গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় ভোটাধিকার
- সুরঞ্জন ঘোষ
- ২৫ জুন ২০১৯, ০০:০০
ক্ষমতারোহণ অপেক্ষা স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া বেশি গৌরবের। এ কথা ঠিক, ক্ষমতার মোহ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখা সহজ কাজ নয়। বিশ্ব ইতিহাসে এখন পর্যন্ত মাত্র কিছু রাষ্ট্রনায়ক হাসিমুখে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়েছেন। তাদের পুরোধা জর্জ ওয়াশিংটন। আমেরিকার স্থপতিরা একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়তে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন; তা যথাযথভাবে দেশটিতে বাস্তবায়িত হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে ক্ষমতা ছাড়া এবং ক্ষমতায় আসার জন্য টেকসই নির্বাচনব্যবস্থা প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছে দেশটির নেতৃত্ব। এর ধারাবাহিকতা এখনো বিদ্যমান। আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা আইনের শাসননির্ভর রাষ্ট্র গড়তে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। ফলে দেশটি সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছতে পেরেছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, যে দেশের বেশির ভাগ নাগরিক শুদ্ধ চিন্তা আর বিবেকের দায়বদ্ধতায় দেশ গড়তে চান, সে দেশের সমৃদ্ধি অপ্রতিরোধ্য। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে জর্জ ওয়াশিংটন এবং আব্রাহাম লিংকন সেরা প্রেসিডেন্ট। তাদের ধারে কাছে কেউ পৌঁছতে পারেননি। অথচ এই দুইজনের কারো প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। সফল রাজনীতিকের নেতৃত্বগুণই বড় সম্পদ। ব্রিটিশ আমেরিকান কলোনির অধিবাসীরা ছিলেন একই বংশোদ্ভূত এবং একই রক্তধারা ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। তবু একসময় স্বজাতির বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা অর্জনের পথে হাঁটতে বাধ্য হন। এর কারণ মাত্রাতিরিক্ত শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা আর ব্যক্তি স্বাধীনতা।
মাত্রাতিরিক্ত শাসন আর হস্তক্ষেপে মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এতে রাষ্ট্রের মানচিত্র বদলে যাওয়ার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। বহু শাসকের পরিবর্তন হয়েছে আন্দোলনের মুখে। কাজেই নিষ্ঠুর শাসন আর নিয়ন্ত্রণ অথবা সীমাহীন কঠোরতা কখনো কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। উদারপন্থী এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই শান্তিপূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। ইতিহাস পাঠে আমরা এটাই দেখতে পাই। পক্ষান্তরে মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা ঐক্য ও শান্তি বিনষ্ট করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও একই সূত্রে গাঁথা। তা হলো, মাত্রাতিরিক্ত শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি, গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা পূরণ আর ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল।
বাংলাদেশ প্রায় অর্ধশত বছর পার করতে যাচ্ছে। অথচ দেশে আজ মৌলিক অধিকার এবং ভোটাধিকারের বড়ই অভাব। এখন ভোটের আগে রাতে ‘ভোট’ হয়ে যায়। নব্বইয়ের স্বৈরাচারী এরশাদ পতনের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। ওই আন্দোলনের সেøাগান ছিল, ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো।’ মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে মানুষ অধিকার আদায়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলভিত্তি ঐক্য, অংশীদারিত্ব, পারস্পরিক আস্থা, পরমত সহিষ্ণুতা, উদার নীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা এবং ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। গণতন্ত্রের চর্চায় সব সময় প্রাধান্য পায় আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা। এর ভিত্তিতে দেশে গড়ে ওঠে জাতীয় ঐক্য। আমাদের দেশে বর্তমানে ভালো কাজ, ত্যাগ স্বীকার, পরোপকার এবং দেশপ্রেমের গুরুত্ব তেমন নেই। এখন চার দিকে সম্পদ অর্জনের লিপ্সা, আত্মসাৎ, ভোগদখল, প্রতারণা, অন্যের অনিষ্ট করার অপচেষ্টার যেন জয় জয়কার। মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়েছে চাটুকারিতা, মিথ্যাচার, অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং অন্যকে হেয় ও ঘায়েল করে যেনতেনভাবে উপরে ওঠার অসুস্থ প্রচেষ্টা। এসব কারণে দেশে এক ধরনের মানবিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সুকুমার বৃত্তি, ত্যাগ আর পরোপকার নির্বাসনে যাওয়ার উপক্রম। তবে এখনো আমাদের সামনে রয়েছে ভালো কাজের অবারিত সুযোগ। এ জন্য চাই, কেবল শুভ মানসিকতা।
নতুন বা পুরনো যেকোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা অপরিহার্য। গণতন্ত্রে সাধারণ নাগরিকের অবস্থান থাকে শক্তিশালী। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতামত নেয়া হয়। সাধারণ নির্বাচন অথবা গণভোটের মাধ্যমে তাদের মতের প্রতিফলন ঘটে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ ধরনের নির্বাচনের নিশ্চয়তা থাকলে সাধারণ মানুষের মধ্যে অধিকার আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক পথে চলার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। নাগরিকদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করতে প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চার বিকল্প নেই। কিন্তু এ দেশে গণতন্ত্র চর্চার বড়ই অভাব। নেই ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ। গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের অভাবে হিংসা, ক্ষোভ, ক্রোধ ও বিবাদ দিন দিন বাড়ছে। ফলে জাতীয় ঐক্য হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত।
মানুষ গণতন্ত্র কেন চায়? কেন গণতান্ত্রিক সমাজ চাই? কারণ, প্রায় সব নাগরিক চায়, তাদের ওপর যেন কিছু লোকের ক্ষমতা জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে না বসে এবং বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে সমাজের সব সম্পদ কেন্দ্রীভূত না হয়। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছেই যেন ক্ষমতা থাকে। আবার তারা ইচ্ছা করলে যেন এ ক্ষমতা ফিরিয়ে নিতে পারেন। রুশো বলেছিলেন, সমাজে ব্যক্তি বিশেষের ক্ষমতা বা শক্তি যেন এতখানি বেড়ে না যায়; যাতে ক্ষমতাধারী ব্যক্তির মধ্যে অন্যায় করার প্রবণতা প্রকট হয়ে ওঠে। রুশো এ কথাও বলেছেন, সমাজে ধনসম্পদ যেন বিশেষ ব্যক্তির হাতে এমনভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে না পড়ে, যাতে দরিদ্র লোকেরা ধনবানদের কাছে নিজেদের বিক্রয় করে দেয়। সমাজে ক্ষমতা ও সম্পদের ভারসাম্য কেবল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেই সম্ভব। মানুষ গণতন্ত্র চায় এজন্য যে, এ থেকে সব ধরনের অর্থনৈতিক মুক্তি, সুশাসন ও রাষ্ট্রীয় শক্তি অর্জিত হয়। মানুষ গণতন্ত্র অর্থাৎ ক্ষমতা ও সম্পদের ভারসাম্য ছাড়া এগোতে পারে না। এ কারণেই শত দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা আর প্রত্যাশার অপূর্ণতা সত্ত্বেও দেশে দেশে মানুষ এখনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকেই তাদের উপযোগী মনে করে। এর জন্যই দেশে দেশে আন্দোলন আর সংগ্রাম।
গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আকর্ষণ প্রবল। এ দেশের মানুষের জন্য সব প্রতিকূলতা ও দুঃসময়ে গণতন্ত্রই শক্তি জুগিয়েছে। কেবল তাই নয়, সাম্প্রদায়িকতা, পশ্চাৎপদতা ও কূপমণ্ডকতার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন করেছে দেশের মানুষ। এজন্য গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রথমেই ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই জনগণের প্রতি সম্মান দেখানো হবে। হ
লেখক : নব্বইয়ের ছাত্র নেতা ও হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক ট্রাস্টি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা