১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪ মাঘ ১৪৩১, ১৭ রজব ১৪৪৬
`

সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় কাচের বোতল কেন ঝুলিয়েছে বিএসএফ?

সীমান্তের শূন্যরেখায় এক-সারি কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে বিএসএফ, সেখানে ঝোলানো কাচের বোতল - ছবি : বিবিসি

ভারত আর বাংলাদেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার বেশ কয়েকটি জায়গায় দেখা যাচ্ছে কাচের বোতল ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের স্থানীয় গ্রামবাসী এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বলছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরাই ওই কাচের বোতল ঝুলিয়ে দিয়ে গেছেন। তবে ওই খালি বোতল কেন ঝুলিয়েছে বিএসএফ তা নিয়ে আতঙ্কে স্থানীয়রা।

শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) বিবিসি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম সীমান্ত থেকে পাওয়া কিছু ছবিতে ছিল মদের খালি বোতল।

স্থানীয়রা বলেন, ‘ওই খালি বোতলে কী না কী রেখে দিয়েছে বিএসএফ! তারা আতঙ্কে আছেন এই বোতল ঝোলানোর ঘটনায়।’

স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, বুধবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুর নাগাদ ভারতের কোচবিহার জেলার বিএসএফ শিবির থেকে কয়েকজন সীমান্তরক্ষী কাঁটাতারের বেড়ায় ওই খালি কাচের বোতলগুলো ঝুলিয়ে দিয়ে যায়।

কেন কাঁটাতারের বেড়ায় বোতল?

শুধু যে পাটগ্রাম সীমান্তে নতুন করে দেয়া কাঁটাতারের বেড়ায় খালি বোতল রয়েছে, তা নয়। বিএসএফ কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক সীমান্ত বেড়াতেই কাচের বোতল ঝোলানো থাকে।

দক্ষিণবঙ্গে পেট্রাপোল সীমান্ত চেকপোস্টের কাছেই এক জায়গায় বিএসএফ যেখানে এক-সারির বেড়া বা সিঙ্গল রো ফেন্সিং দিয়ে রেখেছে, সেখানে গিয়েও খালি কাচের বোতল দেখা গেছে।

নাম উল্লেখ না করার শর্তে এক বিএসএফ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘কেউ বেড়া কাটতে চাইলে অথবা নাড়াচাড়া দিলে কাচের বোতলে শব্দ হবে বা সেটি পড়ে গিয়ে ভেঙে যাবে। সেই শব্দে কাছাকাছি থাকা বিএসএফ প্রহরী সজাগ হয়ে যেতে পারবেন-সেজন্যই এরকম একটা ব্যবস্থা। দিনের বেলার থেকেও রাতের অন্ধকারে প্রহরীদের সজাগ করার জন্য বেশ কার্যকর এটা।’

তিনি বলেন, ‘এটা পাকাপাকি ব্যবস্থা নয় কখনোই। স্থানীয়ভাবে এরকম নানা ব্যবস্থা করে নিতে হয় সীমান্তে-যেখানে যেরকম প্রয়োজন, সেখানে সেরকম ব্যবস্থা করতে হয়।’

৫১ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সেলিম আলদীনকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে যে, ‘এটি নতুন কোনো স্থাপনা নয়। বেড়াটির সুরক্ষার জন্যই তারা বোতল ঝুলিয়েছে। যদি কেউ রাতের আঁধারে বেড়া তুলে নিয়ে যায় সে জন্য তারা (বিএসএফ) শূন্যরেখায় বেড়া দিয়ে নিজেরাই দুশ্চিন্তায় আছে। এজন্য তারা এই প্রটেকশনটি ব্যবহার করেছে।’

এক-সারির বেড়া ও ত্রিস্তরীয় বেড়া

লালমনিরহাটের দহগ্রাম এবং তিনবিঘা করিডোরের কাছে সীমান্তের জিরো লাইনে যে বেড়া দেয়া হয়েছে, সেটা এক-সারির বেড়া।

এগুলো চিরাচরিতভাবে যে উঁচু লোহার খুঁটিতে তিন স্তরের কাঁটাতার দেয়া বেড়ার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

বিএসএফ বলছে, যেখানে জিরো লাইনের দেড় শ’ গজের মধ্যে কোনো ধরনের নির্মাণকাজ করা সম্ভব নয়, সেসব জায়গাতেই ভারতের অংশে এই সিঙ্গল রো ফেন্সিং বা এক-সারির বেড়া দেয়া হচ্ছে।’

যেকোনো ধরনের কাঁটাতারের বেড়াই চোরাচালানকারীরা কেটে ফেলে অনেক ক্ষেত্রে। তাই এখন নতুন এক ধরনের কাঁটাতার ব্যবহার করা শুরু করছে বিএসএফ, যা কাটা প্রায় অসম্ভব, এমনটাই জানা গেছে বিএসএফ সূত্রে।

আবার অনেক সময়ে দেখা যায় সোনা, রুপো, ফেনসিডিল পাচারের জন্যও সীমান্তের একদিক থেকে প্যাকেট বেড়া টপকিয়ে অন্য দিকে ফেলে দেয়া হয়।

এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যেখানে সীমান্তের ওপরে দিয়ে কপিকলের সাহায্যে গরু একদিক থেকে উঠিয়ে দিয়ে অন্যদিকে নামিয়ে দেয়া হয়।

অবৈধভাবে মানুষ পারাপারের জন্যও ত্রিস্তরীয় বেড়ার ওপর দিয়ে মই লাগিয়ে দিয়ে সেটিকে সেতু হিসাবে ব্যবহার করার কথাও জানা যায়। এক্ষেত্রে কাঁটাতারের বেড়ার দু’দিকে দু’টি এবং বেড়ার ওপর দিয়ে আরেকটি মই ব্যবহার করা হয়।

এই অবৈধ পাচার এবং পারাপার আটকাতে সীমান্তের বেড়ারও অনেক ওপর পর্যন্ত নাইলনের জাল দেয়া হয়েছে, যা টপকানো কোনো মতেই সম্ভব নয় বলছে বিএসএফ।

অত্যাধুনিক নজরদারির ব্যবস্থা

লালমনিরহাটের সীমান্তে কাচের বোতল ঝুলিয়ে সতর্ক করার ব্যবস্থা করেছে বিএসএফ ঠিকই, তবে একইসাথে তারা নানা সীমান্তে ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক নজরদারি ব্যবস্থা।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অরক্ষিত বা ভালনারেবল জায়গা চিহ্নিত করেছে বিএসএফ যেখান দিয়ে সীমান্ত-অপরাধ হচ্ছে। চিহ্নিত জায়গাগুলোতে প্রহরীরা তো থাকবেনই আগের মতো, কিন্তু তার সাথে সমন্বিত একগুচ্ছ অন্য ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।

নতুন সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় এক-সারি কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হবে এবং একইসাথে নজরদারির জন্য একাধিক বৈদ্যুতিক যন্ত্র এবং অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। সাথে প্রহরীদের সতর্ক করার জন্যও কিছু যন্ত্র লাগানো হয়েছে।

সম্প্রতি কয়েকজন সাংবাদিককে সেই সব ব্যবস্থা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল বিএসএফ।

এর মধ্যে একটি এলাকা ছিল যশোরের বিপরীতে, পেট্রাপোল সীমান্ত লাগোয়া এলাকা।

নতুন এই সমন্বিত ব্যবস্থাপনাকে বিএসএফ বলছে, ‘ইলেকট্রনিক সারভেইল্যান্স অ্যাট ভালনারাবেল প্যাচেস (ইএসভিপি) বা ‘অসুরক্ষিত এলাকাগুলোর জন্য বৈদ্যুতিক নজরদারি’ ব্যবস্থা।

বিএসএফের নানা ‘উদ্ভাবন’

পেট্রাপোলের যে মূল সীমান্ত ফটক, তারপাশেই বাংলাদেশ আর ভারতের সীমান্তের মাঝে, ভারতের অংশে রয়েছে একটি কচুরিপানা ভরা খাল।

তার পাড়ে লাগানো হয়েছে সিঙ্গল রো ফেন্সিং বা এক-সারি বেড়া। বাঁশের খুঁটিতে সাধারণ মানুষ যেমন কাঁটাতার বেঁধে বেড়া দেন, এটা অনেকটা সেরকম। তবে এই অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে, স্থানীয় প্রশাসন খুঁটি পুঁতে দিয়ে জায়গা চিহ্নিত করে গেছে।

এবার সিঙ্গল রো ফেন্সিং বসলে সেটা হবে স্থায়ী ব্যবস্থা- সিমেন্ট ঢালাই করে খুঁটি পুঁতে এক-সারির বেড়া দেয়া হবে এই জায়গায়।

এই বেড়ার গায়ে, কিছুটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে দু’ ধরনের অ্যালার্ম ব্যবস্থা।

কাচের বোতল ভেঙে গিয়ে তার শব্দে যেমন বিএসএফ প্রহরীরা সতর্ক হতে পারেন, তেমনই পেট্রাপোলের এই সীমান্তের বেড়ার নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় পা পড়লেই বেজে উঠছে সাইরেন।

বিএসএফের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটার নাম ‘ইন্ট্রুডার অ্যালার্ম’। আরেক ধরনের অ্যালার্ম রয়েছে, যার নাম ‘ট্রিপ ফ্লেয়ার’। কেউ বেড়া ছুঁয়ে ফেললেই তুবড়ির মতো আলো জ্বলে উঠবে, সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে যাবে ওই জায়গাটি।’

এরকম নানা এলাকা অনুযায়ী নানা ধরনের ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছে বিএসএফ।

তিনি বলেন, ‘এছাড়াও বড়বড় আলো এবং অত্যাধুনিক সিসিটিভি ক্যামেরাও রয়েছে সেখানে। এই ক্যামেরাগুলোর ছবি সরাসরি চলে যায় কন্ট্রোল রুমে। তার ওপরে নজর রাখেন একজন অপারেটর।’

ওই কন্ট্রোল রুমের দেওয়ালে বড় বড় মনিটরে ১৪-১৫টি সিসিটিভির ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। সীমান্তের পাশ দিয়ে কোনো মানুষ যেতে দেখলেই মনিটরের ছবিতে লাল বাক্সে তাকে চিহ্নিত করা হয়ে যাচ্ছে। আবার কাঁটাতারের বেড়ার কাছে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে হলুদ রেখা টানা। ওই রেখার কাছে কোনো মানুষকে দেখা গেলেই সতর্ক করবে মনিটরিং সিস্টেম।

এছাড়াও রাতের অন্ধকারে নজরদারির জন্য নাইট ভিশন দূরবীণ এবং থার্মাল ইমেজ ধরা পড়ে, এমন ক্যামেরাও আছে সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায়।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement