ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ, যা জানা যাচ্ছে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:১৮, আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:৩১
ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন পুরুষ শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। অভিযুক্ত শিক্ষকের বরখাস্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রোববার সকালে বিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভও করেছেন তারা।
ঘটনাটি ঘটেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখায়।
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দাবি, অভিযুক্ত ওই শিক্ষক দীর্ঘ দিন ধরেই কোচিংয়ে পড়ানোর নামে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করে আসছেন।
তবে অভিযুক্ত শিক্ষক অবশ্য যৌন নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
তিনি দাবি করেন, সুনাম নষ্ট করার লক্ষ্যে তাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
অন্য দিকে, যৌন নির্যাতনের ঘটনার তদন্তে ইতোমধ্যেই একটি কমিটি গঠন করেছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে বলেও তারা নিশ্চিত করেছেন।
এরপর ওই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত না করে আজিমপুর শাখা থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকার বেইলি রোডের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
তবে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা করা হয়নি।
এদিকে, বেশিভাগ ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের জন্য ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
কী ঘটেছে? যা বলছেন অভিযোগকারীরা
ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অন্ততঃ তিনজন ছাত্রী বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তারা সবাই বিদ্যালয়টির মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী।
ঘটনা জানতে অভিযোগকারী তিন ছাত্রীর একজনের অভিভাবকের সাথে কথা বলেছে বিবিসি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অভিভাবক জানান, অভিযুক্ত শিক্ষক বিদ্যালয়ের পাশেই একটি ভবনে শিক্ষার্থীদের কোচিং করান।
মাস কয়েক আগে সেখানে মেয়ে ভর্তি করান তিনি।
এরপর কোচিংয়ের আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে তার মেয়েকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই অভিভাবক।
তিনি জানান, ‘মা মা করে বিভিন্ন অজুহাতে উনি ছাত্রীদের শরীর স্পর্শ করেন, তারপর বিষয়টিকে অন্যভাবে না নেয়ার কথা বলেন।’
কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার মাসখানেক পর থেকেই ঘটনাটি ঘটে আসছিল বলেও দাবি করেছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অভিভাবক বলেন, ‘বয়স কম হওয়ায় শুরুতে আমার মেয়েটা বিষয়টি বুঝতে পারেনি। কিন্তু একই ঘটনা কয়েক দিন ঘটার পর সে আমাকে জানায়।’
তারপর বিষয়টি নিয়ে কোচিংয়ের অন্য অভিভাবকদের সাথে কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘তারাও তাদের মেয়েদের সাথে কথা বলে একই ঘটনা জানতে পারেন।’
এরপর গত ৭ ফেব্রুয়ারি তিন ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা মিলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেন।
ওই অভিযোগকারী ছাত্রীর অভিভাবক বলেন, ‘একজন শিক্ষক কিভাবে এমন কাজ করতে পারেন? আমরা এর বিচার চাই।’
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা
বিষয়টি জানার পর থেকেই অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে আসছে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। রোববার সকালে বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে তারা বিক্ষোভও করেছে।
অভিযুক্ত শিক্ষককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করার পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণেরও দাবি জানিয়েছে তারা।
আন্দোলনরত এক ছাত্রী বলেন, ‘উনি শিক্ষক নামের কলঙ্ক। আমরা উনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বিদ্যালয়টির সাবেক ছাত্রীদের মধ্যে থেকেও অনেকে একই অভিযোগ তুলেছেন বলেও দাবি করেছেন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থী।
আন্দোলনরত আরেক ছাত্রী বলেন, ‘তারা এখন আমাদের আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছেন। এ ঘটনার বিচার করতেই হবে।’
এদিকে, শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠায় অভিভাবকদের অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তাদের অনেকেই রোববারের বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিয়ে আন্দোলনকারীদের সাথে সংহতি জানান। এমনই একজন অভিভাবক ইশতাক জাহান পপি।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘লেখাপড়া শেখানোর জন্য এত টাকা-পয়সা খরচ করে যাদের কাছে আমরা বাচ্চাদের পাঠাচ্ছি, তারাই যদি এমন কাজ করে তাহলে আমরা কোথায় যাব?’
তিনি বলেন, ‘আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যেন এরকম ঘটনা ভবিষ্যতে আর না ঘটে।’
অন্য দিকে, অভিযোগ জানানোর দুই সপ্তাহ পরেও কঠোর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় অভিভাবকদের কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
ইফতেখার মমিন নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘একাধিক ছাত্রী একই অভিযোগ করেছে। তারপরও কর্তৃপক্ষ কোনো বিবেচনায় উনার চাকরি বহাল রাখে?’
তদন্তের নামে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সময়ক্ষেপণ করছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
এ ব্যাপারে এখনো কোনো মামলা করা হয়নি। তবে সন্তোষজনক বিচার না পেলে অভিভাবকরা মামলার পথেই হাঁটবেন বলে জানিয়েছেন মমিন।
তিনি বলেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে আমরা মামলা করিনি। কিন্তু উপযুক্ত ব্যবস্থা যদি না নেয়া হয়, তখন আমরা প্রয়োজনে মামলা করে বিচার চাইব।’
এছাড়া অভিযুক্ত শিক্ষককের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
কী বলছেন অভিযুক্ত শিক্ষক?
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীরা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন, তার সাথে কথা বলেছে বিবিসি।
অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি দাবি করেন, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে ‘পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানোর’ চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘একদল লোক মিথ্যে এবং বানোয়াট সব অভিযোগ তুলে আমাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। আমার এত দিনের সুনাম নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র করছে।’
এই ‘একদল লোক’ কারা জানতে চাইলে তিনি নিজ বিদ্যালয়েরই কয়েকজন সহকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন।
তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছরে আমি অনেক সুনাম কামিয়েছি, আমি গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছি, যা তারা মেনে নিতে পারেনি। এখন প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তারা পেছন থেকে আন্দোলনের কলকাঠি নাড়ছে।’
কিন্তু অন্য শিক্ষকের কথায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কেন তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যাবেন?
তিনি বলেন, ‘সবাই তো আন্দোলন করছে না। যাদেরকে আমি পড়াতে রাজি হইনি, বা নিলেও পরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণে বের করে দিয়েছি, তারাই এই দলে যোগ দিয়েছে।’
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
গত ৭ ফেব্রুয়ারি লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ। অভিযুক্ত শিক্ষক নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও প্রাথমিক তদন্তে ওই কমিটি যৌন হয়রানির ঘটনার সত্যতা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে আমরা দেড় শতাধিক ছাত্রীর সাথে কথা বলেছি এবং প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পেয়েছি।’
অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় অভিযুক্ত শিক্ষককে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঢাকার আজিমপুর শাখা থেকে প্রত্যাহার করে বেইলি রোডে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।
কিন্তু অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরও বরখাস্ত না করে কেন ওই শিক্ষককে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হলো?
তিনি বলেন, ‘তদন্তে আমরা যা পেয়েছি, সেটি ম্যানেজিং কমিটির কাছে তুলে ধরা ধরব। তারপর কমিটি এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।’
আগামী সোমবার সন্ধ্যার পর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের কাছে তুলে ধরা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে, অভিভাবকদের পক্ষ থেকে তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণের যে অভিযোগ করা হয়েছে, সেটি অস্বীকার করেছেন কেকা রায় চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘দেড় শতাধিক ছাত্রীর সাথে আমরা কথা বলেছি। এটি করতেই তো দু’সপ্তাহ চলে গেল।’
একই অভিযোগ কেন?
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পুরুষ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রায়ই এ ধরনের অভিযোগ উঠছে জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা।
এক ছাত্রীর মা অভিযোগ করে বলেন, ‘বার বার কেন তাদের শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ উঠছে? উঠছে, কারণ তারা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে না।’
যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠান প্রধান।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ দেখা যায়। কিন্তু এ কথা বলতে পারি, যৌন নির্যাতনের ঘটনায় আমরা আগেও কখনো ছাড় দেইনি, ভবিষ্যতেও দেবো না।’
অতীতেও বিভিন্ন সময় এই প্রতিষ্ঠানের পুরুষ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে, ২০১১ সালে পরিমল জয়ধর নামের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ সারা দেশেই আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর বাবা পরবর্তীতে মামলা করলে সে বছরই জয়ধরকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ধর্ষণের দায়ে ২০১৫ সালে তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেয় আদালত।
কিন্তু তারপরেও প্রতিষ্ঠানটির পুরুষ শিক্ষকদের বিরুদ্ধ যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠা বন্ধ হয়নি।
গত বছরও বিদ্যালয়টির অপর একটি শাখার একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পরবর্তীতে বরখাস্ত করা হলেও তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনিরাপদ?
গত এক বছরে সারাদেশে অন্তত ১৪২ জন নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
নির্যাতিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী শিক্ষার্থী রয়েছে বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটি পর্যায়েই এমন ঘটনা ঘটছে।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এ ঘটনাটি এমন একটি সময়ে সামনে এলো, যার কিছু দিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন একাধিক নারী শিক্ষার্থী।
তারও আগে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল।
বিচারহীনতার কারণেই এই ধরনের ঘটনা থামানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল।
তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির সমাজের সামনে খুব নেই। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে ক্রমেই নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে, একের পর এক যৌন নির্যাতনের ঘটনাই যেন সেটি জানান দিচ্ছে।’
সূত্র : বিবিসি