সেন্ট মার্টিন রক্ষা ও পর্যটন নিয়ন্ত্রণে ৬ সদস্যের কমিটি
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২০ নভেম্বর ২০২৪, ২০:২১
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে পর্যটন নিয়ন্ত্রণে ৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে সরকার। একইসাথে কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিনগামী জাহাজ ছাড়ার পয়েন্ট নির্ধারণে একটি গাইডলাইনও দেয়া হয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সাবরীনা রহমান স্বাক্ষরিত পৃথক অফিস আদেশে কমিটি গঠন ও বিভিন্ন গাইডলাইন উল্লেখ করে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গতকাল মঙ্গলবার দেয়া এক অফিস আদেশে গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন- টেকনাফ ও কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), পরিবেশ অধিদফতর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক এবং ট্যুরিস্ট পুলিশ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় অথবা ট্যুরিজম বোর্ড, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও কোস্টগার্ডের একজন করে প্রতিনিধি।
চিঠিতে কমিটির কর্মপরিধি হিসেবে বলা হয়েছে, পর্যটক এবং অনুমোদিত জাহাজ কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যাগ এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক দ্রব্যাদি পরিবহন না করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটকগণ কোনো হোটেলে অবস্থান করবে তার রেজিস্টার সংরক্ষণ করতে হবে। জাহাজ ছাড়ার এন্ট্রি পয়েন্টে শুধু বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড কর্তৃক প্রস্তুতকৃত অ্যাপস থেকে সংগ্রহকৃত ট্রাভেল পাসধারী পর্যটকদের অনুমোদিত জাহাজে ভ্রমণ নিশ্চিত করতে হবে। জাহাজ ছাড়ার পয়েন্টে এবং সেন্ট মার্টিনে এন্ট্রি পয়েন্টে পর্যটকদের জন্য করণীয় ও বর্জণীয় বিষয়ে বিলবোর্ড স্থাপন করতে হবে।
অফিস আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সাবরীনা রহমান বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষার জন্য সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছে।
জানা যায়, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন বর্তমানে হৃমকির মুখে পড়েছে। গত দুই যুগে এসব হুমকি তৈরি হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরোনো দ্বীপটির মাটি, পানি ও বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠছে। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকের কারণে সৃষ্ট এসব বিপদের ফলে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় দ্বীপের তাপমাত্রা কমপক্ষে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকছে।
গত ১৫ এপ্রিল এনভায়রেনমেন্টাল অ্যাডভান্স নামের একটি বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, পর্যটনের কারণে উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন উজাড়, দূষণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, কচ্ছপের আবাস ধ্বংস, প্লাস্টিকের ব্যবহার, মিঠাপানির সঙ্কট, জোয়ারে সমুদ্রভাঙনসহ নানা বিপদ দেখা দেছে। দ্বীপে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ১০ হাজার থাকলেও সারা বছর সেখানে কয়েক লাখ পর্যটক অবস্থান করে।
বিশেষজ্ঞরাও সেন্ট মার্টিনের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অপরিকল্পিত পর্যটনকে দায়ী করছেন। তাদের মতে, মৌসুমি পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত আচরণ ও পরিবেশ বিধ্বংসী বিনোদনের ফলে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। গত এক যুগে দ্বীপটি রক্ষায় সরকার তিন দফায় পর্যটন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু পর্যটন ব্যবসায়ীদের চাপে ওই অবস্থান থেকে সরে আসে সরকার।
সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সর্বশেষ ২০২০ সালের আগস্টে সেখানে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সরকারের তরফে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসকে (সিইজিআইএস) একটি সমীক্ষা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা শেষে জানায়, দ্বীপটিতে কোনোভাবেই পর্যটকদের রাতে থাকার অনুমতি দেয়া ঠিক হবে না। শীতকালে পর্যটন মৌসুমে দিনে ১ হাজার ২৫০ জনের বেশি পর্যটক যেতে দেয়া ঠিক হবে না।
পরিবেশ অধিদফতর জানায়, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদফতর ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, সেন্ট মার্টিন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সেন্ট মার্টিন নিয়ে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে। বিশ্বজুড়ে বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কাছিম, চার প্রজাতির ডলফিন, বিপন্ন প্রজাতির পাখিসহ নানা বন্য প্রাণীর বাস এই দ্বীপে। এসব প্রাণীও দ্বীপটি ছেড়ে চলে যাবে।
এসব বিষয় মাথায় রেখে ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদফতর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে সেন্ট মার্টিনের সৈকতে আলো জ্বালিয়ে বারবিকিউ, দোকানপাটে বেচাকেনা, সৈকতের পাথর সংগ্রহ এবং মোটরসাইকেলসহ যেকোনো ধরনের যানবাহনে চলাচল নিষিদ্ধসহ ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করে। কিন্তু গণবিজ্ঞপ্তি কার্যকর কিংবা তদারক করা হয়নি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেস্টা করা হচ্ছে। মার্কিন ঘাঁটি নির্মানসহ নানা ধরনের কাল্পনিক প্রচারণা শুরু হয়েছে।
সর্বশেষ গত অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় সেন্ট মার্টিনে চার মাস পর্যটকদের যাতায়াত ও অবস্থান সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বরে পর্যটকেরা যেতে পারলেও রাতে থাকতে পারবেন না। আর ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে গিয়ে রাতে থাকতে পারবেন। তবে ওই সময় দিনে দুই হাজারের বেশি পর্যটক যেতে পারবেন না। আর ফেব্রুয়ারিতে কোনো পর্যটক সেখানে যেতে পারবে না।
সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছে ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পরিবেশ ও পর্যটন উন্নয়ন জোট’ নামের একটি সংগঠন। জোটের নেতৃত্বে থাকা অনেকের সেন্ট মার্টিনে আবাসিক হোটেল রয়েছে। এসব হোটেল প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা দ্বীপটি বাঁচাতে চাই। এটি সবার সম্পদ। পর্যটকরা দায়িত্বশীল আচরণ করলে দেশের ওই সম্পদ রক্ষা পাবে।’
সূত্র : বাসস