চাঁপাই সীমান্তে উত্তেজনা, এক দিনে যা যা হলো
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০৬
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গত কয়েক দিন ধরে চলমান অস্থিরতার মাঝেই শনিবার ফের চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিরণগঞ্জ সীমান্তে দিনভর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সেখানকার প্রশাসন ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছে যে, এ ঘটনায় অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন।
শনিবার (১৮ জানুয়ারি) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উত্তেজনার কারণে কিরণগঞ্জ সীমান্তে এখন থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) এ দিন রাত ৮টার দিকে জানিয়েছে, সেখানের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে।
এই ঘটনার সূত্রপাত কোন দিক থেকে হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে বিজিবি জানিয়েছে যে, এর সূত্রপাত বাংলাদেশের দিক থেকেই। তবে ‘শুরুটা খুব মাইনর’ বলে মন্তব্য করেছেন বিজিবি রাজশাহী সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ইমরান ইবনে রউফ।
তবে স্থানীয় সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান আবার ভিন্ন। তারা বলছেন, ভারতীয়রাই প্রথমে বাংলাদেশীদের ওপর চড়াও হয়েছে এবং ওই উত্তপ্ত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এক প্রকার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
এদিকে, এই ঘটনা প্রসঙ্গে বিএসএফ-এর ভাষ্য, সীমান্তে যে ঘটনাটি আজ ঘটেছে, তা ‘ফসল চুরির অভিযোগের কারণে’ দু’ দেশের কৃষকদের মধ্যকার বাকবিতণ্ডা।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
বাংলাদেশ সময় তখন সন্ধ্যা ৭টার কিছুটা বেশি। মুঠোফোনে বিজিবি রাজশাহী সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ইমরান ইবনে রউফের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তিনি সীমান্তে ব্যস্ত, মাত্র শ’ খানেক লোকবল নিয়ে হাজারো জনতাকে সামলাচ্ছেন।
এর প্রায় ঘণ্টাখানেক পর তার সাথে ফের যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সবটা এখন নিয়ন্ত্রণে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানে বাড়তি বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
অর্থাৎ, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বিজিবির প্রায় নয় ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে।
এই ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে তা জানতে চাইলে বিজিবির এই সেক্টর কমান্ডার বলেন, ‘সকালে সম্ভবত আমাদের কয়েকটা ছেলে গ্রিন লাইনের ওই পাড়ে ঘাস কাটতে গেছিল। ভারতের দাবি হলো, ঘাস কাটার সময় তারা গম ক্ষেত থেকে কিছু গম কাটছে।’
এর আগে, ওই এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: আজহার আলীর সাথেও কথা হয়। তিনিও বলেন, ‘যে ফসল কাটা নিয়েই ঘটনার সূত্রপাত হয়।’
এই ঘটনায় বিএসএফ-এর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ বেলা পৌনে ১২টা নাগাদ সুখদেবপুরের ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তে ছোটখাটো বিরোধ হয়। ভারতীয় কৃষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে তারা বলেছে, ‘বাংলাদেশী কৃষকরা ভারতীয়দের ফসল ‘চুরি করছেন।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘এরপর দু’ পক্ষের কৃষকরা জড়ো হলে ঘটনাটি গুরুতর হয়ে ওঠে, তারা একে অপরের প্রতি গালমন্দ করেন এবং পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করেন।’
‘ফসল চুরির’ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্বন্ধে বিএসএফ তাদের বিবৃতিতে কিছু উল্লেখ করেনি।
কিন্তু বিজিবি ও ইউএনও নিশ্চিত করেছে যে, ফসল কাটা নিয়ে বিবাদের জের ধরে ভারতীয় কৃষকরা বাংলাদেশের আম গাছ কাটার চেষ্টা করেছে।
সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ইমরান ইবনে রউফ বরলন, ‘তবে আম গাছ কাটতে পারে নাই। একটা বোধহয় কাটা দেখা গেছে। বাকিসব ডাল-পালা কাটছে। তার ফলশ্রুতিতে যেটা হয়েছে, এইখানেও পাঁচ হাজার, ওইখানেও পাঁচ হাজার। পাঁচ হাজারের বদলে সাত হাজারো হতে পারে। এরপর দু’ পক্ষের মাঝে ঢিল মারামারি হইছে।’
দ্বিমত স্থানীয়দের
স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফসল কাটার কথা বললেও ওই এলাকার স্থানীয় সাংবাদিক মো: কাওসার আহমেদ বলেন, ‘ওরা মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে যে ওদের গম নাকি কেটে দিয়েছিল বাংলাদেশীরা। কিন্তু আদৌ গম কাটেনি।’
তার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে ওই এলাকায় চলা উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশকে কেন্দ্র করে ভারতীয় কৃষকরা গণ্ডগোল করেছে এবং আজ যখন তারা বাংলাদেশীদের গাছ কাটতে এসেছে, তখন বাংলাদেশ অংশে বিজিবির অতিরিক্ত ফোর্স ছিল না।
কাওসার আহমেদ বলেন, ‘ভারতীয়রা প্রথমে সরাসরি এসে আমগাছ, সরিষা ক্ষেত, ভুট্টা, বড়ই গাছ নষ্ট করেছে। তারপরে বিএসএফ নিজেই সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে।’
তিনি জানিয়েছেন, আজ ভারতীয় কৃষকরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করেছে এবং পাথর ছুঁড়ে মেরেছে। বাংলাদেশীরা ক্ষেতের ঢিল ছুঁড়ে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ আবার আত্মরক্ষার্থে দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটাও নিয়ে এসেছে।
সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল কাদের বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় নাগরিকরা যখন ফসল নষ্ট করে, তখন সাথে বিএফএফ ছিল। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ওরা পাথর ছুঁড়ছিল। ককটেল জাতীয় বম্বিং করছিল।’
বাংলাদেশীরা সেখানে মাইকিং শুনে গেছেন, বলছিলেন তিনি।
বিএসএফ যে শক্ত হাতে ঘটনাটি দমন করেনি, সে বিষয়ে একমত পোষণ করেন ইমরান ইবনে রউফ। তিনি বলেন, ‘বিএসএফ ম্যানেজমেন্টে একটা ভুল করছে।’
তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘যখন কৃষকরা গাছ কাটার চেষ্টা করছে এবং আমাদের অনেক লোক সেখানে জড়ো হইছে, তারা তাদের কাঁটাতারের গেটটা খুলে দিছিল তখন। এটা করার কথা না। ওরা খুলতে পারে, এটা কোনো ভায়োলেশন না। কিন্তু সাধারণত ওরা সকালে একবার আর বিকেলে একবার খুলে। বাকি সময় বন্ধ রাখে। আজকে ওরা খুলে দিছিল ওই সময়।’
ওপার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড বা টিয়ারশেলের ব্যবহার করা হয়েছিল কি না জিজ্ঞেস করলে এ সেক্টর কমান্ডার বলেন, ‘যখন দেখল, (দু’ পক্ষই) গ্রিন লাইনের মাঝে মুখোমুখি অবস্থানে চলে এলো, তখন বিএসএফ তাদের নাগরিকদের দিকে সাউন্ড গ্রেনেড মেরেছে, সরানোর জন্য। বা, দু’দিকেই মারছে। গ্রিনলাইনের ওপরে। টিয়ারশেলও মারছে। আমাদের স্থানীয়রাও ওখানে ছিল। টিয়ারশেল মারার পরে লোকজন সরে গেছে।’
বিএসএফ-ও জানিয়েছে, এই ঘটনার খবর পাওয়ার সাথে সাথে বিএসএফ এবং বিজিবি সদস্যরা ‘উভয় দেশের কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করে’ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পরিস্থিতি কখন নিয়ন্ত্রণে আসে
সকাল সাড়ে ১০টা, মতান্তরে বেলা পৌনে ১২টার দিকে শুরু হওয়া ঘটনার নিয়ন্ত্রণ আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে যায়।
দু’ দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিকেল ৪টার পরে পতাকা বৈঠক করেছে এবং সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় দু’ দেশের বাহিনী দু’ দেশের জনগণকে পেছনে নিয়ে যাবে।
ইমরান ইবনে রউফ বলেন, ‘আমরা যখন বলছি লোকজন সরাইতে, তখন তারা লোকজন ওই পাড়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিছে। ওদের সেই সুবিধা আছে। কাঁটাতারের বেড়া আছে। ওরা কাঁটাতারের দরজা বন্ধ করে দিছে। কিন্তু আমাদের লোকজনকে আনতে আমাদের সময় লাগছে। কারণ আমাদের লোকজন সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রিন লাইনের ওইখানে ছিল।’
এই ঘটনা যখন শুরু হয়, তখনকার সম্ভাব্যতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যখন ডালপালা কাটতে আসছে, তখন বাধা দেয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল কি না আমি জানি না। তবে তারা চেষ্টা করে নাই। সেটি সত্য। চেষ্টা করলে করতে পারতো। বরং, তারা উল্টো গেট খুলে দিছে।’
তবে বিএসএফ বলেছে, ‘অঞ্চলটি বিস্তীর্ণ ও বেড়াহীন হওয়ার কারণে ভারতীয় কৃষকরা সীমান্ত অতিক্রমে কোনো বাধার সম্মুখীন হননি।’
তিনি আরো বলেন, ‘শুরুটা খুব মাইনর। কারণ ওদের ভেতরে নিয়মিত আমাদের লোকজন ঘাস কাটতে যায়। এখন আট ইঞ্চির মতো গমের ক্ষেত আছে। ওটা তো দেখতে ঘাসের মতোই।’
এখানে যে এলাকার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে মূলত দু’ দেশের কৃষকই কাজ করে।
এই ঘটনায় কয়েকজন বাংলাদেশী আহত হয়েছেন। তবে ভারতে কেউ আহত হয়েছে বলে জানা যায়নি বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে বিএসএফ।
গত কয়েক দিন ধরে সেখানে যা যা হচ্ছে
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি অংশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে কয়েক দিন ধরে একরকম টানাপোড়েন বা উত্তেজনার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলা সংলগ্ন সীমান্তের ভারতের দিকের অংশে বেড়া নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশ অংশ থেকে গত ছয়ই জানুয়ারি বাধা দেয়া হয়েছে।
সেদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তের বাংলাদেশ-ভারত দু’ দিকেই গ্রামের মানুষজন জড়ো হয় সীমান্তরক্ষীদের সাথে।
চৌকা সীমান্তের ১২০০ গজের মতো অংশে কোনো কাঁটাতারের বেড়া ছিল না এবং সেই বেড়া তৈরির পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে ১০০ গজ ভেতরে মাটি খোঁড়া হচ্ছিল বলে জানিয়েছিলেন ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া।
তখন বিজিবি থেকে এ নিয়ে বাধা দেয়া হয় এবং সাময়িকভাবে কাজ থামানো হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, সীমান্ত লাইন থেকে দেড় শ’ গজের মধ্যে কিছু করা হলে সেটা অপর পাশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সঠিক নিয়ম মেনে অবহিত করতে হয়, যেটা এক্ষেত্রে ভারতের বিএসএফ বাংলাদেশের বিজিবিকে জানায়নি বলে জানান লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিবরিয়া।
সে দিন দু’ দেশের বাহিনীর পতাকা-বৈঠক হলেও পর দিন আবারো নির্মাণকাজ শুরু হয়। সে দিনও দু’ পক্ষের বৈঠক হয় এবং তার পর দিন আবারো একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা