০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ৭ শাবান ১৪৪৬
`

আনন্দময় পাঠক্রম শিশুর অধিকার

-

অনেক ভালো সিদ্ধান্ত। শিশুদের জন্য পরীক্ষা না থাকাই বাস্তবসম্মত। নীতিনির্ধারকদের সাধুবাদ জানাতে হয় এমন পদক্ষেপের জন্য। দেখা গেছে, পড়ার চাপ ও পরীক্ষার ভয়ে স্কুলে যেতে না চাওয়াসহ অনেক শিশু প্রাইমারি থেকেই ঝরে পড়ছে। একই সাথে অবাঞ্ছিত, অপ্রয়োজনীয়, কম প্রয়োজনীয় কিছু বই তুলে দিয়ে শিশুশিক্ষা, সিলেবাস ও পাঠক্রম আনন্দময় করা অতি জরুরি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা থাকছে না। এ স্তরের মূল্যায়ন করা হবে ধারাবাহিকভাবে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে বলে জানায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে অবশ্যই এটি করতে হবে শিক্ষাবিদসহ শিশুদের নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী। শিক্ষা কমিশন ও বিশেষজ্ঞের সুপারিশকে পাশ কাটিয়ে শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে পরিবর্তন করলে ফল উল্টো হতে পারে।
অবশ্য, দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাবিদই পিইসি ও ইবতেদায়ি পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সে সময় প্রশাসনের শীর্ষ মহল থেকে বলা হয়েছিল, এ পরীক্ষায় নাকি শিশুদের পরীক্ষা ভীতি দূর করে। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব বাড়ে। ফলে তখন কারো সুপারিশ, মতামত, পরামর্শ আমলে নেয়া হয়নি।
প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শিশুদের ওপর চাপ কমানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত ও অতি প্রয়োজনীয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, পিইসির মতো অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা বহাল রেখে, তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখলে পিইসির রেজাল্ট কি হবে তা সংশ্লিষ্টরা চিন্তা করেছেন কী? কোনো সিদ্ধান্তের পারস্পরিক মিল না রেখে, একটা ভালো সিদ্ধান্তের সাথে যদি দু’টি খারাপ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে লাভ কী? প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণীর পরীক্ষা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। স্কুল পর্যায়ের এ পরীক্ষায় যত না শিশুদের জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, তার চেয়ে পিইসি পরীক্ষায় শতগুণ বেশি মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। এ কারণে পিএসসি ও ইবতেদায়ি পরীক্ষায় ব্যাপক আকারে অনুপস্থিতি দেখা যায়।
শহরের বিদ্যালয়গুলোতে তৃতীয় শ্রেণীর ভর্তি পরীক্ষার জন্য শিশুদের সারা বছর কোচিং করতে হয়। আমাদের শিশুদের শৈশব বইয়ের টেবিলে যেন ‘রোবট বাচ্চা’ হয়ে আছে। শিশুদের ওপর পরীক্ষায় বা বাসায় একটি বানান ভুল করলে সে সবার থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে, এ আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়। ফল কী হচ্ছে? শিশুরা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। প্রবল ভীতি সৃষ্টি হচ্ছে তাদের মধ্যে। শিশুশিক্ষাকে আনন্দময় করার সাথে তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তারা যাতে হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে শিখতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। যে শিক্ষার্থী তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখার চাপমুক্ত থাকবে, সে পঞ্চম শ্রেণীতে হঠাৎ চাপের সম্মুখীন হলে, ওই চাপ তার জন্য কতটুকু সহনীয় হবে?
জাতীয় শিক্ষানীতিতেও প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তা এতদিন বাস্তবায়ন করা হয়নি। এখন সরকারের নির্দেশে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে সুচিন্তিত টেকসই কোনো শিক্ষাব্যবস্থা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তথাকথিত নামী-দামি কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু ব্যক্তি ইচ্ছা কিংবা অর্থ অপচয়ের ব্যবস্থামাত্র। এজন্য শিক্ষাবিদদের হাতে শিক্ষা সংস্কার ছেড়ে দিতে হবে। শিশুদের শিক্ষা, পরীক্ষা, সিলেবাস যেন হয় আনন্দময়। শিশুরা সব কিছুতে আনন্দ খোঁজে। যেকোনো বিষয়ে জোর করে তাদের দিয়ে করাতে গেলে হিতে বিপরীত হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই। প্রথমে শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। শিশুদের ওপর বইয়ের চাপ, পরীক্ষার চাপ কমানোর বিষয়টি শুধু তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্তই নয়, পুরো মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের চাপ কমাতে হবে।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হ-য-ব-র-ল! কেউ কি এটি অস্বীকার করতে পারবেন? নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে অনবরত এক্সপেরিমেন্ট চলছে! শুধু শিশুরাই নয়, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত ‘গিনিপিগে’ পরিণত হয়েছে বলে অনেকের অভিমত। এজন্য শিক্ষার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। জাতিকে নৈতিকতা ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিতে হবে।
শিক্ষার মান নির্ভর করে পাঠ্যবইয়ের ওপর। নকশা অনুযায়ী যেমন বাড়ির দরজা, জানালা হয়; তেমনি স্কুলের সুপাঠেই ঠিক হয়ে আসবে শিশুদের দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানের পরিধি এবং বিবেচনাবোধ। পরীক্ষা, প্রশ্নপত্রের ধরন, নম্বর বণ্টন এ পরিবর্তনগুলোর সামাজিক প্রভাব কী, তা বিবেচনায় আনতে হবে। দেখা যায় তিন, সাড়ে তিন বছরের শিশুদের পিঠে এক বস্তা বই! অথচ শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্টদের অভিমত, পাঁচ বছরের আগে শিশুদের হাতে বই তুলে দেয়া উচিত নয়। শিশুদের কেন চার বছরে স্কুলে দিতে হবে? এটি কি চাপ নয়?
শিশুদের পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব, শেয়ারিংয়ের মনোভাব তৈরি করতে উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের লালপরী, ফুলপরীর মতো আজব কেচ্ছা কাহিনী না শিখিয়ে কিভাবে মানুষ হিসেবে সব ধর্ম, শ্রেণী, জেন্ডারের সাথে সমাজে বসবাস করা যায় সেই শিক্ষা দিতে হবে। হ
[email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement