দক্ষিণ আফ্রিকায় দাঙ্গা : বহু বাংলাদেশীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৫ জুলাই ২০২১, ২০:০৬
‘ছোটকালে গল্পে পড়েছি যে আগের দিন রাজা থেকে পরের দিন পথের ফকির হয়ে যায় মানুষ। সেটা যে নিজের জীবনে বাস্তব হবে তা কখনো চিন্তা করিনি’ - নিজের দুর্ভাগ্যের গল্প বলতে বলতে এভাবেই হতাশা ফুটে ওঠে সোহাগ রানার কণ্ঠে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা গ্রেফতার হওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু অংশে গত কয়েকদিনে হওয়া বিক্ষোভ ও সহিংসতায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশী সোহাগ রানার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের।
শুধু সোহাগ রানা নয়, স্থানীয় বাংলাদেশীরা বলছেন, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শিকার হয়ে ব্যবসার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে দুই শ’রও বেশি বাংলাদেশী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের, যার মধ্যে সোহাগ রানার মতো অনেকের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার প্রায় শতভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের কুমিল্লা থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান সোহাগ রানা। গত সাত বছর ধরে কোয়াজুলু-নাটাল প্রদেশের পিটারমেরিৎজবার্গে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি।
‘একটা কমপ্লেক্সের মতো জায়গায় বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ফার্নিচারের দোকান, পেট্রোল পাম্প, সুপারশপ ছিল আমার। সোমবার রাত থেকে লুটপাট শুরু হওয়ার পর সেখান থেকে প্রায় সবকিছুই নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা, বিবিসি বাংলাকে জানান সোহাগ রানা।
লুটপাট চালানো হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পেছনে সোহাগ রানার বাসায়ও। ওই ঘটনার পর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে পরিচিত একজন বাংলাদেশীর বাসায় উঠেছেন তিনি।
কোয়াজুলু-নাটাল ও গাওটেং প্রদেশের অন্তর্গত অধিকাংশ দোকান ও গুদামেই গত কয়েকদিনে চলেছে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। সেসব এলাকায় বাংলাদেশী মালিকানাধীন দোকানপাটসহ অন্যান্য দোকানও পড়েছে বিক্ষোভকারীদের রোষানলে।
দোকানের সাথে সাথে অনেকের বাড়িতেও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। অনেকেই সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছেন পরিচিত কারো না কারো বাসায়।
ক্ষয়ক্ষতির অঙ্ক বিশাল
গত কয়েকদিনের সহিংসতায় কোয়াজুলু-নাটালের পিটারমেরিৎজবার্গ, ডারবান ও গাওটেং প্রদেশের জোহানেসবার্গ, জারমিস্টোন শহরসহ আশেপাশের এলাকাগুলোতে থাকা বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের অনেকে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে বলে জানান জোহানেসবার্গের বাসিন্দা মোহাম্মদ মোশাররফ - যিনি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন এবং স্থানীয় বাংলাদেশীদের সংগঠনের সাথে জড়িত।
মোহাম্মদ মোশাররফ বলেন, ‘এখানে বসবাসরত প্রায় ৯০ ভাগ বাংলাদেশী সুপারশপ জাতীয় দোকান পরিচালনা করেন। গত কয়েকদিনের বিক্ষোভে চার শ’র বেশি বাংলাদেশী মালিকানাধীন দোকান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে বেশ কিছু দোকান পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।’
মোশারররফ বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানগুলোর মধ্যে অন্তত ১০টি দোকানের প্রতিটিতে থাকা মালামালের মূল্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ মিলিয়ন র্যান্ড, টাকার অঙ্কে যা দেড় থেকে দুই কোটি টাকারও বেশি।
‘এছাড়া অন্তত দুই শ’র বেশি দোকানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ চালানো হয়েছে যেসব দোকানের প্রত্যেকটিতে থাকা মালামালের মূল্য ছিল তিন থেকে দশ লাখ র্যান্ড - বাংলাদেশী টাকায় যা প্রায় ১৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকার সমমানের।’
মোশাররফের অনুমান, চলমান এই বিক্ষোভে হওয়া লুটপাটে কয়েক হাজারের বেশি বাংলাদেশী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
পিটারমেরিৎজবার্গ শহরের বাসিন্দা সায়মন হক কাজল, যিনি স্থানীয় বাংলাদেশী সংগঠনের একজন নেতা, জানান তাদের এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশীদের অস্থায়ী আবাসস্থলের ব্যবস্থা করেছেন তারা।
পাশাপাশি আবারো যেন বিক্ষোভকারীরা হামলা চালাতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনের সাথে মিলে পাহারা দিচ্ছেন তারা।
সাময়িক আশ্রয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা
সাম্প্রতিক বিক্ষোভে আর্থিক ক্ষতি বহন ছাড়াও এসব বাংলাদেশীদের অনেকে বাধ্য হয়েছেন নিজেদের থাকার জায়গা থেকে সরে আসতে।
‘দোকান যারা পরিচালনা করেন, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের অধিকাংশই দোকানের পেছনে বাসা তৈরি করে থাকেন। দোকানের সাথে সাথে তাদের বাসায়ও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ চালানো হয়েছে। এরকম অনেকেই আশ্রয়হীন হয়ে গেছেন।’
মোশাররফ জানান জোহানেসবার্গে আশ্রয়হীন হয়ে পড়া এরকম ১০ জন বাংলাদেশীকে উদ্ধার করে সাময়িক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে। এছাড়া জারমিস্টোন ও ডারবান শহরের বাংলাদেশী সংগঠনগুলো আলাদাভাবে আরো অন্তত ৫০ জন বাংলাদেশীকে এরকম পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
স্থানীয় বাংলাদেশীদের সংগঠনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে কেপটাইন, প্রিটোরিয়া, জোহানেসবার্গ ও ব্লুমফন্টেইনে অভিবাসী বিরোধী হামলারও শিকার হয়েছেন বাংলাদেশীরা।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রিটোরিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দক্ষিণ আফ্রিকার শ্রম শক্তির শতকার ৩২ ভাগই বেকার। দেশটির প্রেসিডেন্টকে গ্রেফতার ও কারাদণ্ড দেয়ার ফলে দেশটিতে হওয়া সাম্প্রতিক বিক্ষোভ এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলমান অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে আনতে সারা দেশে ২৫ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
সূত্র : বিবিসি