সৌদিতে কোয়ারেন্টিনের টাকা দিতেই নাকাল প্রবাসীরা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৩ জুন ২০২১, ২২:৪৬
সৌদি আরবে যাওয়ার পর বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিজ খরচে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন থেকে অব্যাহতি দেয়ার ব্যাপারে সৌদি সরকারের সাথে কথা বলছে বাংলাদেশ সরকার। যাওয়ার আগে দেশেই শ্রমিকদের কোয়ারেন্টিনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সৌদি আরব ঘোষণা করে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শ্রমিকদের সেখানকার সরকার নির্ধারিত হোটেলে নিজ খরচে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।
মহামারীর কারণে এমনিতেই আর্থিক অনটনে থাকা বহু শ্রমিককে এখন কোয়ারেন্টিন প্যাকেজের জন্য বাড়তি ৮০ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। যা তাদের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেভাবে টাকা যোগাড় করছেন শ্রমিকেরা
নোয়াখালীর ইমরান হোসেন চার বছর পর সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছিলেন। করোনাভাইরাসের কারণে কাজ হারিয়েছেন তিনি, তবুও বুরাইদা আল কাসিম শহরে ফিরে যাওয়ার জন্য তার রিটার্ন টিকেট কাটা ছিল। হঠাৎ করেই তাতে বাড়তি যোগ হয়েছে সৌদি আরবে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের খরচ।
শনিবার সেখানকার সরকার নির্ধারিত একটি তিন তারা হোটেলে কোয়ারেন্টিন শেষ করে বের হয়েছেন ইমরান হোসেন।
তিনি বলছেন, নিজ খরচে কোয়ারেন্টিনে থাকা তার জন্য অনেক বড় বোঝা। তিনি জানিয়েছেন, ‘হঠাৎ করে শোনার পর মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হইছে। এখানে আসছি ১৫ দিন হলো এখনো কোনো কাজ নেই। কাজ আছে ধরেন একটা আর তার জন্য বিশটা লোক চেষ্টা করছে। এখানে মালিকরা কাজে নিচ্ছে না। আবার কাজ করিয়ে টাকা দিচ্ছে না। করোনাভাইরাস শুরুর পর থেকে এই অবস্থা। চাকরি নেই এই অবস্থায় এত টাকা কোথা থেকে শোধ করবো, সেটাই বুঝতে পারছি না।’
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী দেখা দেয়ার পর অনেক বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে বাংলাদেশের অভিবাসন খাতে। বহু শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন অথবা বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে কাজে ফিরে যেতে পারেননি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আক্তার হোসেন ১৮ বছর ধরে সৌদি আরবে কাজ করেন। দীর্ঘ দিন থাকার সুবাদে ছোট ভাইয়ের জন্য এর মধ্যেও কাজ যোগাড় করেছেন। এ সপ্তাহেই তার রিয়াদে পৌঁছানোর কথা।
আক্তার হোসেন বলছিলেন, ‘কোয়ারেন্টিন প্যাকেজের জন্য খরচ পড়েছে ৭৫ হাজার টাকা। আর টিকেটসহ সব মিলিয়ে খরচ প্রায় দুই লাখের মতো পরেছে। আমি বেতন পাই ১৩ শ’ রিয়ালের মতো। ভাইয়ের কোয়ারেন্টিনের জন্য মালিকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছি। প্রতি মাসে বেতন থেকে কেটে নেয়া হবে।’
কোয়ারেন্টিনে অর্থ যোগাড় করতে না পেরে সৌদি আরব যেতে পারেননি এমন ঘটনাও রয়েছে।
‘কোয়ারেন্টিনের অর্থ মালিকের দেয়া উচিৎ’
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, গত বছর করোনাভাইরাসের মহামারী শুরুর পর চাকরি হারিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ অভিবাসীকর্মী বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। যদিও বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যাটি আরো বেশি বলা হয়।
এ ছাড়া যারা বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিলেন, প্রক্রিয়া শেষ করে অপেক্ষায় ছিলেন, লকডাউন ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়ার পর তারাও দেশ ছাড়তে পারেননি।
আগে যেখানে প্রতিবছর সাত থেকে আট লাখ শ্রমিককে বিদেশে পাঠানো হতো, সেখানে গত বছর বিদেশে কাজে যেতে পেরেছেন মোটে দুই লাখের মতো মানুষ।
যাদের ৯৬ শতাংশই গিয়েছিলেন ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে, অর্থাৎ মহামারী শুরুর আগে। নতুন করে আবারো শ্রমিক যাওয়া শুরুর পর সৌদি সরকার বেশ কয়েকবার বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় যে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শ্রমিকদের সেখানকার সরকার নির্ধারিত হোটেলে নিজ খরচে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। দেশ থেকে করোনা পরীক্ষা করিয়ে যেতে হবে। সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর আরো দু’বার সেই পরীক্ষা করাতে হবে। সকল শ্রমিককে স্বাস্থ্য বীমা নিয়ে যেতে হবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ সুমাইয়া ইসলাম বলছেন, কোয়ারেন্টিনের অর্থ সৌদি আরবে মালিকদের বহন করা উচিত।
তিনি বলছেন, ‘মহামারীর কারণে অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছে, অনেকে ছুটিতে এসে আর ফিরে যেতে পারেনি, দেশে কোনো কাজে যোগ দিতে পারেনি, জীবন চালাতে গিয়ে জমানো টাকা খরচ হয়ে গেছে, এরকম অবস্থায় আবারো যখন শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাওয়াটা শুরু হয়েছে তখন এই যে বাড়তি টাকাটা যোগ হলো তা একজন শ্রমিকের জন্য বিশাল বোঝা। এই খরচের একটি অংশ অন্তত অবশ্যই মালিকদের বহন করা উচিত।’
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোরও একটি অংশ দেয়া উচিত।
প্রবাসী শ্রমিকদের টিকায় অগ্রাধিকার দেয়ার চিন্তা
যদিও সরকারের তরফ থেকে কোয়ারেন্টিনের খরচ করতে হচ্ছে এমন কর্মীদের সহায়তা হিসেবে প্রত্যেককে ২৫ হাজার করে টাকা দেয়া শুরু করেছে।
এই অর্থ কর্মী অথবা তার পরিবারের কোনো সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর মহাপরিচালক মো: শহিদুল আলম বলছেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী ধারণা দিয়েছেন যে এই কোয়ারেন্টিন পুরোপুরি উঠিয়ে দেয়া যায় কি-না, অথবা নিজের দেশেই করা যায় কি-না। সেটা নিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি বাংলাদেশে কোয়ারেন্টিন করে ফ্লাই করে সেক্ষেত্রে শ্রমিকের জন্য বিষয়টা সহজ হয়।’
তিনি আরো জানিয়েছেন, ‘শ্রমিকদের টিকা দেয়ার ব্যাপারে আমরা কথা বলছি। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। টিকা এলে শ্রমিকরা অগ্রাধিকার পাবে। টিকার ক্ষেত্রে বয়সের যে ব্যাপারটা তাদের ক্ষেত্রে সেটি উঠিয়ে দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়ার ব্যাপারে আমাদের উদ্যোগ আছে।’
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো শ্রমিকদের টিকার ব্যাপারে এখন বিশেষ জোর দিচ্ছে। টিকা না দেয়া থাকলে নতুন করে অনেক শ্রমিকের কাজ আটকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
তবে বাংলাদেশে এখন যারা প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই দ্বিতীয় ডোজ টিকা পাননি। পর্যাপ্ত টিকার সংকুলান না হলে অভিবাসী শ্রমিকদের টিকার আওতায় আনার বিষয়টিও রয়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে।
সূত্র : বিবিসি