২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পান্তা-আলু ভর্তার মাস্টারশেফ, বাংলাদেশী নারী অস্ট্রেলিয়ায় তৃতীয়

পান্তা-আলু ভর্তা বানিয়ে মাস্টারশেফ, অস্ট্রেলিয়ায় তৃতীয় বাংলাদেশী কিশোয়ার - ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশের গ্রামবাংলার মানুষের আবহমানকালের খাবার পান্তা ভাত আর আলু ভর্তা। এই খাবার পরিবেশন করে রান্নাবিষয়ক একটি জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী। আর এই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন জাস্টিন।

দু’দিন ধরে চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয় জাস্টিন, পিট ও কিশোয়ার এই তিন ফাইনালিস্টকে নিয়ে।

প্রথম দিন ফাইনাল ডিশে কিশোয়ার রান্না করেন 'স্মোকড ওয়াটার রাইস, আলু ভর্তা ও সার্ডিন'। অর্থাৎ বাঙালির কাছে চিরচেনা পান্তা ভাত, আলু ভর্তা আর সার্ডিন মাছ ভাজি।

ফাইনাল ডিশ রান্না নিয়ে কিশোয়ার বিচারকদের বলেন যে প্রতিযোগিতায় এমন রান্না সত্যিই চ্যালেঞ্জের। সাধারণ রেস্টুরেন্টে এমন রান্না হয় না। কিন্তু বাঙালির কাছে এটা পরিচিত রান্না। আর ফাইনাল ডিশ হিসেবে এটা রেঁধে নিজের তৃপ্তির কথাও জানান কিশোয়ার।

তবে এই রান্না দেখে ও খেয়ে বিচারকরা অভিভূত হন। তিনজনেই দশে দশ দেন কিশোয়ারকে।

তিনি হাঁসের একটি পদ রান্না করা শুরু করেছিলেন। বিচারকেরা যখন তার রান্না দেখতে এলেন সবকিছু দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এখানে কিশোয়ার কোথায়? তারপরই তিনি তার মেন্যু চেঞ্জ করার চিন্তা করেন আর ফাইনাল ডিশ হিসেবে পরিবেশন করেন বাঙালির চির পরিচিত আলু ভর্তা, পান্তা ভাত আর সার্ডিন মাছ, যেই মাছের স্বাদ অনেকটা ইলিশ মাছের কাছাকাছি।

চূড়ান্ত পর্বে ফাইনাল ডিশ রেঁধে ৫১ নম্বর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন পিট। আর প্রথম স্থানে ছিলেন জাস্টিন ৫৩ নম্বর নিয়ে। তবে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ফাইনাল রেজাল্টের আগেই লাখ লাখ বাঙালির মন জয় করে নিয়েছেন কিশোয়ার।

সম্প্রতি ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রামসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে পড়ে বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত ও একইসাথে প্রচণ্ড জনপ্রিয়- কয়েক পদের রান্নার ভিডিও। সাথে পরিচিতি পেয়ে যান এ সবের রাঁধুনি।

লাউ চিংড়ি, বেগুন ভর্তা, খিচুড়ি, মাছ ভাজা, আমের টক, খাসির রেজালা- মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় একের পর এক এমন মুখরোচক খাবার রান্না করে বিচারকসহ বিভিন্ন ভাষাভাষী দর্শকের নজর কাড়েন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই শেফ।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের খাবারকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার কারণেই ৩৮ বছর বয়সী কিশোয়ারকে অন্যসব প্রতিযোগী থেকে আলাদা করেছে।

রান্নাবান্নার প্রতি ঝোঁক এলো যেভাবে
কিশোয়ার চৌধুরী একজন বিজনেস ডেভেলপার। পারিবারিক প্রিন্টিং ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন তিনি। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়ায় হলেও পারিবারিক আবহটা সবসময়ই ছিল বাঙালিয়ানা। কথায় কথায় জানালেন, তার বাবার বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে আর মা কলকাতার বর্ধমানের। তারা দু’জনে প্রায় ৫০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান।

তবে বিদেশে বসবাস করলেও নিজের দেশের ভাষা, সংস্কৃতি চর্চা সবকিছুই বজায় রেখেছেন কিশোয়ারের মা-বাবা। আর তা সন্তানদেরও ধারণ করতে উৎসাহিত করেছেন তারা।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলার আফরোজা নীলার সাথে সাক্ষাৎকারে কিশোয়ার বলেছিলেন, ‘আমাদের বাসার ভেতরে শুধু রান্না না। বাজারটা কোথা থেকে আসে, কোন ইনগ্রেডিয়েন্ট কোথা থেকে কিনি, সেগুলোও সব সময় দেখানো হয়েছে আমাদের। আমাদের বাগানে হার্বস থেকে শুরু করে শাকসবজি মরিচ-লাউ সব কিছুই আমরা নিজেরা উৎপাদন করি। ছোটবেলা থেকে আমাদের মা-বাবা এসব কাজে আমাদের সম্পৃক্ত করেছেন।’

কিশোয়ারের কখনো মনে হয়নি যে হঠাৎ করে তিনি রান্না শুরু করেছেন। তার ভাষায়, ‘যেগুলো সব সময় দেখে আসছি, করে আসছি, সেগুলোই রান্না করেছি। আমার বাবা মাছ ধরতে পছন্দ করেন। ছোটবেলায় তার সাথে মাছ ধরতে যেতাম। ওই যে ফ্রেশ মাছটা নিয়ে রান্না করা, সেটা দেখে বড় হয়েছি। আসলে এই পরিবেশটা সবসময় বাসার মধ্যেই ছিল।’

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় যাত্রা
দুই সন্তানের মা কিশোয়ারের মাথায় চিন্তাটা আসে ২০২০ সালে। যখন সারা দুনিয়ার মতো অস্ট্রেলিয়াতেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শুরু হয়েছিল। তিনি বলেন, গত বছরই একটা বিষয় বারবার মনে হচ্ছিল যে আমার মা-বাবা যেরকম করে তাদের সংস্কৃতি, খাবার-দাবার সবকিছু আমাদের মধ্যে ইনস্টল করেছেন, আমি সেটা সন্তানদের মধ্যে করে দিতে পারবো কি-না। এটা শুধু আমার না, আমার মনে হয় দেশের বাইরে যেসব মা-বাবারা থাকেন, সবার মধ্যেই এই চিন্তাটা থাকে।

আর এমন চিন্তা থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা বই লেখার পরিকল্পনা করেন কিশোয়ার। তার বর্ণনায়, আমার ছেলের বয়স এখন ১২। এরকম একটা বয়সে নিজের সংস্কৃতি, পূর্ব-পুরুষ এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি সব সময় ভাবতাম ওদের জন্য কী রেখে যাওয়া যায়!

তবে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় আবেদন করার কোনো ইচ্ছাই কখনো ছিল না কিশোয়ারের। তার ভাষায়, এটা আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল। সে আমাকে প্রায়ই বলতো মা তুমি এটা পারবা। তুমি অ্যাপ্লাই করো না কেন। আমার ছেলেকে আমি জুনিয়র মাস্টারশেফের জন্য চেষ্টা করতে বলছিলাম। কারণ সেও ভালো রান্না পারে। তারপর সে যখন বলছিল আমাকে অ্যাপ্লাই করতে, তখন ভাবলাম তাদের কাছে এক্সামপল সেট করতে- একটা চেষ্টা করে আমি দেখতেই পারি।

চার বছর বয়সী শিশু সেরাফিনা ও ১২ বছর বয়সী ছেলে মিকাইলের কথা ভেবে কিশোয়ারের এই চেষ্টায় যেন আরো গতি আসে। আর পাশে সবসময় ছিলেন তার পরিবার ও জীবনসঙ্গী এহতেশাম নেওয়াজ।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement