২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘২ তলায় উঠতেই ক্যামিকেল পোড়ার গন্ধ, ৪ তলায় মানুষ পোড়ার গন্ধ’

‘২ তলায় উঠতেই ক্যামিকেল পোড়ার গন্ধ, ৪ তলায় মানুষ পোড়ার গন্ধ’ - ছবি- সংগৃহীত

‘দুই তলায় উঠতেই ক্যামিকেল পোড়ার গন্ধ। চার তলায় মানুষ পোড়ার গন্ধ। পাঁচ-ছয় তলায় কাগজ পোড়ার গন্ধ। আমার হার্ট এই প্রথম এত বিভিন্ন ধরনের বাতাস গ্রহণ করতে ছিল।’ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ তথা সেজান জুস কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপালন করা ফায়ার সার্ভিসের একজন নবীন কর্মকর্তার বর্ণনা এটি।

বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই কারখানায় আগুন লাগার একদিন পর শনিবার সারাদিন ভবনের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কাজ করেছেন তিনি। তালহা বিন জসিম নামের ফায়ার সার্ভিসের ট্রেনিংরত ওই কর্মকর্তা শনিবার রাত ৯টার দিকে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাস দিয়ে নতুন এই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। ভবনের ভেতরের বীভৎস দৃশ্য তুলে ধরেছেন তিনি তার স্ট্যাটাসে। এখানে তার স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-

রাতে জানানো হয়, সকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সজীব ফুড কোম্পানিতে যে আগুন লেগেছে সেখানে যেতে হবে। এ খবরে রাতে ভালো ঘুম হলো না। আমাদের ট্রেনিং এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু বাস্তবকাজের অভিজ্ঞতার জন্য আমরা কয়েকজন অফিসার সেখানে যাচ্ছি। এতদিন তো তাত্ত্বিক আর সাজানো ফায়ার ফাইটিং করেছি। এবার একেবারে ভিন্ন ফায়ার ফাইটিং। মনের মধ্যে একটু উত্তেজনা কাজ করছে।

সকাল ৮টার মধ্যে স্পটে পৌঁছে গেলাম। প্রথমেই আমাদের ব্রিফিং দেয়া হলো। আমাদের দায়িত্ব পাঁচ-ছয় তলার নিভু নিভু করে যে আগুন জ্বলছে তা নির্বাপন। স্টারভেশন পদ্ধতিতে করতে হবে। মানে দাহ্য বস্তুকে আলাদা আলাদা করে তার ওপর পানি দিতে হবে, যাতে স্তুপ করা দাহ্যবস্তুর ভেতরে আগুন না থাকে। যাই হোক, দুই তলায় উঠতেই ক্যামিকেল পোড়ার গন্ধ। চার তলায় মানুষ পোড়ার গন্ধ। পাঁচ-ছয় তলায় কাগজ পোড়ার গন্ধ। আমার হার্ট এই প্রথম এত বিভিন্ন ধরনের বাতাস গ্রহণ করতে ছিল।

পাঁচ তলায় গিয়ে দেখি, ভেজা কাগজের স্তুপ আর সাদা ধোঁয়া বের হচ্ছে। ধোঁয়া মানেই ভেতরে আগুন জ্বলছে। রাতে আগুন নির্বাপন করা হয়েছে। তার ওপর ফায়ার স্যুট পরা। তবুও শরীরে তাপ অনুভব করছি। ভাবলাম শুক্রবার তাহলে এখানে কী ভয়াবহ পরিমাণ তাপ ছিল!

চারদিকে দাহ্যবস্তুর স্তুপ। সবকিছু এলোমেলো। তাপে ছাদের এক জায়গায় ফুটো হয়ে ভেঙে পড়েছে। ছাদের বিভিন্ন জায়গায় রডগুলো বের হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে। সে এক বীভিষিকাময় অবস্থা।

জীবনের এই প্রথম বাস্তব আগুন নির্বাপনের কাজ। পুরো ফ্লোরের তাকিয়ে আমার কেমন একা একা লাগলো। মনে সাহস নিয়ে কাজ শুরু করলাম। কাজ করতে করতে ভেতরে ভেতরে ঘেমে যাচ্ছিলাম। পানি মারার সাথে সাথে ফায়ার হুক দিয়ে দাহ্যবস্তুগুলো আলাদা করতে হচ্ছিল, যা প্রচুর পরিশ্রমের কাজ। তাপ আর পরিশ্রমে ভেতরে ঘেমে ইউনিফর্ম ভিজে গেলো। প্রচুর পানি পিপাসা লাগছিল।

হঠাৎ মনে হলো, আমার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। কপাল আর মাথার দুই পাশের রগগুলো দেখা যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধোঁয়ার মধ্যে থেকে কেমন যেন লাগছে। এ অনুভূতি আমার আগে হয়নি। আমি স্পট থেকে বের হয়ে মুক্ত বাতাসের কাছে আসলাম। ওহ! একটু ভালো লাগছে। দূরের গাছপালা বাড়িঘর দেখছি।

মনে মনে ভাবছি, কাল যে ফায়ার ফাইটাররা সরাসরি আগুন নির্বাপন করেছেন তারা কিভাবে করেছেন! কতটা পরিশ্রমী আর সাহসিক না হলে এ কাজ করা সম্ভব না। পুরো চাকরি জীবনে এ কাজের লিড আমাকে দিতে হবে। সাথে সাথে ভাবছি, কতো কষ্ট না পেয়েই ৫২ জন মানুষ মারা গেলো! দূর দিগন্তে তাকিয়ে থেকে নিজেকে খুব অসহায় লাগলো।

সারাদিন আমরা রোটেশন করে কাজ করলাম। ১৫-২০ মিনিট কাজ করলেই মনে হয় শরীরে একবিন্দু শক্তি নেই। পানি মারা আবার প্রায় হাটু সমান দাহ্যস্তুপের মধ্যে পা তুলে তুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া- এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ভাবছি গতকালই আগুন নেভানো শেষ। বলতে গেলে আমরা ডাবরিজ সরাচ্ছি। আর অন্য কোনো লাশ আছে কি না তা চেক করছি। তাতেই যে অবস্থা। কাল তাহলে কী পরিশ্রম করে এই আগুন নির্বাপন করা হয়েছে।

যাই হোক, বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে আবার ফায়ার ফাইটিং করছি। নিচতলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত ফায়ার স্যুট পরে উঠতেই যে পরিমাণ শক্তি ক্ষয় হয় সেখানে বারবার উঠানামা আবার ফায়ার ফাইটিং করা, আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম নিজের স্ট্যামিনা দেখে। শেষ পর্যন্ত বেলা সাড়ে ৩টার দিকে কাজ শেষ করি।

পুরো সময়টা আমার মাথা ব্যথা ও ঝিম ঝিম করছিল। পুরনো সাংবাদিক বন্ধু, ছোট ভাইদের সাথে দেখা হয়েছে। খুবই ভালো লেগেছিল। যখন গাড়িতে করে ফিরছিলাম আমার মনে হয়েছিল একটা বিছানা পেলে এমন ঘুম দিবো কবে জাগবো আমি তা জানি না।


আরো সংবাদ



premium cement