ঈদের আগে এমভি আব্দুল্লাহর বন্দী নাবিকরা কি বাড়ি ফিরতে পারবেন
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৪৭, আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১০:১২
বাংলাদেশী মালিকানাধীন মালবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ ছিনতাইয়ের পর তিন সপ্তাহ পার হতে চললো। সোমালি জলদস্যুদের হাতে বন্দী জাহাজটির নাবিকরা ঈদের আগে পরিবারের কাছে ফিরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।
যদিও জাহাজটির মালিকপক্ষ বলছে, নাবিকদের দ্রুত মুক্ত করতে তারা সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এমভি আব্দুল্লাহ ছিনতাইয়ের পর প্রথম আট দিন ভয়াবহ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কেটেছে বন্দী নাবিকদের পরিবারগুলোর।
নয় দিনের মাথায় সোমালি জলদস্যুরা এমভি আব্দুল্লাহর মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করলে কিছুটা আশার আলো দেখতে পায় তারা।
ছিনতাই হওয়া জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর বেগম বলেন, ‘এরপর থেকেই আমরা অধীর অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছি যে কখন ছেলেটা মুক্ত হয়ে ঘরে ফিরে আসে। আমি চাই আমার ছেলে ঈদের আগেই ঘরে ফিরে আসুক।’
এমভি আব্দুল্লাহর মালিকপক্ষও জানিয়েছে, ঈদের আগে নাবিকদের মুক্ত করতে তারা সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আমরাও চাচ্ছি ঈদের আগেই এই বন্দীদশার অবসান হোক এবং সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের আগে মুক্তি পেলেও এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের দেশে ফেরানো কঠিন হবে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘জাহাজটি এখন যেখানে অবস্থান করছে, মুক্তি পেলেও ঈদের আগে সেখান থেকে বাংলাদেশে আসা সম্ভব হবে না বললেই চলে।’
সুপেয় পানির সঙ্কট বাড়ছে
যতই দিন যাচ্ছে, ততই এমভি আব্দুল্লাহতে সুপেয় পানির সঙ্কট তীব্র হচ্ছে বলে জানান চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর বেগম।
সোমালি জলদস্যুদের কাছে বন্দী আতিকুল্লাহ খানের সাথে তার পরিবারের সবশেষ যোগাযোগ হয়েছে রোববার সন্ধ্যায়।
শাহানুর বেগম বলেন, ‘খাবারের সঙ্কট আপাতত নেই, তবে পানির সঙ্কট তীব্র হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পানি শেষ হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে এখন নাবিকরা সবাই রেশনিং করে অল্প পানি ব্যবহার করছে।’
মোজাম্বিক থেকে প্রায় ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাইয়ে যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ২৩ জন নাবিকসহ এমভি আব্দুল্লাহকে বন্দী করে সোমালি জলদস্যুরা।
তখন জাহাজটিতে প্রায় ২০০ টন বিশুদ্ধ পানি এবং মাসখানেকের হিমায়িত খাবার মজুদ ছিল বলে জাহাজের মালিকপক্ষ জানিয়েছে।
এর বাইরে কিছু শুকনা খাবার মজুদ ছিল বলেও জানিয়েছে তারা।
ফলে খাবার এবং পানি নিয়ে নাবিকরা সঙ্কটে পড়বে না বলে জানানো হয়েছিল।
কিন্তু বন্দী করার পর অন্তত ২০ জলদস্যুর সবাই যখন নাবিকদের খাবারে ভাগ বসায়, তখনই মূলত খাবার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়।
আট দিন পর জাহাজের মালিকপক্ষের সাথে মুক্তিপণের বিষয়ে সমঝোতা শুরু হয়। ততক্ষণে এমভি আব্দুল্লাহও সোমালিয়ার উপকূলে পৌঁছে যায়।
ফলে জলদস্যুরা নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করায় নাবিকদের মধ্যে খাবার নিয়ে উদ্বেগ কিছুটা কমে।
শাহানুর বেগম বলেন, ‘কিন্তু দস্যুরা খাবার পানি এখনো জাহাজ থেকেই নিচ্ছে। সেই কারণেই পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে।’
এদিকে, মুক্তি পাওয়ার পর জাহাজ নিয়ে রওনা হতে গেলেও সুপেয় পানির প্রয়োজন হবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘এমনকি জাহাজের ইঞ্জিন স্টার্ট করতে গেলেও বেশ ভালো পরিমাণে ফ্রেশ ওয়াটারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সোমালিয়ায় ফ্রেশ ওয়াটার অতটা সহজলভ্য নয়। কাজেই এটি নিয়ে নাবিকদের দুশ্চিন্তা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।’
অন্যদিকে, একই জায়গায় গাদাগাদি করে থাকা এবং লোনাপানিতে গোসল করার কারণে নাবিকদের অনেকের শরীরে চুলকানির মতো চর্মরোগ দেখা দিয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে।
শাহানুর বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের আগে থেকেই এলার্জির সমস্যা। ওর শরীরে নাকি এখন চুলকানি হয়ে গেছে।’
মুক্তিপণের বিষয়ে জাহাজের মালিকপক্ষের সাথে সমঝোতা আলোচনা শুরু হওয়ার পর জলদস্যুরা নাবিকদের সাথে তুলনামূলক ভালো ব্যবহার করছে বলে জানান তিনি।
সমঝোতা কতদূর?
কয়লাসহ জাহাজ এবং নাবিকদের মুক্ত করতে গত ২০ মার্চ থেকে জলদস্যুদের সাথে সমঝোতা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এমভি আব্দুল্লাহর মালিকপক্ষ কবির গ্রুপ।
মূলত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া তৃতীয় একটি পক্ষের সহায়তায় সমঝোতা আলোচনাটি চালানো হচ্ছে।
কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আলোচনায় বেশ ভালো অগ্রগতি হয়েছে।’
তার দাবি, আলোচনা ফলপ্রসু হয়েছে বলেই জলদস্যুরা নাবিকদের সাথে ভালো ব্যবহার করছে।
তিনি বলেন, ‘আলোচনা ঠিকমতো না এগোলে জলদস্যুরা এত দিনে হয়তো নাবিকদের ওপর অত্যাচার শুরু করে দিত।’
এ ধরনের জাহাজ ছিনতাইয়ের পর জলদস্যুরা সাধারণত মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করে থাকে।
এর আগে, ২০১০ সালে এমভি জাহান মনি নামে কবির গ্রুপের আরো একটি জাহাজ ছিনতাই করেছিল সোমালি জলদস্যুরা।
তখনও মুক্তিপণ দিয়ে ১০০ দিনের মাথায় সেটি মুক্ত করা হয়েছিল।
এমনকি সম্প্রতি সোমালি জলদস্যুদের কাছ ভারতীয় নৌ-বাহিনীর সদস্যরা ‘এমভি রুয়েন’ নামে মাল্টার পতাকাবাহী যে জাহাজটি জব্দ করেছে, ছিনতাইয়ের পর সেটির মালিকপক্ষের কাছেও মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল।
ভারতীয় নৌ-বাহিনী জানিয়েছে, এমভি রুয়েনের মালিকপক্ষের কাছে প্রায় ৫০০ কোটি ভারতীয় রুপি সমমানের মুক্তিপণ চেয়েছিল সোমালি জলদস্যুরা।
কিন্তু এমভি আব্দুল্লাহর ক্ষেত্রে জলদস্যুরা কত টাকা মুক্তিপণ চাচ্ছে, সে বিষয়ে মুখ খুলছে না কবির গ্রুপ।
এমনকি জলদস্যুদের পক্ষ থেকে এখনো মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে কিনা, সেটিও স্পষ্ট করা হচ্ছে না।
কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু এতটুকুই বলতে পারি যে বন্দী নাবিকদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করার দরকার, সব চেষ্টায় আমরা করছি।’
বন্দী নাবিকদের সাথে মালিকপক্ষের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
শিগগিরই তারা এমভি আব্দুল্লাহকে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ঈদের আগে ফেরা কঠিন কেন?
বন্দী করে সোমালিয়া উপকূলে নেয়ার পর বেশ কয়েকবার অবস্থান পরিবর্তন করতে দেখা যায় এমভি আব্দুল্লাহকে।
ছিনতাই হওয়ার পর থেকেই স্যাটেলাইট ইমেজ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজটির অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন।
তারা বলছে, এমভি আবদুল্লাহ বর্তমানে সোমালিয়ার গদবজিরান এলাকার জিফল উপকূল থেকে প্রায় দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘মুক্ত হওয়ার পর জাহাজটির প্রথম কাজ হবে নিকটস্থ পোর্টে গিয়ে ফুয়েল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাপ্লাই নেয়া।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোমালিয়া উপকূল ছেড়ে আসার পথে জ্বালানি নিতে হলে এমভি আব্দুল্লাহকে থামতে হবে ওমানের সমুদ্র বন্দরে।
সেখানে পৌঁছাতে অন্ততপক্ষে তিন দিন সময় লাগবে বলে জানান তারা।
ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘তখন মালিকপক্ষ চাইলে ওমানে জাহাজের নাবিকদের দল চেঞ্জ করতে পারবেন।’
তবে সে জন্য আগে থেকেই নাবিকদের নতুন দলকে ওমানে প্রস্তুত রাখতে হবে। তারা জাহাজের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে জাহাজের গন্তব্যস্থল দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা হবে।
তিনি বলেন, ‘কারণ জাহাজের মালগুলো দুবাইয়েই পৌঁছানোর কথা ছিল এবং যেভাবেই হোক সেটি পৌঁছে দিতে হবে। এটাই আন্তর্জাতিক রীতি।’
অন্যদিকে, ওমানে নেমে যাওয়া নাবিকরা শারীরিক পরীক্ষা ও অন্যান্য আইনগত বিষয় মিটিয়ে তারপর চাইলে বিমানে করে দেশে ফিরতে পারবে।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে বেশ কয়েকদিন সময় লেগে যাবে।’
সব মিলিয়ে ঈদের আগে মুক্তি পেলেও বাড়িতে ফিরতে নাবিকদের আরো দেড়-দুই সপ্তাহ সময় বেশি লেগে যাবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা