২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গুগল ডুডলে কে এই শেখ দীন মুহাম্মদ

দীন মুহাম্মদকে নিয়ে গুগজ ডুডল(বামে) ও দীন মুহাম্মদ - ছবি : সংগ্রহ

গুগল সার্চ পেজ খুলতেই ভেসে উঠেছিল কিছু লতাপাতা। কয়েক রকমের মশলা আর একটি বোতলের ছবি। বোতলের মাঝখানে এক ব্যক্তির মুখের ছবি। এটাই ছিল মঙ্গলবারের গুগল ডুডল। ডুডলে মাউস ছোঁয়াতেই লেখা এলো 'Celebrating Sake Dean Mahomed'।

তারপরেই মানুষ খুঁজতে শুরু করলেন লোকটি সম্পর্কে তথ্য। দিনের শেষে গুগল ট্রেন্ডিংয়ের হিসাব দেখাচ্ছে যে সারাদিনে ওই নামটিই ছিল ভারতে সবচেয়ে বেশী গুগল করা বিষয়। এক কোটিরও বেশী মানুষ এই নামটি সার্চ করেছেন মঙ্গলবার, কেবলমাত্র ভারত থেকেই।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগছে কে এই শেখ দীন মুহাম্মদ? গুগল থেকে জানা যায়, শেখ দীন মুহাম্মদই প্রথম ভারতীয় লেখক, যিনি ইংরেজি ভাষায় বই লিখে প্রকাশ করেছিলেন। সেই বই প্রকাশকেই সম্মান জানাতে গুগল বানিয়েছিল ওই ডুডল।

বিস্তারিত যা উঠে এলো উইকিপিডিয়া সহ নানা সূত্র থেকে, তা এক বিস্ময়কর মানুষের জীবন কাহিনী। ভারতের বিহার রাজ্যের এক ছোট্ট জনপদের নাপিত পরিবারের ছেলে দীন মুহাম্মদ ভাগ্যচক্রে হয়ে উঠেছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জর্জের ব্যক্তিগত সহচরদের একজন।
উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ১৭৫৯ সালে পাটনা শহরে জন্ম হয়েছিল দীন মুহাম্মদের। বর্তমানের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা সেই সময়ে ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীন। তাঁর পরিবারের আদি বাস ছিল বক্সার জেলায়।

‘পাটনায় থাকলেও দীন মুহাম্মদের সম্বন্ধে যতটা জানা যায় যে তিনি কিন্তু বাঙালী ছিলেন,’ জানাচ্ছিলেন 'কারিলাইফ' পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ বেলাল আহমেদ। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিলেন খুব কম বয়সে। সেখানেই তিনি নানা ধরণের রাসায়নিক দিয়ে ক্ষার আর সাবান তৈরি করতে শেখেন।

বাবার মৃত্যুর পরে মাত্র দশ বছর বয়সে ক্যাপ্টেন গডফ্রে এভান বেকার নামের এক ব্রিটিশ অফিসার দীন মুহাম্মদকে বড় করার দায়িত্ব নেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে চাকরী হয় তাঁর।

লন্ডনে কিভাবে গেলেন?
১৭৭২ সালে ওই ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি যখন ইংল্যান্ডে ফিরে যাচ্ছেন, দীন মুহাম্মদকেও সঙ্গে নেন তিনি। লন্ডনে বেশ কয়েক বছর থাকার পরে ১৭৮৪ সালে ক্যাপ্টেন বেকারের পরিবারের সঙ্গেই দীন মুহাম্মদ আয়ারল্যান্ডে চলে যান। ভাল করে ইংরেজি শেখার জন্য ভর্তি হন একটি স্থানীয় স্কুলে। সেখানেই প্রেমে পড়েন জেন ডেলি নামের এক সম্ভ্রান্ত প্রটেস্ট্যাণ্ট পরিবারের মেয়ের। মেয়েটির পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি, তাই পালিয়ে গিয়ে দু'জনে বিয়ে করেন ১৭৮৬ সালে।

প্রথম কোনও ভারতীয়র লেখা ইংরেজি বই
বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরে, ১৭৯৪ সালে তিনি নিজের ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশ করেন - ‘দা ট্র্যাভেলস অব দীন মুহাম্মদ’। সেটিই ছিল প্রথম কোনও ভারতীয়র লেখা ইংরেজি বই, আর ওই বইয়ের স্মরণেই গুগলের ডুডল। বইয়ের শুরু হয়েছিল চেঙ্গিস খান আর প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরে স্তুতি দিয়ে - তারপরে রয়েছে নানা শহরে নিজের ভ্রমণের কথা, আবার লিপিবদ্ধ করেছেন সেই সময়কার নানা যুদ্ধের বর্ণনাও।

ইংল্যান্ডে প্রথম ভারতীয় রেস্তোঁরার গল্প
১৮১০ সালে লন্ডনে শেখ দীন মুহাম্মদ প্রথম ভারতীয় রেস্তোঁরাটি খোলেন। পোর্টম্যান স্কয়ারের কাছে জর্জ স্ট্রীটে অবস্থিত ওই রেস্তোঁরার নাম ছিল 'হিন্দুস্তানী কফি হাউস' - এমনটাই তথ্য দিচ্ছে উইকিপিডিয়া। তবে ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআই গতবছর একটি খবরে লিখেছিল যে ১৮০৯ সালে পোর্টম্যান স্কয়ারের ওই রেস্তোঁরার নাম ছিল 'হিন্দুস্তানী ডিনার অ্যান্ড হুক্কা স্মোকিং ক্লাব'।

সেই রেস্তোঁরায় আসল ভারতীয় মশলা দিয়ে রান্না হত সম্পূর্ণ দেশীয় রেসিপির নানা পদ। সেই প্রথম ইংল্যান্ডের মানুষ পেয়েছিল ভারতীয় 'কারি'র স্বাদ। সঙ্গে থাকত ভারতীয় পদ্ধতিতে ছিলিমে তামাক ভরে হুকো খাওয়ারও ব্যবস্থা।

সেই সময়ে হোটেল রেস্তোঁরায় মেনুকার্ডের চল ছিল না। কিন্তু এই 'হিন্দোস্তানী' রেস্তোঁরায় হাতে লেখা মেনু থাকত। পদগুলির দাম সহ হাতে লেখা সেই মেনুকার্ড গতবছর লন্ডনের একটি দুষ্প্রাপ্য বইয়ের মেলায় বিক্রি হয়েছে। এনডিটিভির একটি পুরনো প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘ওই দুষ্প্রাপ্য মেনুকার্ডটি বিক্রি হয়েছে ৮৫০০ পাউন্ডে।’

কেমন ছিল তখনকার দিনে ওইসব সুস্বাদু পদের দাম?
ওই হাতে লেখা মেনুকার্ডে দেখা যাচ্ছে ‘মক্কি পোলাও’ বা ভুট্টাদানার পোলাওয়ের দাম ছিল ১.১ পাউন্ড, আনারস পোলাও ১.১৬ পাউন্ড, চিকেন কারি আর লবস্টার করির দাম ০.১২ পাউন্ড। খাবারের সঙ্গে রুটি আর আচারও দেওয়া হতো।
কিন্তু সেই রেস্তোঁরা ব্যবসা বেশিদিন চালাতে পারেননি দীন মুহাম্মদ। দু'বছর পরে দেউলিয়া হয়ে যান তিনি। নতুন মালিক অধিগ্রহণ করে আরও প্রায় বছর কুড়ি চালিয়েছিল সেটি।

রেস্তোঁরাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রায় দুই শতক পরে, ২০০৫ সালে, 'প্রথম ভারতীয় রেস্তোঁরা' স্মরণে সিটি অব ওয়েস্টমিনস্টার ১০২ জর্জ স্ট্রীটে একটি ‘গ্রিন প্লাক’ লাগায়। ওয়েস্টমিনস্টার সিটি কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে অবশ্য রেস্তোঁরার নাম ‘হিন্দুস্তানী কফি হাউস’ই লেখা হয়েছে, আর প্রতিষ্ঠার বছর লেখা রয়েছে ১৮১০ সাল।

‘আসল রেস্তোঁরাটি ছিল ৩৪ নম্বর জর্জ স্ট্রীটে, তার খুব কাছেই লাগানো হয়েছে এই গ্রিন প্লাকটি। বহু মানুষের নজরে পড়ে প্লাকটি - যেখান থেকে ভারতীয় কারি'র ইংল্যান্ড বিজয়টা শুরু হয়েছিল। আজ যে 'ইন্ডিয়ান কারি'র এত কদর বিলেতে, তার শুরুটা ওই দীন মুহাম্মদের হাত ধরেই,’ বলছিলেন কারিলাইফ পত্রিকার সম্পাদক বেলাল আহমেদ।

দীন মুহাম্মদের রেস্তোঁরার যে রন্ধনশৈলী ছিল, তা অবশ্য সময়ের সঙ্গে অনেক পাল্টে গেছে। বেলাল আহমেদের কথায়, ‘যেসব ইংরেজ ভারতে কাজ করতেন, তারা নিজের দেশে ফিরে এসেও ওইরকম মশলাদার খাবারটা মাঝে মাঝে মিস করতেন, নস্টালজিক হয়ে পড়তেন ওই সব ভারতীয় খাবারের কথায়। দীন মুহাম্মদের রেস্তোঁরা তাই অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কাছেই প্রিয় হয়ে উঠেছিল।’

পরে যেভাবে হয়ে ওঠেন 'গোসল বিশারদ'
উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, রেস্তোঁরা ব্যবসার পরে দীন মুহাম্মদ মনোযোগ দেন 'শ্যাম্পুইং'য়ের দিকে। ছোটবেলায় যে সাবান আর ক্ষার তৈরির বিদ্যা শিখেছিলেন, সেটাই কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশদের ভারতীয় কায়দায় গোসল করা শেখাতে শুরু করেন। যেটাকে সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ায় মাসাজ বলা হয়, সেইভাবেই ‘ভেপার ম্যাসিওর বাথ’-এর জন্য ব্রাইটনে একটি দোকান খোলেন তিনি। স্থানীয় কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছিলেন ভারতীয় ভেষজ-বাষ্প দিয়ে গোসল করলে কী কী রোগ সারতে পারে।

এই ব্যবসাটা কিছুদিনের মধ্যেই খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, আর তাকে বলা হতে থাকে ‘ডক্টর ব্রাইটন’। এমনকি হাসপাতালগুলো থেকেও তার কাছে রোগী পাঠানো হতে থাকে - মূলত গাঁটের ব্যথা, বাত এসবের প্রতিকারের জন্য। তার 'শ্যাম্পু' চিকিৎসা বা মাসাজের সুফল জানতে পেরে রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং চতুর্থ উইলিয়াম শেখ দীন মুহাম্মদকে ব্যক্তিগত 'শ্যাম্পুইং সার্জেন' হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, মুহাম্মদ দম্পতির সাতটি ছেলে-মেয়ে ছিল। এক নাতি, ফ্রেডেরিক হেনরি হোরাশিও আকবর মুহাম্মদ ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক। উচ্চ রক্তচাপ সংক্রান্ত গবেষণায় তাঁর অবদান এখনও স্মরণ করা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে।

শেখ দীন মুহাম্মদ ১৮৫১ সালে মারা যান। পরে তাকে দাফন করা হয় ব্রাইটনের সেন্ট নিকোলাস চার্চে।


আরো সংবাদ



premium cement
দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাবি তুলে ধরতে হবে : রেহমান সোবহান পূবালী ব্যাংক পিএলসির বার্ষিক ঝুঁকি সম্মেলন অনুষ্ঠিত বাউয়েট ক্যাম্পাসে বিদায়ী ব্যাচের শিক্ষার্থীদের র‌্যালি অনুমোদিত ৩৫০% নগদ লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের বিতরণ করল ওয়ালটন বেসিস সদস্যদের জামানতবিহীন ঋণ প্রদান করবে ব্র্যাক ব্যাংক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন পুষ্টি ভার্সেস অব লাইট হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতা আয়োজন করবে টি কে গ্রুপ প্রয়োজনে ইটনা-মিঠামইন সড়ক ভাঙা হবে : উপদেষ্টা ফরিদা সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে ‘আত্মত্যাগের চেতনায় আগামীর বাংলাদেশ’ আলোচনা সভা আর পি সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের সংবর্ধনা গুণগত শিক্ষার সাথে প্রকৌশলীদের নৈতিকতার জ্ঞানার্জন করতে হবে

সকল