০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

বাংলাদেশে শিশু নিখোঁজের ঘটনা কি সত্যিই বেড়েছে?

বাংলাদেশে সামাজিকমাধ্যমে প্রায়শই শিশু নিখোঁজের ঘটনা শোনা যাচ্ছে - প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুকে একটি বিষয় নিয়ে বেশ আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে। সেটি হচ্ছে, শিশুদের‘নিখোঁজ' হওয়ার সংবাদ। হারিয়ে যাওয়া এসব শিশুদের বেশির ভাগই মাদরাসার শিক্ষার্থী এবং চট্টগ্রাম বিভাগের বাসিন্দা বলেও দাবি করা হচ্ছে।

দেশটিতে হঠাৎ করেই শিশু নিখোঁজের ঘটনা বেড়ে গেছে দাবি করে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপের পোস্টে বলা হচ্ছে, গত দুই দিনে সারা দেশে না কি প্রায় ৩৫ জন শিশু নিখোঁজ হয়েছে।

ফেসবুকের একের পর এক এমন পোস্টে অভিভাবকদের অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবেই কী শিশু নিখোঁজের ঘটনা বেড়েছে? নিখোঁজের এই কথিত ঘটনাগুলো নিয়ে পুলিশই বা কী বলছে?

একটি ‘নিখোঁজ সংবাদ’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন হালিশহর এলাকার বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার দুপুরের পর তার স্কুলপড়ুয়া ছোট ভাই বাড়ি থেকে কোচিংয়ের উদ্দেশে বের হয়। এরপর গত তিন দিন ধরে ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না বলে জানান তৌহিদুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ওর যত বন্ধু-বান্ধব আছে, সবার কাছে খোঁজ নিছি। আত্মীয়-স্বজনও কেউ বাদ নেই। কিন্তু কেউ কিচ্ছু বলতে পারেনি।

অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সন্ধান না মেলায় সেই রাতেই স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে নিখোঁজ কিশোরের পরিবার।
কিন্তু পরের দুই দিনেও ভাইয়ের অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য না পাওয়ায় শেষমেশ এ বিষয়ে সাহায্য চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন তারা।

তিনি বলেন, পুলিশও কিছু বলতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়েই আমরা ফেসবুকে পোস্ট দেয়া শুরু করি।

ফেসবুকে প্রথমে নিজেদের অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গ্রুপ এবং পেজেও ‘নিখোঁজ সংবাদ’ শিরোনামে পোস্ট দেন ইসলাম এবং তার স্বজনরা।

ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পোস্টগুলো অন্যান্য গ্রুপ এবং পেজেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

তিনি জানান, অনেকেই আমাদের করা পোস্ট, তাদের নিজেদের আইডি, গ্রুপ এবং পেজে শেয়ার দিচ্ছেন।

তিনি আরো বলেন,‘যেহেতু এটা হেল্প পোস্ট, কাজেই তাদেরকে আমরা নিষেধ করছি না।’

রোববার সকালে ইসলামের সাথে কথা বলার ঘণ্টা দু’য়েকের মধ্যেই ইসলামের নিখোঁজ ভাইয়ের সন্ধান পায় পুলিশ।

চট্টগ্রামের হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: কায়সার হামিদ বলেন,‘থানায় জানানোর পর থেকেই আমরা বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান চালাচ্ছিলাম। পরে ঢাকার একটি জায়গায় তার খোঁজ পাওয়া যায়।’

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে রোববার রাতেই তাকে নিজ পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হবে বলেও জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা ।

কিন্তু কোচিংয়ের উদ্দেশে বের হয়ে কিশোর ছেলেটি ঢাকায় চলে আসল কী করে?
ওসি কায়সার হামিদ বলেন, ‘মোবাইলফোন নিয়ে পরিবারের সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় রাগ করে সে ঢাকায় চলে গিয়েছিল।’

ওই কিশোরের পরিবারের সদস্যরা অবশ্য আমাদের সাথে কথা বলার সময় মনোমালিন্যের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।

তবে ফিরে পাওয়ার পর রাতে আবারো পোস্ট দিয়ে সবাইকে বিষয়টি অবহিত করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

আরেকটি নিখোঁজের ঘটনা
ঢাকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ইকরামুল হক (ছদ্মনাম)। শনিবার বিকেলে খেলতে বের হওয়ার পর তার এক আত্মীয়র মাদরাসা পড়ুয়া ছেলে নিখোঁজ হয়।

একপর্যায়ে সেই আত্মীয়ের অনুরোধেই শিশুটির সন্ধান চেয়ে ফেসবুকে একটি বার্তা পোস্ট করেন ইকরামুল হক। তার ক্ষেত্রেও পোস্টটি দ্রুতই বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেজে ছড়িয়ে পড়ে।

পরে রাতেই শিশুটিকে পাশের একটি এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়। জানা যায়, সে পথ হারিয়ে ফেলেছিল।

এরপর শিশুর সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে ফেসবুকে আরেকটি বার্তা পোস্ট করেন তিনি।

কিন্তু শুরুতে যারা ‘নিখোঁজ সংবাদে’র পোস্টটি শেয়ার দিয়েছিলেন বা পুনরায় পোস্ট করেছিলেন, তাদের বেশির ভাগই পরবর্তীতে সন্ধান পাওয়ার বার্তাটি সেভাবে প্রচার করেননি।

ফলে মাদরাসাপড়ুয়া ওই শিশুটির নিখোঁজ হওয়ার খবরটি এখনো বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।

ইকরামুল হক বলেন, এটা দেখে আমি আরো একটা পোস্ট করেছি এবং নিখোঁজ সংবাদটি ডিলিট করারও অনুরোধ জানিয়েছি।

কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় একপর্যায়ে তিনি মূল পোস্টটিই ডিলিট করে দেন।

তিনি বলেন, কিন্তু তারপরও এখনো অনেক গ্রুপে আগের পোস্টের ছবি বা স্ক্রিনশট ছড়াতে দেখা যাচ্ছে।

গ্রুপগুলো কী বলছে?
ফেসবুকে ব্যক্তিগত বিভিন্ন ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি এক ডজনেরও বেশি গ্রুপ এবং পেজ থেকে শিশুদের নিখোঁজ হওয়ার খবরগুলো প্রচার হতে দেখা যাচ্ছে।

এই ফেসবুক গ্রুপগুলোর ক্ষেত্রে বেশির ভাগই দেখা যাচ্ছে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক একাধিক পেজ ও গ্রুপে দাবি করা হয়েছে যে, গত ৪৮ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগসহ সারা দেশে প্রায় ৩৫ জন শিশু নিখোঁজ হয়েছে।

আরেকটি পেজে নিখোঁজের এই সংখ্যা ৫০ জন ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করা হয়েছে।

ওই সব নিখোঁজ বার্তায় শিশুদের কারো কারো ছবি প্রকাশ করা হলেও থানায় সাধারণ ডায়েরির অনুলিপি খুব কম ক্ষেত্রেই প্রকাশ করা হয়েছে।

নিখোঁজের খবর প্রকাশ করছে, এরকম অন্তত সাতটি গ্রুপ এবং পেজের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে বিবিসি।

তাদের মধ্যে মাত্র একটি গ্রুপ কথা বলতে রাজি হয়েছে। বাকিগুলোর কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

ঢাকা কেন্দ্রিক একটি যে ফেসবুক গ্রুপটির সাথে কথা হয়েছে, তারা মোট তিনটি নিখোঁজ সংবাদ প্রকাশ করেছেন।

যদিও আরো অন্তত ১০টি নিখোঁজ সংবাদ প্রকাশের অনুরোধ এসেছিল বলে জানাচ্ছেন তারা।

প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ফেসবুক গ্রুপের একজন অ্যাডমিন বলেন,‘গত কয়েক দিনে এরকম প্রায় ১৫টি অনুরোধ আমরা পেয়েছি। কিন্তু জিডির কপিসহ বাকি প্রমাণপত্র না দিতে পারায় সেগুলো আমরা প্রকাশ করিনি।’

যে তিনটি নিখোঁজ বার্তা গ্রুপটিতে প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একজনের সন্ধান পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

গ্রুপের ওই অ্যাডমিন বলেন,‘বিষয়টি জানার পরপরই আমি গ্রুপেও আপডেট পোস্ট দিয়েছি এবং সদস্যদেরকে আগের পোস্ট শেয়ার না করার অনুরোধ জানিয়েছি।’

পুলিশ যা বলছে
শিশুদের নিয়ে যে পরিমাণ‘নিখোঁজ সংবাদ’ ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেজে দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর বেশির ভাগেরই কোনো ভিত্তি নেই বলে জানাচ্ছেন পুলিশের কর্মকর্তারা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র মো: ফারুক হোসেন বলেন,‘এগুলো খতিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ঘটনাই ভিত্তিহীন।’

একই কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ।

তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে হয়তো দু-একটি ঘটনা ঘটছে এবং আমরা দ্রুত তাদের খুঁজেও বের করছি।

ফলে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই বলে জানাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

ডিএমপি মুখপাত্র বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।

কিন্তু খবরগুলো ছড়াচ্ছে কারা? তাদের উদ্দেশ্যই বা কী?

ফারুক হোসেন বলেন,‘দেশকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবেই এসব মিথ্যা খবর ছড়ানোর চেষ্টা করা হতে পারে।’

তিনি আরো জানান,‘কারা এটি করছে, সেটি জানার জন্য ইতোমধ্যেই আমাদের সাইবার টিম কাজ শুরু করেছে। আশা করি শিগগিরই তাদেরকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’

দেশে প্রতি বছর ঠিক কতজন শিশু নিখোঁজ হয়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি পুলিশ।

তবে জাতিসঙ্ঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচারকালে প্রায় ৭৭৮ জন মানুষকে উদ্ধার করে দেশটির পুলিশ।

তাদের মধ্যে প্রায় ১৫৫ জন শিশু-কিশোর উদ্ধার হয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement