ধর্মঘটে অচল নৌ যোগাযোগ, জনদুর্ভোগ চরমে
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ২১:০৩, আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:০১
অচল হয়ে পড়েছে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা। এতে নৌ যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। প্রভাব পড়েছে পণ্য পরিবহনেও। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ১১ দফা দাবির ধর্মঘটে বন্ধ রয়েছে নৌযান চলাচল। নৌযান মালিকরা বলেছেন, শ্রমিকদের এ দাবির কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারা স্যাবোটাজ করার জন্য ধর্মঘট ডেকেছে।
শুক্রবার মধ্যরাত থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারাদেশে এ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন। এতে ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের পাশাপাশি চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিসহ ৩৩ নৌপথে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। প্রভাব পড়েছে পণ্য পরিবহনেও। নৌপথে যেসব পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আনা নেয়া করা হয় গতকাল তা বন্ধ ছিল। নৌ শ্রমিকরা বলেছেন, তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্যই ধর্মঘট করছেন তারা। যতদিন তাদের দাবি বাস্তবায়ন না হবে ততোদিন তারা ধর্মঘট অব্যাহত রাখবেন।
শ্রমিক ফেডারেশনের ১১ দফা দাবি : বাল্কহেডসহ সব নৌযান ও নৌপথে চাঁদাবাজি, ডাকাতি বন্ধ করা; ২০১৬ সালে ঘোষিত গেজেট অনুযায়ী নৌযানের সর্বস্তরের শ্রমিকদের বেতন প্রদান; ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস এবং মালিক কর্তৃক খাদ্য ভাতা প্রদান; সব নৌযান শ্রমিকের সমুদ্র ও রাত্রিকালীন ভাতা নির্ধারণ; এনডোর্স, ইনচার্জ, টেকনিক্যাল ভাতা পুনঃনির্ধারণ; কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ; প্রত্যেক নৌশ্রমিককে মালিক কর্তৃক নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ও সার্ভিস বুক প্রদান; নদীর নাব্য রক্ষা ও প্রয়োজনীয় মার্কা, বয়া ও বাতি স্থাপন; মাস্টার/ড্রাইভার পরীক্ষা, সনদ বিতরণ ও সনদ নবায়ন, বেআইনি নৌ চলাচল বন্ধ করা; নৌপরিবহন অধিদফতরে সব ধরনের অনিয়ম ও শ্রমিক হয়রানি বন্ধ এবং নৌযান শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
শনিবার বিকেলে সদরঘাট টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায় টার্মিনাল ফাঁকা। লঞ্চগুলো বুড়িগঙ্গার ওপাড়ে নোঙ্গর করা। শত শত মানুষ অপেক্ষা করছেন টার্মিনালে। এই মানুষগুলো ধর্মঘটের কথা জানতেন না। সিদ্দিকুর রহমান নামের এক যাত্রী জানান, তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে টার্মিনালে এসেছেন। ভোলায় যাওয়ার কথা। কিন্তু টার্মিনালে এসে জানতে পারেন লঞ্চ চলছে না। মিরপুর থেকে তিনি সদরঘাট এসেছেন। এখন আবার মিরপুর ফিরে যেতে হবে। বাসে চড়তে পারেন না তারা। শাওন নামের ঝালকাঠীগামী এক যাত্রী জানালেন, তিনি জানতেন লঞ্চ ধর্মঘট। তারপরও তিনি এসেছেন। হয়তো কোনো লঞ্চ ছাড়বে।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের অফিস সচিব রাকিব হাসান শাওন বলেছেন, শ্রমিকদের নায্য পাওনা আদায়ে এ ধর্মঘট। নৌযান মালিক ও সরকার বারবার আমাদের দাবিগুলো যৌক্তিক বলে মেনে নেন, কিন্তু বাস্তবায়ন করেন না। গত জুলাইয়ে আমরা আন্দোলন শুরু করার পর সরকার ও মালিকদের পক্ষ থেকে আমাদের বলা হলো, দাবি মানা হবে। কিন্তু তারা ওয়াদা ভঙ্গ করেছে, তাই ধর্মঘটে বাধ্য হয়েছি। এবার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।
এদিকে, অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের মালিক নিজাম উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, যেসব দাবিতে ধর্মঘট চলছে তা অযৌক্তিক। তিনি বলেন, এখন চরমমোনাইর মাহফিল চলছে। ছারছিনা শরীফের মাহফিল। এই সময়ে হাজার হাজার মানুষের নৌপথে যাতায়াত। আর শ্রমিকদের নামে এ সময়ে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। নিজাম উদ্দিন বলেন, যারা নৌযান শ্রমিকদের নেতা বলে দাবি করছেন, তাদের কেউই শ্রমিক নন। এরা নিরীহ শ্রমিকদের নেতা সেজে তাদের ওপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে। সাধারণ শ্রমিকদের রুটি রুজিতে হাত দিচ্ছে তারা। তিনি বলেন, জনদুর্ভোগ কমাতে কিভাবে নৌযোগাযোগ সচল রাখা যায় সরকারের সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবীর বলেছেন, নৌযান শ্রমিকদের মূল দাবি তাদের মালিকদের সাথে, আমাদের কাছে যেসব দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নাধীন। এ সময়ে তাদের এই ধর্মঘট উদ্দেশ্যমূলক। সরকার তাদের দাবি পূরণে ৩ মাস সময় দিয়েছে, তা মালিকদের পূরণ করার কথা। তিনি জানান, লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক আছে। তবে অন্যান্য দিনের তুলনা যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী লঞ্চ ২০ শতাংশ কম চলছে।
এ ধর্মঘট অবৈধ : নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট অবৈধ আখ্যায়িত করেছে ছয় দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। শনিবার দুপুরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান সংগঠনের নেতারা। অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোঃ নুরুল হক বলেন, নৌখাতকে ধ্বংস করার জন্য ৫/৬টি শ্রমিক সংগঠন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে যত্রতত্র ধর্মঘট পালন করে দেশ অচল করে দিচ্ছে। এ সংগঠনগুলোর দেশের প্রধান নদী বন্দরে শাখা অফিস আছে এবং এসব অফিসে চাকুরিচ্যুত অথবা বয়সোত্তীর্ণ শ্রমিকেরা ২০-৩০ বছর যাবত বিভিন্ন পদ দখল করে আছে। এ অফিসগুলো মূলতঃ নৌযানকে জিম্মি করে মালিকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আর্থিক সুবিধা আদায় করে। সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে- অবৈধ ধর্মঘট বন্ধ করা; শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে কোনটি সিবিএ তা নির্ধারণ করা; বেতনস্কেল বহির্ভূত মনগড়া বেতন-ভাতা আদায়ের নামে নৌযান আটক বন্ধ করা; চট্টগ্রামে নৌপথে বাল্কহেডের অবৈধ চলাচল বন্ধ করা; মাদার ভেসেল থেকে সিরিয়াল অনুযায়ী পণ্য বহন করা এবং নৌপথে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্য ঠিক রাখা। তারা বলেন, নৌপথের সমস্যা ও নৈরাজ্য বন্ধ না হলে মালিকদের পক্ষে জাহাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে নিরুপায় হয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে মালিক ও শ্রমিক নেতাদের নিয়ে পৃথক বৈঠক করে শ্রম অধিদপ্তর। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠকে কোনো সুরাহা হয়নি। এর আগে গত বুধবার আগাম ঘোষণা ছাড়া নৌযানে কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেছিল বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ ঐক্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন। এতে বুধবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ঢাকা নদী বন্দর থেকে লঞ্চ চলাচল কার্যত বন্ধ ছিল। ওই সময়েও দুর্ভোগে পড়েছিলেন সাধারণ যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা। পরে সরকার দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে তা প্রত্যাহার করা হয়। এর দুই দিন পর ধর্মঘট শুরু করে শ্রমিক ফেডারেশন।
ধর্মঘটে ভোগান্তির বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন অধিপ্তরের (বিআইডবি¬উটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব উল আলম বলেন, কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করায় অনেক নৌযান চলাচল করেনি। এতে যাত্রীদের যেমন ভোগান্তি হয়েছে, তেমনি পণ্য পরিবহনেও সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। গত বুধবার শ্রম অধিদপ্তরে তিন দফায় মালিক ও শ্রমিকদের সাথে বৈঠকে অনেক দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। আমি আশা করি, মানুষের ভোগান্তি অনুধাবন করে এ ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে।
ধর্মঘটের কারণে বেশিরভাগ লঞ্চ থেকে চালকেরা চলে যান জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক মোঃ আলমগীর কবীর বলেন, বেশিরভাগ লঞ্চের মাস্টারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে ওইসব লঞ্চ ছাড়তে পারছেন না মালিকেরা। সদরঘাটে যাত্রীদের আনাগোনাও কম রয়েছে। তবে ধর্মঘটের মধ্যেও বেশ কিছু লঞ্চ চলাচল করেছে। বরিশালের লঞ্চ বন্ধ রয়েছে।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোঃ শাহ আলম। তিনি বলেন, শ্রম অধিদপ্তরের ডাকে আমরা বৈঠকে এসেছি। মালিক পক্ষ শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করে চলে গেছেন। আমাদের সাথে তারা বসবেন না বলে জানিয়েছেন। তারা যদি আমাদের সঙ্গে না বসেন, তাহলে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে কী করে? তিনি বলেন, আমাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক অনেক চুক্তি করেও তারা মানেননি। তাই ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।