০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১, ২ রজব ১৪৪৬
`
প্রধান উপদেষ্টার কাছে তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন

বৈদ্যুতিক লুজ কানেকশন থেকে সচিবালয়ে আগুন

প্রধান উপদেষ্টার হাতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিচ্ছেন কমিটির প্রধান নাসিমুল গনি। - ছবি : নয়া দিগন্ত

নাশকতা নয়, বৈদ্যুতিক লুজ কানেকশন থেকে সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত বিস্ফোরক নাশকতার তথ্য মেলেনি। গুরুত্বপূর্ণ নথিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে এখনও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে কাজ চলছে। আর চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা আলামত সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া পাঠানো হচ্ছে।

মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে অগ্নিকাণ্ডের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে অগ্নিকাণ্ড রোধে প্রয়োজনীয় করণীয় নির্ধারণের সুপারিশ আগামী ১০ দিনের মধ্যে জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবনে কোনো ধরনের ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেম না থাকায় প্রাথমিক ও বিকশিত অবস্থায় আগুন শনাক্ত করা যায়নি। সচিবালয়ের অভ্যন্তরে ৩টি আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভারের মজুদ পানি পর্যাপ্ত না হওয়ায় দূরবর্তী স্থান ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তন ও গেটের বাইরে বিশেষ পানিবাহী গাড়ি হতে অনেক হোসপাইপ লে-আউট-এর মাধ্যমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়েছে। এ ছাড়া ওয়াসা কর্তৃকও পানি সরবরাহ করা হয়েছে।

এ ছাড়া, বৈদ্যুতিক গোলযোগের বিষয়টির সাথে অন্য কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের ব্রিফ করেছেন কমিটির সদস্যরা। তদন্ত কমিটির প্রধান ও স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি, বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত মাকসুদ হেলালী, সেনাবাহিনীর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রাসেল, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন। এ সময়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড রোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করেছে কমিটি।

উল্লেখ্য, গত ২৫ ডিসেম্বর মধ্য রাতে সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে গুরুত্বপূর্ণ ৭ নম্বর ভবনের ৬ তলা থেকে ৯ তলা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরের দিন ২৬ ডিসেম্বর দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার দফতরের উদ্যোগে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা জরুরি সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক, সশস্ত্র বাহিনীর একজন ফায়ার বিশেষজ্ঞ এবং তিনজন বুয়েটের বিশেষজ্ঞ নিয়ে কমিটি গঠন হয়েছে। ওই কমিটি গতকাল প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছে।

মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি বলেন, তদন্ত কমিটির সবাই একমত হয়েছে, লুজ কালেকশনের কারণে বৈদ্যুতিক লাইন থেকে আগুনের উৎপত্তি। এটি প্রাথমিক তদন্তের ফল। এখানে এখন পর্যন্ত অন্য কোনো ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।

বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাকসুদ হেলালী বলেন, আগুনের সূত্রপাত রাত ১টা ৩২ থেকে ১টা ৩৯ মিনিটে। অর্থাৎ এই আগুনের উৎপত্তি একটি নির্দিষ্ট সময় নয়। যেখানে আগুন লেগেছে, সেখানে ৭ মিনিট ধরে আস্তে আস্তে গরম হয়েছে। প্রথম দিকে সেখানে স্ফুলিঙ্গ (ফুলকি) পড়েছে। এক সময় ভীষণ তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়েছে। এরপর আগুন ধরেছে। এরপর আগুনের চেইন তৈরি হয়েছে। সচিবালয়ের বিল্ডিংয়ের একটি টানেল অ্যাফেক্টের কারণে আগুন পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে বেড়িয়ে গিয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে এই কারণেই আগুন দুই দিকে দেখা গেছে। তিনি বলেন, আগুনের উৎস এই একটাই। এর বাইরে আপাতত কোনো কারণ নেই। তার মতে, বাতাসের গতি ও বিল্ডিংয়ের ভিন্নতার কারণে আগুন দুই দিকে প্রভাবিত হয়েছে।

১২ থেকে ১৪ মিনিটে আগুন সব জায়গায় ছড়িয়ে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। আগুন লাগার দেড় থেকে ২ ঘণ্টা পরে বাইরে থেকে দেখা গেছে। এটা নেভানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে গেছে। টানেল অ্যাফেক্ট এবং আগুন ছড়িয়ে যাওয়ায় নেভানো কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ ছিল। তিনি আরও বলেন ৬ তলায় যখন আগুন লেগেছে, সেটি না নিভিয়ে ৭ তলায় যাওয়ার সুযোগ ছিল না। যে কারণে ফায়ার ব্রিগেডকে ৬ তলা নিভিয়ে ৭ তলায় যেতে হয়েছে। নিরুপায় হয়ে জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ভয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ করতে হয়েছে। এরপর পুলিশের সিআইডি রিপোর্ট ও অন্যান্য ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে আমাদের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ৯৯ শতাংশ মিলে গেছে। মাকছুদ হেলালী বলেন, আমরা নিশ্চিত হয়েছি, আগুন এভাবে সৃষ্টি ও ছড়িয়েছে। প্রাথমিকভাবে আগুন সচিবালয়ের উত্তর দিকে দেখা গেছে। দক্ষিণ দিকে দেখা যায়নি। যেখানে বাইরে থেকে আমরা সচিবালয় দেখি।

আগুন লাগার দেড় থেকে ২ ঘণ্টা পরে বাইরে থেকে আগুন দেখা গেছে। তখন থেকে আগুন দুইটা পয়েন্টে দেখা গেছে। একটা ৬ তলায় এবং একটা ৮ তলায়। তখন বাইরে থেকে মনে হয়েছে, এইটা দুইটা পয়েন্ট আলাদা এবং অনেক দূরে। কিন্তু বাস্তবে ভেতরে ইন্টারনালি কানেকটেড ছিল (ভেতর থেকে দুই আগুনের সংযোগ ছিল)। যা বাইরে থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রাসেল বলেন, আমরা তিনটা জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করি। ফায়ার সার্ভিস একটা নমুনা দিয়েছে যে কোনো ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করে এখানে আগুন লাগানো হয়েছে কি-না এটা যাচাই করেছি। এই নমুনাগুলো সংগ্রহ করে সেনাবাহিনীর একটি উচ্চমানের বিস্ফোরক ল্যাব রয়েছে। সেখানে উচ্চমানের বিস্ফোরক ডিটেক্টর রয়েছে। আমরা নমুনা পরীক্ষা করে বিস্ফোরক ব্যবহারের প্রমাণ পাইনি। ফায়ার সার্ভিসের যে নমুনা তাতেও কোনো বিস্ফোরকের ব্যবহার মেলেনি। এরপর আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদের সংশ্লিষ্ট ডগ স্কোয়াড ব্যবহার করেছি। এই স্কোয়াড গন্ধ শুঁকে বিস্ফোরক চিহ্নিত করতে পারে। তাতেও কোনো ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহারের আলামত মেলেনি।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, আমাদের প্রথম যে তিনটা দল অগ্নিকাণ্ড নির্বাপনে যুক্ত হয়, তখন আগুন পুরো বিকশিত অবস্থায় ছিল। আমাদের টিম যখন সিঁড়িতে পৌঁছায় তখন আগুন ছড়িয়ে যাওয়ায় তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশি। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের ইউনিটগুলো এসেছে। দক্ষিণ দিক থেকে দুটি গাড়ি সচিবালয়ের সামনে স্থাপন করতে সমর্থ হই। এর মধ্যে আমাদের অগ্নিনির্বাপক দল গতানুগতিক পদ্ধতিতে আগুন নেভানোর কাজে সক্রিয় ছিল। প্রতিটি ফ্লোরে চারটি করে কলাপসিবল গেট ছিল। তাপামাত্রাও অত্যন্ত বেশি ছিল। এটা কেটে উঠতে সময় লেগেছে। এ ছাড়া করিডরের মধ্যে ছিল টানেল গেট। বের হওয়ার জায়গা না থাকায় তাপমাত্রা এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখানে যেহেতু ইন্টেরিয়র ডিজাইন ছিল। ফলে প্রচুর পরিমাণ বৈদ্যুতিক তারের সমাবেশসহ অনেক দাহ্যবস্তু মিলেছে। এগুলো আগুন ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা করেছে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনের সঙ্গে রুমের পার্টিশন পাশাপাশি কাগজপত্রের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। আগুনের ডিটেক্টর সিস্টেম এবং কন্ট্রোল প্যানেলে ঘাটতি ছিল। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে। সচিবালয়ে ৩টা ওয়াটার রিজার্ভারে যে পানি মজুদ ছিল তা দিয়ে এত বড় আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। সে জন্য ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তন থেকেও পানি আনা হয়। সে সময় আমাদের একজন ফায়ার ফাইটার নিহত হন। তিনি বলেন, সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ১১টা ৪৫ মিনিটে আমাদের কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করি।

আগুনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, ক্রাইম সিনের কারণে ভেতরে প্রবেশ সংরক্ষিত থাকায় পুরো ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। ওখানে ৬টি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তাদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করতে বলা হয়েছে। গণপূর্তের একটি টিমও কাজ করছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এটি উল্লেখ করা হবে।

লুজ কানেকশনে কে দায়ী- এমন প্রশ্নের উত্তরে মাকসুদ হেলালী বলেন, বেশ কিছু কারণ রয়েছে। বৈদ্যুতিক সকেটসহ আমরা যখন বিভিন্ন যন্ত্রাংশ স্থাপন করি-এগুলো বিভিন্ন দামের রয়েছে। কম দামি উপকরণ হলে গুণগত মান নিশ্চিত করা যায় না। এ ছাড়া বারবার ব্যবহারের কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও এগুলো পরিবর্তন করা হয় না। নিয়মানুযায়ী তারের জোড়া হওয়া উচিত জংশন টু জংশন; কিন্তু আমরা একটা তারের মাঝখান থেকে কেটে জোড়া দেই। এটা অনিয়ম কিন্তু করে অভ্যস্ত। আইনে আছে, প্রতি বছর বৈদ্যুতিক লাইনগুলো চেক করা দরকার, এটা দশ বছরেও করি না। এভাবেই লুজ কানেকশন তৈরি হয়।

শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ১ ঘণ্টা ধৈর্য ধরে এই রিপোর্টটি শুনেছেন এবং তিনি পূর্ণ সুপারিশ জমা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement
সীমান্তের ওপার থেকে যেকোনো আগ্রাসনের কড়া জবাব দেয়া হবে : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সিলেটে ট্রাকচাপায় কিশোর নিহত ভেনেজুয়েলা নির্বাসিত বিরোধী প্রার্থীকে ধরতে ১ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা জামায়াত সবাইকে সাথে নিয়ে ইনসাফভিত্তিক দেশ গড়তে চায় : এস এম লুৎফুর রহমান শেখ হাসিনাকে নিয়ে ‘হাটে হাঁড়ি’ ভাঙলেন সোহেল তাজ সিলেটে ছাত্র-জনতার উপর হামলায় সাবেক মেয়রসহ ৬৩ জনের নামে মামলা সিরিয়ায় পৌঁছেছেন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পথে জার্মান বেয়ারবক যশোরে আজহারীর মাহফিলে মানুষের ঢল ডেঙ্গুতে আরো একটি মুত্যুশূন্য দিন, হাসপাতালে ২৩ কুয়াশায় দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব নির্দেশনা দিলো রেলওয়ে ড. মাসুদের অনুরোধে পটুয়াখালীর মাহফিলে থাকবেন আজহারী

সকল