হয়েই রিপাকে বিয়ে দিলেন। কিন্তু বিয়ের আসরে কাবিনে উল্লিখিত দেনমোহরের অংশটি পরিশোধ না করেই ‘উসুল’ লিখে দেয়া হয়। বিষয়টি রিপার পরিবার তখন লক্ষ করেনি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে অজ্ঞতাও একটি বড় কারণ। পরে দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটলে মোহরানা আদায়ের প্রশ্ন আসে। কিন্তু কাবিনে ‘উসুল’ লেখা থাকার কারণে রিপা তার প্রাপ্য দেনমোহর থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
দেনমোহর দুই প্রকার। একটি তাৎক্ষণিক, যা স্ত্রী চাওয়া মাত্র পরিশোধ করতে হবে। আরেকটি বিলম্বিত যা বিবাহবিচ্ছেদ অথবা স্বামীর মৃত্যুর পর পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া স্বামী সালিসি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে স্ত্রীকে বিলম্বিত দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। সাধারণত দেনমোহরের কিছুটা বিয়ের সময় তাৎক্ষণিক হিসেবে দেয়া হয় এবং তা কাবিননামায় লিখিত থাকে। বাকিটা ‘বিলম্বিত দেনমোহর’ হিসেবে ধরা হয়। স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা করে দেনমোহর আদায় করতে পারবেন। দেনমোহর দাবির পর তা পরিশোধ না করা হলে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী পৃথক থাকতে পারবেন এবং ওই অবস্থায় স্বামী অবশ্যই তার ভরণপোষণ করতে বাধ্য থাকবেন (১১ ডিএলআর, পৃষ্ঠা ১২৪)। এ ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলে স্ত্রী তার দেনমোহর আদায়ে পারিবারিক আদালতে মামলা করে তা আদায় করতে পারেন। তবে অবশ্যই তালাক হওয়ার তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। হ
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
E-mail:[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা