শিশুদের খতনার সময় অ্যানেসথেসিয়া দেয়া কি জরুরি
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৪৮
খতনা করাতে গিয়ে মঙ্গলবার রাতে আহনাফ তাহমিদ নামে ১০ বছর বয়সী একটি শিশু মারা গেছে। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে।
শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, অনুমতি না নিয়েই ‘ফুল অ্যানেসথেসিয়া’ দেয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে।
দেড় মাস আগে খতনা করাতে গিয়ে আয়ান আহমেদ নামে আরো একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল এবং তার পরিবারও একই অভিযোগ করেছিল।
বাংলাদেশে কোনো ধরনের অ্যানেসথেসিয়া দেয়া ছাড়াই যুগ যুগ ধরে হাজামরা (যিনি খতনা করান) এ কাজ করে আসছেন। তবে গত কয়েক দশকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে সার্জারির মাধ্যমে খতনা করানোর চল বেশ বেড়েছে।
কিন্তু খতনা করানোর সময় অ্যানেসথেসিয়া দেয়া ঠিক কতটা জরুরি? দিলেও কখন সেটিতে বিপদ ঘটতে পারে?
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে শিশুর খতনা করানোর জন্য অ্যানেসথেসিয়া দেয়ার দরকার রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু কোন ক্ষেত্রে ঠিক কী ধরনের অ্যানেসথেসিয়া দেয়া দরকার, সেটি নির্ধারণ করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
ঠিকঠাক শারীরিক পরীক্ষা না করে ভুল সময়ে ভুল অ্যানেসথেসিয়া দিলে রোগীর জীবন সঙ্কটাপন্ন হতে পারে বলেও জানান ডা. ভুঁইয়া।
তাহমিদের মৃত্যু, যা জানা যাচ্ছে
খতনা করানোর উদ্দেশে ১০ বছর বয়সী আহনাফ তাহমিদকে মঙ্গলবার রাত পৌনে ৮টার দিকে ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় অবস্থিত জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিক্যাল চেকআপ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান শিশুর বাবা ফখরুল আলম।
রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ খতনা শেষ হয়। এরপর এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও শিশুর চেতনা ফিরে না আসায় ফখরুল আলম উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।
তিনি বলেন, ‘আমি তাদের কাছে বার বার জানতে চেয়েছি আমার ছেলের কোনো সমস্যা হয়েছে কি-না। কিন্তু তারা প্রতিবারই বলেছে সিরিয়াস কিছু না, কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে।’
রাত ১০টার দিকে তাকে জানানো হয় যে তার ছেলের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘তখন তারা আমাকে বলে যে ছেলেকে দ্রুত অন্য হাসপাতালের আইসিইউতে নিতে হবে। কারণ তাদের ওখানে আইসিইউ নেই।’
ছেলেকে আইসিইউতে নিতে পাশের একটি বেসরকারি হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করেন তিনি।
রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ ওই হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সও চলে আসে। কিন্তু ততক্ষণে তাহমিদকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
ফখরুল আলমের অভিযোগ, অনুমতি না নিয়েই তার ছেলেকে ‘ফুল অ্যানেসথেসিয়া’ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ক’দিন আগেই ফুল অ্যানেসথেসিয়া দেয়ায় একটা ছেলে মারা গেছে বলে শুনেছিলাম। সে কারণে ওটিতে নেয়ার সময় আমি ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিলাম যেন আমার ছেলেকে ফুল অ্যানেসথেসিয়া না দেয়া হয়। কিন্তু তারা আমার কথা শুনল না। আমার সুস্থ-সবল ছেলেটাকে মেরে ফেলল।’
ঘটনার পর মঙ্গলবার রাতেই হাসপাতালের মালিক এবং কর্তব্যরত দুই চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করে হাতিরঝিল থানায় মামলা করে শিশুর পরিবার।
ফখরুল আলম বলেন, ‘আমি চাই, এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, যাতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।’
এদিকে অভিযুক্ত তিনজনের মধ্যে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আওলাদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘অভিযোগ পেয়ে রাতেই আমরা হাসপাতালের মালিক এবং একজন চিকিৎসককে গ্রেফতার করেছি। তাদের প্রত্যেকের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।’
ময়নাতদন্তের জন্য শিশুর লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শিশু আহনাফ তাহমিদ ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিল।
তার পরিবার আগে ডেনমার্কে বসবাস করত। ১০ বছর আগে সেখানেই তাহমিদের জন্ম হয়। ২০১৭ সালে স্ত্রী-সন্তানসহ দেশে ফিরে আসেন ব্যবসায়ী ফখরুল আলম। তার দুই ছেলের মধ্যে তাহমিদই ছিল বড়।
হাসপাতালে অভিযান, সেবা বন্ধ
শিশু তাহমিদের মৃত্যুর ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বুধবার অভিযান চালিয়ে জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিক্যাল চেকআপ সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসা সেবা দেয়ার কোনো অনুমোদন ছিল না বলে গণমাধ্যমকে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মোহাম্মদ মইনুল আহসান।
ঘটনাস্থল পরির্দশন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘তাদের শুধু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। সেখানে অনুমোদন না নিয়েই তারা হাসপাতাল পরিচালনা করছিল। সে জন্য তাদের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
শিশু মৃত্যুর ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হবে বলেও জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘খতনা করার সময় শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি। আমরা সব পক্ষের সবার সাথে কথা বলব। কাগজপত্র হাতে এলে তখন বোঝা যাবে কী ঘটনা ঘটেছে।’
অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করা হলেও জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিক্যাল চেকআপ সেন্টার কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে গ্রেফতার হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের মালিক ও চিকিৎসক নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন বলে জানান হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন।
অ্যানেসথেসিয়ায় বিপদ কখন?
একটা সময় ছিল যখন অ্যানেসথেসিয়া দেয়া ছাড়াই অস্ত্রোপচার করা হতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেটি বদলে গেছে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানব শরীরে ছোট-বড় যেকোনো ধরনের অস্ত্রোপচার করার আগে অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।
অ্যানেসথেসিয়া দিলে শরীর বা তার কোনো অংশ অবশ হয়ে যায়, ফলে অস্ত্রোপচারের সময় রোগী কোনো ব্যথা অনুভব করে না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘এতে নির্বিঘ্নে অস্ত্রোপচার করে ফেলা যায়।’
অ্যানেসথেসিয়ার একাধিক ধরন রয়েছে। যেমন, শরীরের কোনো নির্দিষ্ট অংশে ছোট অস্ত্রোপচার করার সময় কেবল ওই অংশটিকেই অবশ করা হয়। এটি ‘লোকাল অ্যানেসথেসিয়া’ নামেই বেশি পরিচিত।
তবে বড় অস্ত্রোপচার করার আগে অনেক সময় পুরো শরীর অবশ করে ফেলা হয়। এসব ক্ষেত্রে রোগী তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় চলে যায় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর আবার জেগে ওঠে।
ছোট-বড় যা-ই হোক, যেকোনো অ্যানেসথেসিয়া দেয়ার আগে রক্ত, হৃদস্পন্দনের হার-সহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য জানতে রোগীর বেশ কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ডা. শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘মূলত রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে এসব পরীক্ষা করা হয়। কোন ধরনের অ্যানেসথেসিয়া দেয়া তার জন্য নিরাপদ হবে, এর মাধ্যমে সেটি বোঝা যায়।’
কাজেই কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই শরীরে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হলে রোগীর জীবন সঙ্কটাপন্ন, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে বলে জানান তিনি।
এছাড়া যাদের জ্বর, ঠান্ডা, সর্দি-কাঁশি, শ্বাসকষ্ট, বক্ষব্যাধি বা হৃদযন্ত্রে ত্রুটি আছে, তাদের সে অবস্থায় অ্যানেসথেসিয়া না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই চিকিৎসক।
তিনি বলেন, ‘এরকম ক্ষেত্রে অ্যানেসথেসিয়া দেয়া মোটেও নিরাপদ নয়। সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎকের পরামর্শ নিয়ে সেরে উঠে বা রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে পরবর্তীতে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে।’
আয়ানের মৃত্যুর তদন্ত কতদূর?
এর আগে একই রকম আর একটি ঘটনায় আয়ান আহমেদ নামে আরো একটি শিশুর মৃত্যু হয়। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর সাঁতারকুলের ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খতনার জন্য অজ্ঞান করা হয়েছিল শিশু আয়ান আহমেদকে।
খতনা করানোর পর ১১ ঘণ্টাতেও তার সংজ্ঞা না ফিরলে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে এনে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সাত দিন সেখানে থাকার পর গত ৭ জানুয়ারি আয়ানকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
ঘটনার পর তখনো অভিযুক্ত হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। নিবন্ধন ছাড়াই হাসপাতালটি কাজ চালিয়ে আসছিল বলেও জানানো হয়।
শিশু সন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ বাড্ডা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু দেড় মাসেও তদন্ত রিপোর্ট বের হয়নি।
এ অবস্থায় ওই শিশুর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনে ২০ ফেব্রুয়ারি নতুন করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় হাইকোর্ট।
সেই কমিটিতে রয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এ বি এম মাকসুদুল আলম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শশাঙ্ক কুমার মণ্ডল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।
আরো রয়েছেন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) সহকারী অধ্যাপক সাথী দস্তিদার এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক আমিনুর রশীদ।
কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
সূত্র : বিবিসি