২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর গাফিলতির কারণেই বার বার আগুনের ঘটনা

রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর গাফিলতির কারণেই বার বার আগুনের ঘটনা - ছবি : ইউএনবি

রাজধানী ঢাকায় কয়েক দশক ধরেই ঢাকায় অগ্নিকাণ্ড গটে চলেছে। পর্যবেক্ষণ ও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে বার বার প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ক্রমাগত অবহেলা ও যথাযথ তদারকির অভাবের ফল এসব ঘটনা।

রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নির্দেশনা পুরোপুরি না মেনে। এসব ভবনে অগ্নিসংকেতের ব্যবস্থা নেই। নেই পর্যাপ্ত পানি ও অগ্নিনির্বাপণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।

আগুনের ঘটনায় গাফিলতির জন্য রাজউকসহ সংশ্লিস্ট সংস্থা, ভবন মালিকসহ যারা দায়ী তাদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত নজির সৃষ্টি করতে পারলে আগুনের ঘটনা কমবে। বিচারহীনতা সংস্কৃতির কারণে একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে বলে নগর পরিকল্পনাবিদদরা মনে করেন।

প্রায় প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু এসব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেন বললেই চলে।

নানা অব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন এবং রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমোদনের বাইরে ভবন ব্যবহার নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণে নিমতলী, চূড়িহাট্টা, এফআর টাওয়ার, আরমানিটোলা, নিউমার্কেট, মগবাজার বিস্ফোরণ, গুলিস্তান ট্রাজেডিসহ একের পর এক হৃদয় বিদারক ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে ঢাকার বাসিন্দাদের। সর্বশেষ এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে রাজধানীর বেইলি রোড ট্রাজেডি। নতুন করে মারা গেছেন ৪৬ জন। এসব প্রতিটি ট্রাজেডির পরেই সংশ্লিষ্ট সবারই মুখেই ঝুঁকিমুক্ত শহর গড়ার প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছুটেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সময়ের সাথে আড়ালে চলে গেছে প্রতিটি ঘটনা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন,‘আগুনের ঘটনায় ইমারত অনুমোদন ও তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্হা, ভবন মালিকসহ যারা দায়ী তাদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারলে আগুনের ঘটনা কমবে, না হলে অতীতের মতো ছাড় দিলে একটার পর একটা ঘটনা ঘটবে।’

এসব অগ্নিকাণ্ডের দায় রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা, ভবন মালিকের পাশাপাশি জেনে শুনে ভাড়া নেয়া দোকান মালিকদের নিতে হবে বলে জানান তিনি।

ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন,‘আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের মিশ্র ব্যবহার রাজধানীকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। পৃথিবীর কোথাও ঢাকার মতো মিশ্র ব্যবহারের উদাহরণ নেই। রাজউক বাইরের দেশের উদাহরণ দিচ্ছে, কিন্তু বাইরে হয়তো আবাসিক জোনে ছোট্ট একটা কফি শপ বা ছোট্ট কোনো দোকান আছে। কিন্তু ঢাকায় রাজউক যেভাবে আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিকে রূপান্তরের বৈধতা দিচ্ছে, এতে রাজধানীকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ঢাকার অধিকাংশ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নির্দেশনা পুরোপুরি না মেনে। নেই পর্যাপ্ত পানি ও অগ্নিনির্বাপণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।’

বিআইপি সভাপতি বলেন,‘বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির প্রথম থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক (শুধুমাত্র অফিসকক্ষ হিসেবে) এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম তলা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। যেখানে অনুমোদনহীনভাবে বেশিরভাগই ছিল রেস্তোরাঁ; যা সুস্পষ্টভাবে ইমারত আইন ও নগর পরিকল্পনার ব্যত্যয়।’

তিনি বলেন,‘অতীতের অগ্নিদুর্যোগের ঘটনার মতোই রাজধানীর বেইলি রোডে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটিকে আসলে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই বিবেচনা করা দরকার। এই ধরনের দুর্ঘটনা আসলে রাজউকসহ সেবা সংস্থাসমূহের গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা না করলে এবং সংশ্লিষ্ট যেসব ব্যক্তি ও সংস্থা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, উদাসীনতা ও অন্যায় আচরণ করেছেন তাদের যথাযথ আইনের আওতায় না আনলে এর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।’

আদিল বলেন, যে উদ্দেশ্যে ভবন তৈরি করা হয়েছে, ওই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তা যাচাই করতে ঢাকার সব ভবনের তথ্য অনলাইনে দেয়ার অনুরোধ করছি। এই তথ্য প্রকাশ করা হলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সাধারণ মানুষই চিহ্নিত করতে পারবে। সেই সাথে, কোনো ভবনের মালিকের বিরুদ্ধে কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ নোটিশ দিয়ে থাকলে তা ভবনের সামনে টাঙিয়ে রাখা উচিৎ।

রাজধানীর বেইলি রোডে ভবনটিতে দোকান-রেস্তোরাঁ করার অনুমোদন ছিল না
এ বিষয়ে রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভবনটির এক থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন নেয়া হয়েছে। তবে তা শুধু অফিস কক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। রেস্তোরাঁ, শোরুম (বিক্রয় কেন্দ্র) বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেয়া হয়নি।

পুলিশ যা বলছে
এ বিষয়ে পুলিশের মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, রাজউকের পরিদর্শকদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে ওই ভবনটিতে রেস্তোরাঁ স্থাপন করা হয়। এসব রেস্তোরাঁ গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডার ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল। রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য ভবনের মালিক ও ম্যানেজারের যোগসাজশে চুমুক, কাচ্চি ভাই, মেজবানী রেস্টুরেন্ট, খানাস ফ্ল্যাগশিপ, স্ট্রিট ওভেন, জেষ্টি, হাক্কা ঢাক্কা, শেখহলি, ফয়সাল জুসবার (বার্গার), ওয়াফেলবে, তাওয়াজ, পিৎজা–ইন, ফোকো এবং এম্ব্রোশিয়া রেস্তোরাঁর মালিকেরা ভবনটির নিচ তলায় বিপুল পরিমাণে গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: মাইন উদ্দিন বলেছেন, রাজধানীর বেইলি রোডের আগুন লাগা বহুতল ভবনটিতে কোনো অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। এ নিয়ে এর আগে তিনবার নোটিশ দেয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

রাজউকের বক্তব্য
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেছেন, বেইলি রোডের আগুনের

ঘটনায় রাজউকের কারোর গাফলতি থাকলে তাদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্হা নেয়া হবে। আর যেসব ভবনে আগে আগুন লেগেছিল, সেসব নিয়ে মামলা চলছে।

তিনি বলেন, বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় শুক্রবার তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এবং সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অভিযান শুরু করা হয়েছে। ভবন ব্যবহারে অনিয়ম পেলে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। আর এক্ষেত্রে আগে থেকে কোনো নোটিশ দেয়া হবে না।

তাই ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন এবং শপিংমলে অভিযান চলছে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট, শপিং মল ও ভবনে যেনো কেউ না যান, সেজন্য মানুষকে সাবধান করে রবিবার গণ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে বলেও জানান রাজউক চেয়ারম্যান।

রাজউক চেয়ারম্যানের অভিযোগ করে বলেন, শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ রাজউক থেকে নকশা পাস করে নেয়ার পরও, সেই অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করে না।

রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ মৌচাক মার্কেটকে তিনবার নোটিশ দেয়া হলেও মালিক সমিতি কোনো কর্ণপাত করছে না বলে জানান রাজউক চেয়ারম্যান।

নিমতলী ট্র্যাজেডি
২০১০ সালের ৩ জুন রাত ৯টার দিকে রাজধানীর চানখারপুলের নিমতলীতে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ধরে যায় পাশের কেমিক্যালের গোডাউনে। নিহত ১২৪ জন। আহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক।

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় ৬৭ জনের। পরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১। এতে আহত হন কয়েকশ মানুষ।

এফআর টাওয়ার ট্র্যাজেডি
বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুর ১টায় লাগা আগুনে ২৭ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক আহত হয়।

মগবাজারের বিস্ফোরণ
২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নিচতলায় বিস্ফোণে ১২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় দুই শতাধিক।

বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটে আগুন
২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। এতে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকার।

সর্বশেষ বেইলি রোড ট্র্যাজেডি
গত বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবনে আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নিল ৪৬টি প্রাণ। এছাড়াও, দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরো অনেককেই।

সূত্র : ইউএনবি


আরো সংবাদ



premium cement