উদাসীন থাকতে পারেন না গণতন্ত্রকামী
- মোজাফফর হোসেন
- ২৫ জুন ২০১৯, ০০:০০
‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। দেশপ্রেম ছিল নাটকটির বিষয়বস্তু। ছাত্রছাত্রীদের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাটকটি মঞ্চস্থ হতো। এ নাটকের কুখ্যাত দু’টি চরিত্র মীরজাফর ও ঘষেটি বেগম। তবে এ দু’টি চরিত্রে কোনো ছাত্রছাত্রী অভিনয় করতে চাইত না। ক্লাসের সবচেয়ে বখাটে ছেলেটি শরীর-স্বাস্থ্যে হৃষ্টপুষ্ট; তাকে সবাই মিলে মীরজাফরের চরিত্রে অভিনয় করতে অনুরোধ করত। সবাই যখন একযোগে ওর শারীরিক যোগ্যতা নিয়ে প্রশংসা করত, তখন সে অভিনয়ে রাজি হতো। নাটক শেষে বছরব্যাপী ছাত্রটিকে মীরজাফর আখ্যায়িত হয়ে কলঙ্কের ভার বইতে হতো। আজকাল আর স্কুল-কলেজে সিরাজউদ্দৌলা নাটকের মঞ্চায়ন তেমন দেখা যায় না।
ছাত্রছাত্রীদের সহজে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের জুড়ি মেলা ভার। স্কুল-কলেজের মতো পাড়া-মহল্লায়ও সিরাজউদ্দৌলা যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হতো। সেই যাত্রাপালা রাতভর সাধারণ মানুষ উপভোগ করতেন। এ যাত্রাপালার মাধ্যমে পাড়াগাঁয়ের নারী-পুরুষ সবাই দেশপ্রেম বিষয়টি উপলব্ধি করতেন। এটা লক্ষ করা গেছে বহুদিন পর্যন্ত। দেশপ্রেমের শিক্ষা নিয়ে বাঙালি মুসলিম সমাজের কোনো বাবা-মা আজো তাদের সন্তানের নাম মীরজাফর কিংবা ঘষেটি বেগম রাখতে চান না; অথচ মীরজাফরের পুরো নামটি অর্থবোধক; এতে একধরনের আভিজাত্য রয়েছে : মীরজাফর আলী খান। এ নামের সব গুণাগুণ ছাপিয়ে নামটি বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সে কারণে কোনো মা-বাবাই চান না তাদের আদরের সন্তানকে কেউ মীরজাফর বা ঘষেটি বেগম নামে ডাকুক। ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মধ্য দিয়ে অভিভাবকদের ভেতরে দেশপ্রেমের যে চেতনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা একটি জাতির জীবনে মহামূল্যবান সম্পদ।
মীরজাফর আলী খান ছিলেন স্বাধীন বাংলার জনপ্রিয় শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি। ইংরেজদের সাথে যুদ্ধের সময় মীরজাফর ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। ফলে ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর বাংলা তার স্বাধীনতা হারিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল। সেনাপতি হিসেবে মীরজাফর যদি তার পদমর্যাদা রক্ষা করতে পারতেন, তাহলে উপনিবেশবাদী ইংরেজরা বাংলাকে শোষণ করার সুযোগ পেত না।
সেনাপতিদের ওপর অনেকটা নির্ভর করে কোনো একটি দেশের সার্বভৌমত্ব। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব যেমন সেনাপতিদের রয়েছে; তেমনি দেশের গণতান্ত্রিক ধারা কোনোভাবে ব্যাহত হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর রাখতে হয় জনগণকে। আধুনিক যুগে বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশের সম্পদ ও মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব যেমন সেনাপতিদের দায়িত্ব, তেমনি কর্তব্যের মধ্যে পড়ে নিজ দেশের অভ্যন্তরে শত্রু-মিত্রকেও চেনা।
‘সিরাজউদ্দৌলা’ ইতিহাস আশ্রিত রাজনৈতিক নাটক। ইংরেজরা নবাবের সেনাপতি মীরজাফরকে হাত করতে পেরেছিল। তিনিও বাংলার নবাব হওয়ার স্বপ্নে ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। মীরজাফর যা করতে পেরেছিলেন বর্তমান বিশ্বের সেনাপতিদের সে সুযোগ হয়তো কম; একেবারে যে নেই তা বলা যায় না। তবে বিপদের কথা হলো, বর্তমান বিশ্বে একটি দেশের গণতন্ত্রীরূপী স্বৈরশাসকের হাতে হাত মিলিয়ে সেনাপতিরা ক্ষমতার স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। এটি হলে জনগণকে অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। এটা অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত অনেক দেশে প্রায়ই হতে দেখা যায়। এসব দেশে সরকারপ্রধান ও সেনাপতিরা মিলেমিশে জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করতে থাকেন।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র। কিন্তু এ দেশে গণতন্ত্রের ভিত পোক্ত নয়। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে নিয়ে আসতে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে। এ দেশে এমনও সময় গেছে, যখন সেনাপতিরা গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছেন। আবার কখনো তারা গণতন্ত্রের ঘাড়ে চেপে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করেছেন। এ পালাবদল হয়তো চিরতরে শেষ হয়ে যায়নি। গত ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা সেনাপ্রধান মইন উদ্দিনের সময়ও তা লক্ষ করা গেছে। মইন ক্ষমা চেয়ে নেয়ার আগেই দেশান্তরিত হয়েছেন।
অন্য দিকে ২০১৪ সালের ‘ভোটারবিহীন’ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। নির্বাচনের নামে এ প্রহসন জাতিকে অবাক করেছে। সে নির্বাচনে গণতন্ত্র পদদলিত। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরও জনগণ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারলেন না। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, নির্বাচনী মাঠ সবার জন্য সমান হবে, তা হয়নি। এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রকামী। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তাই তাদের প্রখর। কিছু মানুষের জন্য জনসাধারণ অনেক সময় তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গণতন্ত্রকামী মানুষ নিজেদের দেশে গণতন্ত্রের বিপন্ন অবস্থায় উদাসীন থাকতে পারেন না। হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা