মিজানুর রহমান আজহারীর যুক্তরাজ্যের ভিসা বাতিলের নেপথ্যে
- ব্রিটেন থেকে সংবাদদাতা
- ০১ নভেম্বর ২০২১, ১৯:৩৭, আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২১, ১৯:৫৭
বর্তমান প্রজন্মের তুমুল জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা ড. মিজানুর রহমান আজহারীকে যুক্তরাজ্য সফরের ভিসা দিয়েও পরে ভিসা বাতিল করে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে দেয়নি দেশটির হোম অফিস। গত ৩১ অক্টোবর শুক্রবার মিজানুর রহমান আজহারী যুক্তরাজ্যে এসে লন্ডন, লুটন, বার্মিংহাম, লেইস্টার, কার্ডিফ ও ওল্ডহামসহ যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকটি শহরে পূর্বঘোষিত ইসলামী কনফারেন্সে যোগ দেয়ার কথা ছিল।
মিজানুর রহমান আজহারীর যুক্তরাজ্য আগমন উপলক্ষে যুক্তরাজ্যে বাঙালি মুসলিম কমিউনিটিতে সাজ সাজ রব ছিল। এ উপলক্ষে যুক্তরাজ্যের ৬টি শহরে ১৫ পাউন্ড থেকে শুরু করে ১০০ পাউন্ড মূল্যের টিকিট বিক্রি করা হয়েছিল। মানুষ হলরুমের ধারণ ক্ষমতারও অতিরিক্ত টিকিট ক্রয় করেছিল।
অন্যদিকে সেক্যুলার বাংলাদেশ মুভমেন্টের সভাপতি কাউন্সিলার পুস্পিতা গুপ্তা ও প্রগতিশীল দাবিদার লিপি হালদারসহ অন্য কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন মিজানুর রহমান আজহারীর যুক্তরাজ্য আগমনের বিরোধিতা করছিল। তারা অনেকেই স্থানীয় এমপি থেকে শুরু করে ফরেন অফিসে মিজানুর রহমান আজহারীর বিভিন্ন বক্তব্য থেকে অংশ বিশেষ কেটে জুড়ে হোম অফিসসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে মিজানুর রহমান আজহারীকে ‘অন্য ধর্মবিদ্বেষী’ ও ‘উগ্রবাদে তরুণদের উস্কানি প্রদানকারী’ বক্তা হিসেবে তার ভিসা বাতিলের আবেদন করেছিল। শেষ পর্যন্ত ভিসা বাতিলের আবেদনকারীরা সফল হয়েছেন। মিজানুর রহমান আজহারীর ভিসা বাতিলের খবরে আজহারী ভক্তরা যতটা হতাশ হয়েছেন, আজহারীর বিরোধিতাকারীরা ঠিক ততটাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
ভিসা বাতিলের ক্রেডিট নিয়ে কাড়াকাড়ি
মিজানুর রহমান আজহারীর ভিসা বাতিলের খবরে কাউন্সিলার পুষ্পিতা গুপ্তা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তার নিজের ক্রেডিট দাবি করেছেন। কালের কণ্ঠের লন্ডন প্রতিনিধি জুয়েল দাস সর্বপ্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বলে তিনিও নিজের ক্রেডিট দাবি করেছেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি হুরমুজ আলী এই ব্যাপারে প্রথম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন বলে তিনিও নিজের ক্রেডিট দাবি করেছেন।
অন্যদিকে প্রথমে আস্তিক ও পরে নিজেকে নাস্তিক দাবি করা মোফাসসিল ইসলাম বলেন, ‘আজহারী আমাকে উল্লুকা পাট্টা বলেছেন, আমি তার প্রতিশোধ নিয়েছি, আমিই তার ভিসা বাতিলের নেপথ্যে কাজ করেছি’।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখাও দাবি করেছেন তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ হোম অফিস মিজানুর রহমান আজহারীর ব্রিটেনের ভিসা বাতিল করেছে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্যে শাখার প্রতিবাদ সভা
এদিকে গত ২৯ অক্টোবর শুক্রবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্যে শাখার সদস্যরা ইসলামী বক্তা ড. মিজানুর রহমান আজহারীর যুক্তরাজ্যে ইসলামী সমাবেশে যোগদানের বিরুদ্ধে স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে প্রতিবাদ সভা করেন। সংগঠনের সাধারন সম্পাদক রুবি হকের সঞ্চালনায় উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি সৈয়দ এনামুল ইসলাম।
প্রতিবাদ সভায় লিখিত বক্তব্য রুবি হক বলেন, লন্ডনস্থ আইওএন টেলিভিশন এখানকার কতিপয় মৌলবাদী সংগঠনের সহযোগিতায় ৩১ অক্টোবর ২০২১ সালে স্থানীয় একটি হলে বিতর্কিত ধর্মাচারী, হিন্দু ও ইহুদিবিদ্বেষী মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর উপস্থিতিতে একটি সমাবেশ করার আয়োজন করেছিল যা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখা এবং অন্যান্য প্রবাসী বাংলাদেশী অসাম্প্রদায়িক সংগঠন ও বেশ কয়েকটি ইহুদি সংগঠনের প্রতিবাদের মুখে প্রতিহত হয়। আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ হোম অফিস মিজানুর রহমান আজহারীর ব্রিটেনের ভিসা বাতিল করে। মিজানুর রহমান আজাহারী বেশ কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ মাহফিলের নামে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত-শিবিরসহ মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী শক্তিকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ওইসব ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে যুব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর বিরূপ মন্তব্য করে যুব সম্প্রদায়ের মগজ ধোলাই করে আসছিলেন। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কড়া পদক্ষেপের কারণে এক পর্যায়ে তিনি সব ছেড়ে মালয়েশিয়ায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েও তিনি বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্বের চেতনা বিরোধীদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন। যার প্রমাণ হলো, যুক্তরাজ্যে এসে তার এই ইসলামী সমাবেশ করার চেষ্টা চালানো। বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী চৌধুরী মঈনুদ্দিনসহ অনেক মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিরোধীদের স্বর্গরাজ্য হলো এই যুক্তরাজ্য। মিজানুর রহমান আজহারীর যুক্তরাজ্য আগমন আপাতত রহিত হয়েছে সত্য কিন্তু ভবিষ্যতেও তার এমন প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার জন্য আমরা এই সভা থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির সকলের প্রতি আহ্বান জানাই।
প্রতিবাদ সভা থেকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্যে শাখার নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের প্রতি এবং সাংবাদিকদের প্রতি নিম্নলিখিত চারটি দাবি উপস্থাপন করেন। দাবিগুলো হচ্ছে : ১। মিজানুর রহমান আজহারীসহ সকল সাম্প্রদায়িক ধর্মচারীদেরকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ না করতে দেয়ার সিদ্ধান্তে ব্রিটিশ সরকারকে অনড় থাকতে হবে; ২। ভবিষ্যতে মৌলবাদী মোল্লাদেরকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের আগে ব্রিটিশ সরকারকে অবশ্যই সম্ভাব্য রিস্ক এসেসমেন্ট করতে হবে; ৩। শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী চৌধুরী মঈনুদ্দিনসহ যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী সকল যুদ্ধাপরাধীদেরকে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে; ৪। মিজানুর রহমান আজহারীর মতো সাম্প্রদায়িক এবং অন্যধর্ম বিদ্বেষী ধর্মচারীরা যেনো যুক্তরাজ্যে এসে আমাদের নতুন প্রজন্মের মগজ ধোলাই করতে না পারে সেদিকে সাংবাদিকদের সোচ্চার থাকতে হবে।
এ সময় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখার সহ সভাপতি মতিয়ার চৌধুরী, মোহাম্মদ হরমুজ আলী, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি শাহ মোস্তাফিজুর রহমান বেলাল, জামাল আহমেদ খান, হামিদ মোহাম্মদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আনসার আহমেদ উল্লাহ ও অন্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এই কমিটির যুক্তরাজ্য শাখার অন্যান্য সদস্যরা হলেন, ইন্টারন্যাশনাল সেক্রেটারি কাউন্সিলার পুষ্পিতা গুপ্তা, প্রেস সেক্রেটারি আ স ম মাসুম, পাবলিকেশন সেক্রেটারি জুয়েল দাস, কালচারাল সেক্রেটারি সেলিনা আক্তার জোছনা, ট্রেজারার এনামুল হক, অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল সেক্রেটারি স্মৃতি আজাদ, নির্বাহী সদস্য সুশান্ত দাশ প্রশান্ত, জোছনা পারভীন, নিলুফা ইয়াসমীন হাসান প্রমুখ।
সংবাদ সন্মেলনে তারা হোম সেক্রেটারি প্রীতি পাটেলের কাছে লেখা তাদের আবেদনপত্রের একটি কপি সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন। সেখানে দেখা যায়, আবেদনপত্রে মিজানুর রহমান আজহারীর আগমনের বিরোধিতা করে তারা বলেছেন, মিজানুর রহমান আজহারী একজন ইহুদি ও হিন্দুবিরোধী মুসলিম ধর্ম প্রচারক। তিনি একজন চরমপন্থী ইসলামী মৌলবাদী এবং সম্প্রদায়ের সংহতির জন্য হুমকিস্বরূপ। এই কারণে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে তাকেসহ জনসমক্ষে তার ওয়াজ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ২০১৯ সালে গ্রেফতারের ভয়ে তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন।
আবেদন পত্রের শেষদিকে তারা উল্লেখ করেছেন, Allowing such extremist like Azhari to enter the UK will only promote extremist ideology amongst the UK Muslim community and will fathom hatred of other faith communities especially against the Jews and the Hindus. অর্থাৎ আজহারীর মতো চরমপন্থীকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দিলে তা শুধুমাত্র ইউকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চরমপন্থী মতাদর্শের প্রচার করবে এবং অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের বিশেষ করে ইহুদি ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগাবে।
তারা আরো উল্লেখ করেছেন, We are concerned that his presence in the UK and attendance in several conferences would encourage more hatred, anti-Semitism and extremist activities in the UK. অর্থাৎ আমরা উদ্বিগ্ন যে, ইউকেতে তার উপস্থিতি এবং বেশ কয়েকটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ ইউকেতে আরো ঘৃণা, সেমিটিজম বিরোধী এবং চরমপন্থী কার্যকলাপকে উৎসাহিত করবে।
এই কারণে প্রথমে ভিসা দিয়েও পরে হোম অফিস তার ভিসা বাতিল করেন।
‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ ও ‘নাস্তিক নির্মূল কমিটি’র ‘নির্মূল’ শব্দটি বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা, দেশের সংবিধান কাউকে নির্মূলের অধিকার দেয় কিনা সংবাদ সম্মেলনের শেষ দিকে একজন সাংবাদিকের এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না দিয়ে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ নেতৃবৃন্দ সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।