ঈদের আগে সব পোশাক কারখানা কি বেতন-বোনাস দিতে পারবে?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ মার্চ ২০২৪, ২৩:১৯
বাংলাদেশে প্রতি বছরই ঈদের আগে বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে পোশাক খাতে কমবেশি অস্থিরতা দেখা দেয়। বহু শ্রমিক রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করেন, এ সময় চরম ভোগান্তিতেও পড়ে জনগণ।
জনগণের এমন ‘ভোগান্তি লাঘবে’ সম্প্রতি বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ যেসব পোশাক কারখানা বেতন বোনাস দিতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে তাদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে।
তারা বলছে, পোশাক শিল্প মালিকরা ঈদের আগেই যাতে বেতন বোনাস পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে সেজন্য আগাম সতর্কতার অংশ হিসেবেই তা করা হয়েছে।
প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, পোশাক শিল্প মালিকরা বেতন পরিশোধ করতে না পারলে সরকার কি ব্যবস্থা নিতে পারে? আর ব্যবসায়ীরাই বা এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
পোশাক শিল্প মালিকরা বলছেন, যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ইতোমধ্যেই তারা কারখানাগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছেন।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের পাওনা প্রণোদনা ছাড়ের অনুরোধও করা হয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, কোনো কারখানা বেতন দিতে ব্যর্থ হলে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয় সরকার। এমন কী প্রয়োজন সাপেক্ষে সরকারের নির্ধারিত তহবিল থেকেও সহায়তা দেয়া হয়।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের তালিকায় যা রয়েছে
আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে যেসব শিল্প-কারখানাগুলো বেতন ও বোনাস পরিশোধে সমস্যায় পড়তে পারে এমন সব প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছে বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ।
এ তালিকা অনুযায়ী, সমস্যায় পড়তে পারে এমন শিল্প কারখানার সংখ্যা ৪১৬টি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক হাজার ৫৮৯টি কারখানার মধ্যে এই তালিকায় রয়েছে ১৭১টি।
এদের মধ্যে বেতন দিতে ব্যর্থ হতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৬টি, বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে ৪১টি। বেতন ও বোনাস উভয়ই দিতে ব্যর্থ হতে পারে এমন প্রতিষ্ঠান ৭৪টি।
এ তালিকায় দেখা যায়, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্য ৭১টি।
এদের মধ্যে বেতন দিতে ব্যর্থ হতে পারে ২১টি কারখানা, বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে ২৮টি কারখানা।
বেতন ও বোনাস দুইটিই দিতে ব্যর্থ হতে পারে এমন কারখানার সংখ্যা ২২টি।
তালিকাটিতে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ২৯টি কারখানা বেতন বোনাস পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে।
এদের মধ্যে শুধু বেতন দিতে ব্যর্থ হতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৩টি। বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে চারটি প্রতিষ্ঠান।
বিটিএমএ’র প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেতন ও বোনাস উভয়ই দিতে ব্যর্থ হতে পারে ১২টি।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের এই তালিকায় বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ বা বেপজার ৩৮৩টি কারখানার মধ্যে ১৩টি কারখানা রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে তিনটি কারখানা বেতন দিতে ব্যর্থ হতে পারে। বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে সাতটি।
বেতন ও বোনাস দুইই দিতে ব্যর্থ হতে পারে আরো তিনটি কারখানা।
এছাড়াও অন্য ৬৫১টি কারখানার মধ্যে সমস্যা হতে পারে ১৩২টি কারখানাতে।
এরমধ্যে বেতন দিতে ব্যর্থ হতে পারে ৩৮টি, বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে ২৮টি কারখানা।
বেতন ও বোনাস দুইটিই দিতে ব্যর্থ হতে পারে ৬৬টি কারখানা।
ঝুঁকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো যা বলছে
ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের করা ঝুঁকির তালিকায় গার্মেন্টস সেক্টরের বেশ বড় বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও রয়েছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান ক্লাসিক ফ্যাশন কনসেপ্ট লিমিটেড।
এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: শহীদুল্লাহ আজিম। যিনি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট।
শহীদুল্লাহ আজিম জানান, চলমান বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি, ক্রয়াদেশ কম থাকাসহ নানা কারণে পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো চরম সঙ্কটে রয়েছে।
তিনি বলেন,‘শ্রমিকদের বেতন বেড়ে গেছে, ইউটিলিটি কস্ট বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ক্রয়াদেশ কমে গেছে। ফলে অনেক ফ্যাক্টরিই চাপে আছে। বেশির ভাগ ফ্যাক্টরিই স্ট্রাগল করছে। প্রতি বছরই এই রিপোর্ট হয়। দাম কম, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়াতে অর্ডার কম ছিল। তাই সবাই কোণঠাসা অবস্থায় আছে।’
আজিম বলেন, ‘সবাই চেষ্টা করছে যাতে ঈদের আগে বেতন ভাতা পরিশোধ করা যায়। নিজ প্রতিষ্ঠানে ও ঈদের আগে বেতন-বোনাস দিতে সমস্যা হবে না।’
ঈদের আগে বেতন-বোনাসকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি না হয় সে বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান গার্মেন্টস সেক্টরের নেতারা।
বিজিএমইএ-র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘ইতোমধ্যেই সব ফ্যাক্টরিগুলোতে কার কী সমস্যা তা জানাতে একটি ফরম্যাট পাঠানো হয়েছে। যাতে সমস্যা সমাধান করা যায়। ব্যাংকগুলো যাতে তাদের সাপোর্ট ও সুবিধা দেয় সেজন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রণোদনা বাবদ প্রায় পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সাধারণত ঈদের আগে তারা এগুলো রিলিজ করে।’
তিনি বলেন, ‘এই সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা ছাড় করে দেবে। কয়েকদিন আমরা প্রত্যেকটি ফ্যাক্টরি রেগুলার মনিটর করব যাতে ঈদের আগে সবাই বেতন-বোনাস দিতে পারে।’
সমাধান কীভাবে হয়?
গার্মেন্টস সেক্টরের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, সাধারণত ঈদের আগেই এ ধরণের সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করে এসব সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
বিজিএমইএ-র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে সমঝোতার মাধ্যমে পদক্ষেপ নেয়া হয় যাতে সমস্যা সমাধান করা যায়। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক নেতাদের সাথে আলোচনায় বসে ব্যাংক থেকে লোন করার ব্যবস্থাও করি। আবার বিজিএমইএ থেকেও সাপোর্ট দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আবার বায়ারের পেমেন্ট বা কোনো পার্টির কাছে বকেয়া টাকা রয়েছে কি না, সব বিষয় আমলে নিয়েই সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়।’
সাধারণত এ ধরনের যেকোনো প্রতিষ্ঠানে বেতন-বোনাস পরিশোধের বিষয়টি ওই প্রতিষ্ঠানেরই ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব।
আর এসব বিষয় লঙ্ঘন হচ্ছে কি না তা তদারকি করে শ্রম মন্ত্রণালয় ও কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতর। এক্ষেত্রে কারখানা বন্ধ করাসহ যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারে শ্রম মন্ত্রণালয়।
তবে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, কারখানা বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান না। কারণ কারখানা বন্ধ করে দিলে শ্রমিকরা আর বেতন পাবে না। ফলে এটা সমঝোতা করে এমনভাবে কাজ করানোই সমীচিন, যাতে সমস্যার সমাধান করা যায়।
অনেক সময় কারখানার মেশিন বিক্রি করেও শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-বোনাসের ব্যবস্থা করা হয়।
ফারুক হাসান বলেন, ‘ব্যাংক থেকে লোন করে বিজিএমইএ থেকে কিছু সাপোর্ট দিয়ে কারখানাগুলো যাতে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারে সে ব্যবস্থা করা হয়।’
এছাড়া এ ধরনের প্রেক্ষাপটে সরকার বিজিএমইএ ও কারখানাগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয়। যাতে করে সমস্যা চিহ্নিত করে সুরাহা করা যায়।
মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক বলেন, ‘সব সময়ই সরকার এ ধরনের পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতা করেন। এমন না যে করেন না। সরকারের একটি তহবিলও রয়েছে। যে সব প্রতিষ্ঠান একেবারেই বেতন বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে, ফ্যাক্টরির অবস্থা খুবই খারাপ, তাদের ওই তহবিল থেকে সরকার অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে।
এ বিষয়ে কথা বলতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: মাহবুব হোসেনের মোবাইলে ফোন করলেও রিসিভ করেননি তিনি।
কেন প্রতি বছর ঈদের আগে অসন্তোষ?
বাংলাদেশে প্রতি বছরই ঈদের আগে গার্মেন্টস সেক্টর অশান্ত হয়ে উঠতে দেখা যায়। বকেয়া বেতন ও বোনাসের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেন শ্রমিকরা।
মহাসড়ক অবরোধ করেও বিক্ষোভ করতে দেখা যায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের। আবার এসব আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটে।
আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেট-এই আটটি শিল্প অধ্যুষিত এলাকাতেই রয়েছে অধিকাংশ কারখানা।
এসব শিল্প এলাকায় প্রতি বছর দেখা যায় ঈদের আগে বেতন-বোনাসের দাবিতে শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করলে তা জনগণের চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, করোনার পর থেকে বিশ্ব বাণিজ্যের অবস্থা, আর্থিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, গ্যাসের দাম বাড়লেও ঠিকমতো গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়া-সহ নানা কারণে পোশাক খাত কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে।
ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিসহ নানা বিপাকে পড়ে গার্মেন্টস বা কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দিতে সমস্যায় পড়ে বলে তাদের বক্তব্য।
এদিকে প্রতি বছরই সরকার ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করতে পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতি আহ্বান জানায়।
এ বছরও সরকারের এমন সিদ্ধান্ত পোশাক শিল্প মালিকদের আগেই অবহিত করা হয়েছিল। যাতে করে যেকোনো ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ এড়ানো যায়।
সেই উদ্দেশ্যেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ এই তালিকা করেছিল বলে জানা গিয়েছে। বিগত বছরগুলোতে ঈদের আগে বেতন ভাতা দিতে না পারার যে উদাহরণ এবং এর ফলে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনার পটভূমিতেই এই তালিকাটি করা হয়।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক সানা সামিনুর রহমান বলেন, ‘ঈদের সময় যাতে এ ধরনের সমস্যা না হয় সে জন্য আগে থেকে সতর্ক করা হয়েছে। প্রোঅ্যাকটিভ অ্যাকশন হিসেবে যাতে করে ঈদের আগে বেতন না পেয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে না হয় তাই সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা বেতন না পেয়ে সঙ্গত কারণেই রাস্তায় নামেন। এটা মানবিক বিষয়। এটিকে সামনে রেখেই সমস্যা যাতে সৃষ্টি না হয় শিল্প মালিকরা যার যা করণীয় তা যাতে করতে পারেন সে জন্য এই তালিকা করে প্রত্যেককে অবহিত করা হয়েছে।’
শ্রমিক
ঈদের আগে বাড়িমুখী হাজার হাজার মানুষ যাতে ভোগান্তিতে না পড়েন এবং সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এড়াতে শিল্প মালিকরা যাতে পদক্ষেপ নিতে পারেন সে জন্য আহ্বান জানিয়েছেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের এই কর্মকর্তা।
এছাড়া ঈদের ছুটির সময় ফাঁকা কলকারখানা অধ্যুষিত এলাকায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের বিশেষ টহল ডিউটির ব্যবস্থা থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধি, কর্ম-পরিবেশসহ নানা দাবিতে আন্দোলনে নামেন। এ সময় একজন শ্রমিক নিহতও হন।
তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পোশাক খাতের ক্রেতা ইউরোপীয় দেশগুলো উদ্বেগ জানিয়ে পোশাক খাতের অচলাবস্থা নিরসনে আহ্বান জানায় সরকারের প্রতি।
এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরিও বৃদ্ধি করেছিল সরকার।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা