২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাংলাদেশী যে নারীর হত্যাকে ঘিরে ব্রিটেনে তীব্র ক্ষোভ

- ছবি : সংগৃহীত

এক সপ্তাহ আগের শনিবার বিকেল। দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের এক পার্কের ভেতর পাওয়া যায় এক নারীর লাশ। পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পর এক ব্যক্তি লাশটি দেখতে পান। সাথে সাথে বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়। তখনো কেউ জানতো না, এই নারীর নাম, কী তার পরিচয়।

দু’দিন পর গত সোমবার হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকায় ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে ছাপা হলো খবরটি। সাথে পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া একটি ছবি। কালো গ্রাজুয়েশন গাউন পরে ক্যামেরার দিকে মৃদু হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকা এই মেয়েটির নাম সাবিনা নেসা।

পুলিশের তদন্তে এ পর্যন্ত যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে গত শুক্রবারের আগের শুক্রবার সন্ধ্যায় কোনো এক সময়ে সাবিনা নেসাকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর হত্যাকারী তার লাশটি ফেলে রেখেছিল পার্কে ঝোপঝাড়-ঘাসের আড়ালে। পরদিন বিকেলে পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ব্যক্তির নজরে আসার আগে পর্যন্ত সেখানেই পড়ে ছিল লাশটি।

এই হত্যার মিডিয়া কভারেজ, রাস্তাঘাটে নারীর নিরাপত্তাহীনতা- এসব নিয়ে ব্রিটেনে এখন চলছে তুমুল বিতর্ক। ব্রিটেনে কোনো শ্বেতাঙ্গ নারী যখন একই ধরনের ঘটনার শিকার হন, তখন ব্রিটিশ মিডিয়ায় সাথে সাথে সেটি নিয়ে যেভাবে ফলাও করে খবর প্রচার হয়, সাবিনা নেসা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ হওয়ায় সেটি দেখা যায়নি বলে তীব্র সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

গত কয়েকদিন ধরে অবশ্য ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে আছে সাবিনা নেসার হত্যার বিষয়টি। এই ঘটনার কভারেজ নিয়ে বিতর্ক ও নারীর নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে ক্ষোভ এখনো থামেনি।

কে এই সাবিনা নেসা?
দক্ষিণ লন্ডনের এক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সাবিনা নেসা। ২৮ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ-বাংলাদেশী পড়াশোনা করেছেন গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাবিনা নেসাকে একজন ‘মেধাবী, দয়ালু ও নিবেদিতপ্রাণ’ শিক্ষক বলে বর্ণনা করেছেন।

সাবিনা নেসার পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায়। যুক্তরাজ্যের বেডফোর্ডশায়ারের একটি ছোট্ট শহরে স্যান্ডিতে থাকে তার পরিবার। বাবা আবদুর রউফ কাজ করেন স্যান্ডির একটি রেস্টুরেন্টে।

পুলিশ ও ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাবিনা নেসা শুক্রবার সন্ধ্যায় তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্কের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে খুব কাছেই এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। পুলিশের ধারণা, বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বেই হয়তো তাকে হত্যা করা হয়েছে।

হত্যাকারী কে?
এই হত্যার রহস্য এখনো অনুদঘাটিত, হত্যাকারী এখনো ধরা পড়েনি। পুলিশ এ পর্যন্ত কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। একজন সন্দেহভাজনকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।

পুলিশের তদন্ত যেভাবে আগাচ্ছে ও যেসব তথ্য এখনো পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, কোনো অপরিচিত ব্যক্তির হাতেই হয়তো খুন হয়েছেন সাবিনা নেসা।

লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করেছে, যাতে একজন টাক মাথার পুরুষকে হাতে কিছু একটা নিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে। পুলিশ মনে করছে, সাবিনা নেসা হত্যা রহস্য উদঘাটনে ওই ব্যক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিডিও ফুটেজের ওই লোকটির পরনে ধূসর রঙের জিন্স ও কালো জ্যাকেট। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাকে মাথায় হুড টেনে দিতে দেখা যায়।

মিডিয়া কভারেজ নিয়ে বিতর্ক
সাবিনা নেসা হত্যার খবর ব্রিটিশ মিডিয়ায় শুরুতে অতটা গুরুত্ব পায়নি বলে তীব্র সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এক্ষেত্রে হত্যার খবরকে তুলনা করা হচ্ছে কয়েক মাস আগে লন্ডনে একই ধরনের ঘটনার শিকার হওয়া এক শ্বেতাঙ্গ নারী সারা অ্যাভারার্ডের হত্যার সাথে। সারা অ্যাভারার্ড নিহত হন এ বছরের মার্চে দক্ষিণ লন্ডনে। তিনিও সেদিন পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন রাতে। পথে তাকে অপহরণ করে এক পুলিশ। পরে তার লাশ পাওয়া যায় একটি পার্কে।

তার হত্যা ব্রিটেনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়, দিনের পর দিন এই হত্যাকাণ্ডের খবর ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে রেখেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ও ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তার দাবিতে যে বড় বড় বিক্ষোভ হয়, তাতে এমনটি ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য ডাচেস অব কেমব্রিজ কেট মিডলটনও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সাবিনা নেসার হত্যার পর অন্তত প্রথম কয়েকদিন সেধরণের কভারেজ দেখা যায়নি বলে অনেকে অভিযোগ করছেন।

লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের একজন কাউন্সিলর রাবিনা খান বিবিসি রেডিও ফোরের টুডে অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক পোস্ট তিনি দেখেছেন, যেখানে অনেকে প্রশ্ন করছেন, একজন অশ্বেতাঙ্গ নারী বা সংখ্যালঘু নারী যদি সারা এভারার্ডের মতো নিখোঁজ হয়ে যান, তিনি কি আসলে মিডিয়ায় একই ধরণের মনোযোগ পাবেন?

নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
সাবিনা নেসার হত্যা একইসাথে নতুন করে ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে। দক্ষিণ লন্ডনের যে জায়গায় সাবিনা নেসার দেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, তার কাছেই শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিরাট প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন শত শত মানুষ। সেখানে তারা মোমবাতি জ্বালিয়ে সাবিনার প্রতি শ্রদ্ধা জানান, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার অবসান দাবি করেন।

সাবিনা নেসার বোন জেবিনা ইয়াসমিন ইসলাম সেখানে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, আমাদের অনুভূতি এখন কী, তা কোনো শব্দ দিয়ে আমরা প্রকাশ করতে পারবো না। মনে হচ্ছে আমরা একটা দুঃস্বপ্নের ঘোরে আটকে আছি। কোনো পরিবারকে যেন এরকম ঘটনার শিকার হতে না হয়।

লন্ডনের মতো একটি শহরেও ঘরের বাইরে নারীদের কিভাবে সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়, তার উদাহরণ দিচ্ছিলেন রেডব্রিজ কাউন্সিলের একজন নির্বাচিত কাউন্সিলর সৈয়দা সায়মা আহমেদ। রেডব্রিজ কাউন্সিলের 'উইমেনস চ্যাম্পিয়ন' হিসেবে তিনি ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন। এই কাজের অংশ হিসেবে কিছুদিন আগে তারা ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে একটা জরিপ মতো চালিয়েছিলেন।

সৈয়দা সায়মা আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সেখানে নারীরা আমাদের জানিয়েছেন, রাতে হোক বা দিনে হোক, তারা যখন ঘরের বাইরে যান, তারা ধরেই নেন যে ঘরের বাইরে গেলে তাদেরকে কটূক্তি শুনতে হবে, পুরুষের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে। রাস্তায় হয়তো তাদেরকে কেউ অনুসরণ করতে পারে। নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে ব্যাগের মধ্যে কিছু না কিছু নিয়ে বের হতে হয়। অনেকে জুতো বদলান কাজ থেকে ফেরার সময়, যা পরে দৌড় দেয়া যায়। অন্ধকার গলির দিকে তারা যান না, তারা ভয় পান। তাদেরকে হয়তো কেউ নিপীড়ন করতে পারে। এগুলো এতটাই স্বাভাবিক যে, সবাই জানে।’

সাবিনা নেসার হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশ-বাংলাদেশী কমিউনিটিতে ঘরের বাইরে নারীর চলাফেরার স্বাধীনতা সংকুচিত করার চেষ্টা করা হতে পারেন, এমন আশঙ্কা করেন কেউ কেউ। কিন্তু সৈয়দা সায়মা আহমেদ বলছেন, এটি কোন সমাধান নয়।

তিনি আরো বলেন, আমাদেরকে ভাবতে হবে, মেয়েদেরকে আটকে রেখে নয়, বরং যারা নারীকে আক্রমণ করছে, যারা নিপীড়নকারী, তাদেরকে কিভাবে শিক্ষা দেয়া যায়, সেটাই বরং ভাবতে হবে। এখানে দরকার নারীর ব্যাপারে মানসিকতার পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন।

সূত্র : বাসস


আরো সংবাদ



premium cement