২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হঠাৎ কেন বাড়ল লোডশেডিং

হঠাৎ কেন বাড়ল লোডশেডিং - ছবি : সংগৃহীত

হঠাৎ করেই বিদ্যুতের লোডশেডিং ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে৷ কেন বিদ্যুতের এত ঘাটতি দেখা দিলো? বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কেন চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না?

সরকার থেকে জ্বালানি সংকট, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর অধিক নির্ভরতা, লোডশেডিংয়ে রেশনিংয়ে সমন্বয়হীনতার কারণে পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে৷

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি এম এ হাতেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ এর ফলে আমরা সঠিক সময়ে শিপমেন্ট করতে পারছি না৷ যার প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের টাকাও দেওয়া যাচ্ছে না সঠিক সময়ে৷ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনেও এর প্রভাব পড়ছে৷ সবকিছু মিলিয়ে শিল্প উদ্যোক্তারা খুবই কঠিন সময় পার করছেন৷'

বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বলানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু৷ সোমবার দেয়া পোস্টে তিনি বলেছেন, 'গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে৷ এতে অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে৷ গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে৷ যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্য সব দেশের মতো আমাদেরও সমস্যায় ফেলেছে৷ এ পরিস্থিতিতে আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি৷'

হঠাৎ করেই কেন এই সঙ্কট? জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে৷ তাছাড়া দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ অনেক কম৷ এর বাইরে আরও কয়েকটি কারণ আছে৷ সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, সেই কাজ চলছে৷ ভারত থেকে ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসত, ওদের ওই কেন্দ্রটির সমস্যা হয়েছে ফলে সেটাও আসছে না৷ তবে কয়েকটি কেন্দ্রের সংস্কার শেষ হয়েছে আজ (মঙ্গলবার) থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে বলে আমরা আশা করছি৷'

বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে৷ আর আমাদের যতগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে তার সব মিলিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট৷ ফলে সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে একসাথে উৎপাদনে যেতে হয় না৷ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বলছে, গত রোববার দেড় হাজার এবং সোমবার এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে৷ কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশজুড়ে বিদ্যুতের লোডশেডিং যেভাবে শুরু হয়েছে, তাতে ঘাটতির পরিমাণ আড়াই হাজার মেগাওয়াটের কম হবে না৷

জ্বালানি সঙ্কটের শিগগিরই কোনো সমাধান হওয়ার পূর্বাভাস সরকারি তরফ থেকেও দিতে পারছে না৷ ফলে বিদ্যুতের আসা যাওয়া বা লোডশেডিংও শিগগিরই কমবে এমন কোনো আশ্বাসও নেই৷ ঈদের ছুটিকালীন সময়ে শিল্প ও বাণিজ্যিকে চাহিদা কমলেও আবাসিকে চাহিদা বাড়বে৷ এর ফলে এখনকার সময়ের চেয়ে ঈদের সময়ে আবাসিকে লোডশেডিং কিছুটা কমবে৷ তবে উৎস জ্বালানির পর্যাপ্ত জোগান না থাকায় চাহিদানুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমাধান চলতি জুলাই মাসে হবে না৷ ফলে জুলাই মাসজুড়ে বিদ্যুতের কমবেশি আসা-যাওয়া থাকবে৷ সার্বিকভাবে লোডশেডিং যেন তীব্র হয়ে না উঠে সেজন্য শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহারে রেশনিং করতে অর্থাৎ দিনের নির্ধারিত সময়ে ব্যবহার না করতে অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা দিয়েছে বিতরণ সংস্থা ও কোম্পানিগুলো৷ এর আগে গত রমজানে শিল্প-কারখানাগুলোতে প্রতিদিন ৪ ঘন্টা গ্যাস সরবরাহ-ব্যবহার বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দিয়েছিল পেট্রোবাংলা৷

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি প্রকৌশলী শামসুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'বিশ্ব বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বেড়েছে সত্যি৷ কিন্তু তারা যে ঘাটতির কথা বলছেন, তার সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে না৷ গ্রামে তো এখন বিদ্যুৎ কখনও কখনও আসছে৷ শহরেও লোডশেডিং হচ্ছে কয়েক ঘন্টা৷ মাত্র দেড় হাজার মেগাওয়াট যদি ঘাটতি হয় তাহলে ৬০০ উপজেলার মধ্যে রেশনিং করা হলে প্রতি উপজেলায় মাত্র আড়াই মেগাওয়াট করে ঘাটতি হওয়া কথা৷ এতে একটি উপজেলায় মাত্র দুই থেকে তিন ঘন্টা লোডশেডিং হওয়ার কথা৷ কিন্তু হচ্ছে তো তার চেয়ে অনেক বেশি৷ আসলে সরকার বিতরণ ও রেশনিং ব্যবস্থা ঠিকভাবে করতে পারলে মানুষের এত দুর্ভোগ হওয়ার কথা না৷'

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দেশে দৈনিক ৪১০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে৷ স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে এ গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু হয় ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে৷ ব্যয়বহুল এ জ্বালানির দাম বিশ্ববাজারে আরও বেড়েছে৷ বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৩৮ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে৷ সর্বশেষ কেনা হয়েছিল ২৫ ডলারে৷ ফলে দেশে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি ও ব্যবহারের সক্ষমতা থাকলেও তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ বর্তমানে খোলা বাজার থেকে এলএনজি কেনা স্থগিত রয়েছে৷

সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'সরকার যেটা বলছে সেটা সত্যি৷ কারণ বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও গ্যাসের দাম যেভাবে বেড়েছে সেটা কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে৷ সেটা এখন সরকার চাচ্ছে না৷ ফলে সরকারের তরফ থেকে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে অনুরোধ করা হচ্ছে৷ এভাবেই কিছুদিন পরিস্থিতি সামলাতে চায় সরকার৷ এর কোন বিকল্পও সরকারের হাতে নেই৷'

গ্যাস সঙ্কট ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে ভোগান্তি ও দুর্দশার কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ৷ বিশেষ করে যে সকল বাসায় অসুস্থ রোগী রয়েছে তারা বেশি বিপাকে পড়েছেন৷

মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ব্যাখা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তিনি বলেছেন, বিদ্যুৎ আমরা সবার ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলাম এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সবাই পাচ্ছিল৷ কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে উপকরণগুলো সেগুলোর দাম অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়ে গেছে৷ যেমন ডিজেলের দাম বেড়েছে, তেলের দাম বেড়েছে, এলএনজির দামসহ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে৷ কয়লা এখন প্রায় পাওয়াই যায় না৷ তেল, গ্যাসসহ বিদ্যুৎ তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে গেছে৷ বিশ্বের অনেক দেশেই বিদ্যুতের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে৷ অনেক উন্নত দেশে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে জানিয়ে এমন পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়মুখী হওয়ার আহবান জানান তিনি৷

এদিকে লোডশেডিংয়ের সমালোচনা করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি৷ দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'উন্নয়নের এতো যে ঢাকঢোল বাজানো হলো, তাহলে সারাদেশে লোডশেডিংয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতি কেন? বিদ্যুৎ নিয়ে নানা রঙচঙয়ের কথা বলা হয়েছে৷ জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ১৫২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই এখন অচল৷ ফলে লোডশেডিংয়ের ভয়াবহ ছোবলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ রাজধানীও বিপন্ন হয়ে পড়েছে৷'
সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement