খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ান মৃত্যু, পরিবার যা বলছে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৪৯
‘নামি-দামি অনেকেই ইউনাইটেড মেডিক্যালে স্বাস্থ্যসেবা নেয়। সে জন্য কিছু টাকা বেশি গেলেও ছেলেটার খতনা নিরাপদে হবে, এই বিশ্বাস থেকেই ওখানে গিয়েছিলাম। অথচ ছেলেটা আমার লাশ হয়ে ফিরল।’ আক্ষেপ করে বলছিলেন শিশু আয়ানের বাবার শামীম আহমেদ।
একমাত্র ছেলে আয়ান আহমেদকে খতনা করানোর জন্য গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার সাতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যান শামীম আহমেদ।
সেখানে অ্যানেসথেসিয়া দেয়ার পর আর জ্ঞান ফেরেনি সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী শিশুটির।
ভুল চিকিৎসা ও হাসপাতালের অবহেলার কারণেই আয়ানের অকালমৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বাবা শামীম আহমেদ।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটার ঠান্ডার সমস্যা ছিল জেনেও তারা ফুলবডি অ্যানেসথেসিয়া কিভাবে দিলো? তাছাড়া খতনা চলাকালে ৩০ থেকে ৪০ জন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীকে তারা দর্শক হিসেবে ওটিতে ঢুকাল। এটা কোনো ধরনের ওটি?’
তিনি বলেন, ‘আসল কথা হচ্ছে আমাদেরকে ওরা মানুষই মনে করে না। মন্ত্রী-মিনিস্টাররা গেলে তাদের কাছে যে ধরনের সেবা পায়, আমরা সাধারণ মানুষরা গেলে সেটা পাই না।’
এছাড়া মামলা তুলে নেয়ার জন্যও বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর রোববার ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
হাসপাতালটি নিবন্ধন ছাড়াই এতদিন চলছিল। এমন কি এই নামে কখনো কোনো নিবন্ধনের আবেদনও করা হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।
যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, যথাযথ নিয়ম মেনে মূল প্রতিষ্ঠান ‘ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড’ নামে নিবন্ধন আবেদন করা হয়েছিল।
সেটি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানিয়েছেন ইউনাইটেড হাসপাতালের পাবলিক রিলেশন্স ম্যানেজার আরিফুল হক।
অন্যদিকে, এ ধরনের ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে, তার জন্য ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নবনিযুক্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
আগেই মারা গিয়েছিল : পরিবার
খতনার জন্য শিশু আয়ান আহমেদকে অজ্ঞান করা হয় গত ৩১ ডিসেম্বর। এরপর জ্ঞান না ফেরায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে স্থানান্তর করা হয় গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে।
সেখানে আট দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকার পর ৭ জানুয়ারি রাতে আয়ানকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
পরিবারের ধারণা, শিশুটি আগেই মারা গিয়েছিল। ‘পরিকল্পিতভাবেই’ ওই খবর চেপে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছে তারা।
শামীম আহমেদ বলেন, ‘সেদিন নির্বাচন ছিল। মিডিয়া ওইটা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তারা এই সুযোগটাই নিছে বলে আমাদের ধারণা।’
যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, শামীম আহমেদের দাবিটি সত্য নয়।
ইউনাইটেড হাসপাতালের পাবলিক রিলেশন্স ম্যানেজার আরিফুল হক বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই তাদেরকে বাচ্চার অবস্থার আপডেট দিয়েছি। কয়েক দিন ভেতরে নিয়েও দেখিয়েছি যে বাচ্চার হার্টবিট চলছে।’
এ অবস্থায় আয়ানের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখতে সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতরকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
একই সাথে, আয়ানের পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, সেই প্রশ্নে রুল জারি করা হয়েছে।
অবশ্য শামীম আহমেদ ক্ষতিপূরণ নয়, চাচ্ছেন সুষ্ঠু বিচার।
তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে মারা গেছে। এই ক্ষতি কিভাবে পূরণ করবে তারা? আমার চাওয়া একটাই। এ ধরনের হাসপাতালগুলো বন্ধ হোক। আমার মতো আর যেন কেউ সন্তান না হারায়।’
বিল পরিশোধ ও সমঝোতার চাপ
অজ্ঞান হওয়া থেকে শুরু করে আয়ানকে মৃত ঘোষণা করা পর্যন্ত আট দিনে হাসপাতালের বিল এসেছে ছয় লাখ টাকা। এই টাকা পরিশোধ করার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন শামীম আহমেদ।
এছাড়া সমঝোতার মাধ্যমে মামলা তুলে নেয়ার জন্যও বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমাকে বিভিন্ন মহল থেকে ফোন দেয়া হচ্ছে, অপরিচিত নম্বর থেকে। বলা হচ্ছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে আপনি বসেন এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে আপনি কী চান বলেন। তাও আপনি আইন-আদালতের ভেতরে যাইয়েন। কারণ এগুলো করে কিছু পাবেন না। এসব বলা হচ্ছে।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ইউনাইটেড হাসপাতালের পাবলিক রিলেশন্স ম্যানেজার আরিফুল হক বলেন, ‘এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বাচ্চার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে আসছি। আর এ কারণেই বিল পরিশোধ না করার সত্ত্বেও বাচ্চার লাশ আমরা রিলিজ করে দিয়েছি।’
শিশু মৃত্যুর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বলেও জানান আরিফুল হক।
তিনি বলেন, ‘ঘটনাটা আসলে কী ঘটেছে, সেটাই আমরা বের করার চেষ্টা করছি। সেখানে আমরা কেন সমঝোতার চাপ দেবো?’
নিজেদের কমিটির তদন্তে কারো দোষ প্রমাণিত হলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এত দিন কিভাবে চললো?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশে সোমবার থেকে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
রোববার রাতে এ সংক্রান্ত একটি ই-মেইল বার্তা তারা পেয়েছেন বলে জানিয়েছে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে গিয়েও দেখা গেছে, হাসপাতালের সামনে একটি নোটিশ ঝুঁলছে। সেখানে বলা হচ্ছে, এর সকল কার্যক্রম আপাতত বন্ধ।
ছয়তলা ভবনটির নির্মাণকাজ চলমান আছে। ভবনের চারপাশে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া গণমাধ্যমকর্মীদের সহসাই সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
ঢুকতে হলে অনুমতি নিতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ২০২৩ সালের জুন মাসে হাসপাতালটির নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, অধিদফতরের অনলাইন ডাটাবেজ পর্যালোচনা এবং হাসপাতাল পরিদর্শনকালে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রাদি যাচাই-বাছই করে দেখা গেছে যে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নামে কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিকট নিবন্ধন/লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য কখনই অনলাইন আবেদন করেনি।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, হাসপাতালটি কিভাবে এত দিন তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’
খুরশীদ আলম বলেন, কোনো হাসপাতাল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলেই কেবল তারা সেটি পরিদর্শন করে থাকেন।
তাহলে যারা নিবন্ধন আবেদন না করেই হাসপাতাল চালাচ্ছে, তাদেরকে থামানোর দায়িত্ব আসলে কার?
তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের দায়িত্ব নয়। এটা করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন।’
ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করছে, যথাযথ নিয়ম মেনে মূল প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড নামে নিবন্ধন আবেদন করা হয়েছে।
আরিফুল হক বলেন, ‘আমরা আবেদন করেছিলাম ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড নামে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল। কিন্তু নিবন্ধনের অ্যাপ্লিকেশন করেছিলাম ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড নামে। সেটি আমাদের মাদার কোম্পানি। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এখন বলা হচ্ছে যে এটি ত্রুটিপূর্ণ।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়ে দিয়েছে, মূল কোম্পানির নামে নিবন্ধন নিয়ে অন্য নামে হাসপাতাল চালানো যাবে না।
এমন অবস্থায় নতুন নামে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে হাসপাতালটির কার্যক্রম পুররায় চালু করার কথা ভাবছে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।
সরকার কী বলছে?
তদন্তের মাধ্যমে খুব শিগগিরই শিশু আয়ানের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটন করা হবে বলে বলেছেন নবনিযুক্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
তিনি বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। এমন ঘটনা মোটেও মেনে নেয়া যায় না।’
দোষীদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
নিবন্ধন ও অনুমোদন ছাড়া কিভাবে হাসপাতালটি রোগীদের সেবা দিয়ে আসছিল, সেটা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘নিয়ম-নীতি না মেনে কিভাবে এ ধরনের হাসপাতাল এত দিন চললো, সেটা খতিয়ে দেখা হবে। আমি দেখতে চাই, সমস্যাটা ঠিক কোথায়?’
পাশাপাশি এমন ঘটনা সামনে যেন আর না ঘটে, সেজন্য ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নেয়া হচ্ছে বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে আমরা কঠিন হবো। জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
আগে যা ঘটেছে
৩১ ডিসেম্বর খতনার জন্য শিশু আয়ানকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হয়। অজ্ঞান করে খতনা করার পর আর শিশুটির চেতনা না ফেরায় তাকে গুলশানে অবস্থিত ইউনাইটেড হাসপাতালের পিআইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সেখানেই ৭ জানুয়ারি মারা যায় শিশু আয়ান।
এই ঘটনায় দেশজুড়ে নানা সমালোচনা তৈরি হয়। শিশু সন্তানের এমন মৃত্যুর ঘটনায় আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ বাড্ডা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
ওই মামলায় আসামি করা হয় হাসপাতালের অ্যানেস্থিওলজিস্ট সাইদ সাব্বির আহমেদ, সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক তাসনুভা মাহজাবিন, অজ্ঞাত পরিচয়ের পরিচালকসহ কয়েকজনকে।
এই ঘটনায় গত মঙ্গলবার হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ। এতে শিশু আয়ানের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা চেয়েছিলেন ওই আইনজীবী।
ওই চিকিৎসককে গ্রেফতারসহ ছয়দফা দাবিতে গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের সামনে মানববন্ধন করে আয়ানের স্বজন ও এলাকার বাসিন্দারা।
অন্যদিকে, আয়ানের মৃত্যু নিয়ে ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী।
আয়ানের মৃত্যুর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করে কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয় সেখানে। পরে আয়ানের বাবা শামীম আহমেদও রিটে আবেদনে পক্ষভুক্ত হন।
একইসাথে, হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল এবং নতুন রোগী ভর্তি না করার নির্দেশনা চেয়ে একটি সম্পূরক আবেদন করে রিট আবেদনকারীপক্ষ।
সোমবার প্রাথমিক শুনানি শেষে রুল জারির পাশাপাশি সারাদেশে অনুমোদনহীন কতগুলো হাসপাতাল রয়েছে, সেই তালিকা এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
সূত্র : বিবিসি