মধ্যেপ্রাচ্যে প্রবাস জীবন কেমন
- এম এম সাহরিয়া, শারজাহ থেকে
- ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:২৪
জীবনযুদ্ধে নেমে জীবিকার তাগিদে অনেক মানুষই বাধ্য হয় দেশান্তরী হতে। আর এই দেশান্তরী হওয়া মানুষগুলোর সুন্দর একটা নাম ‘প্রবাসী’। কিন্তু সুন্দর জীবনের খোঁজে যাওয়া এই প্রবাসীরা কি আসলেই সুন্দর একটা জীবনের দেখা পায়? হয়তো কেউ পায় কেউ পায় না।
প্রবাস জীবন নিয়ে অনেকেরই আছে কৌতুহল। প্রবাস মানেই কি নিঃসঙ্গতা? একাকিত্ব? নাকি প্রবাস মানেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম? কেমন কাটে প্রবাসজীবন? এমন প্রশ্ন আছে অনেকের মাঝেই।
আর যারা প্রবাসী তাদের মধ্যে প্রবাস জীবন কারও কাছে রোমাঞ্চকর, অতিমাত্রায় স্বাধীনতা। কারও কাছে জীবনের সোনালী অধ্যায়ের যাত্রা শুরু। কেউ ভাবছে, এই তো চলছি সোনার হরিণের পেছনে। কেউ সেটা পেয়েও যায়। আবার কেউ প্রবাসে এসে দালালের খপ্পরে পড়ে হচ্ছে প্রতারিত। ভিটে মাটি বিক্রি করে এসে হচ্ছে নিঃস্ব।
এই উপমহাদেশের মানুষের প্রথম প্রবাস যাত্রা শুরু হয় মিয়ানমারের রেঙ্গুনের(বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) উদ্দেশ্যে। বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলের শেষ দিক পর্যন্ত চালু ছিল রেঙ্গুন প্রবাস। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বৃটিশদের কাছ থেকে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দুবাইতে জনশক্তি রফতানির দুয়ার খুলে যায়। তারপর একে একে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যান্য অঞ্চল এবং সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ইরান, ইরাক, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবগুলি দেশে জনশক্তি রফতানি শুরু হয়। প্রথম দিকে অবশ্য নিজ নিজ উদ্যোগেই বিদেশ যাওয়া শুরু হয়।
এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের লোকেরা অগ্রগামী ছিলেন। পাকিস্তান আমলেও কিছু কিছু লোক নানা পন্থায় ইরান, ইরাক, সৌদিআরব এবং বাহরাইনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না।কালক্রমে আমেরিকা, লন্ডনসহ ইউরোপের দেশসমূহ এবং মিসর, সুদানসহ অনেক আফ্রিকান দেশেও আমাদের দেশের লোকেরা প্রবাসী হয়ে আছেন।
প্রবাস জীবন মানে অনেকেই ভাবেন একটু সুখের আশা। অনেকেই ভাবেন, প্রবাসে গিয়ে কিছু টাকা উপার্জন করে একটু সচ্ছল হবেন। আবার এই প্রবাসই অনেকের জীবনে অন্ধকার নিয়ে আসে। ঘর ছাড়া, ভিটে ছাড়া, এমনকি অকালে জীবনও নিয়ে নিয়েছে প্রবাস। কত জনের তো কোনো খোঁজ খবরই পাওয়া যায়নি। তারপরও মানুষ ছুটছে প্রবাসে। প্রবাসে কেউ যে সফল নয় তা নয়। তবে বেশির ভাগ বাংলাদেশি প্রবাসীদের রয়েছে অনেক ‘অসফল’ গল্প। অনেকেই দালাল নামক কিছু চক্রের খপ্পড়ে পড়েন; আবার কেউ কেউ প্রবাসে গিয়েও আইনি জটিলতা ও স্থানীয়দের প্রতারণার শিকার হয়ে কারাবাসেও কাটান।
এমন অসংখ্য অসফল প্রবাসীদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজনের কথা জানা যাক। একজন আপন ভেবে তার দুঃখের কাহিনীর কিছু কথা জানিয়েছেন আমাকে। তার বাবার অনেক ইচ্ছে ছিলো ছেলেকে বিদেশে পাঠাবেন। এজন্য বাবা তাকে এসএসসি পরীক্ষার পর কাজ শিখতে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। ঢাকায় গিয়ে ডেভেলপমেন্টের কিছু ড্রইংসহ রুফ কাজ শেখা শুরু হলো তার। প্রায় ছয় বছর সময় লাগে; তারপর ডেভেলপমেন্টের একটা চাকরিও হলো।এরই মাঝে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিতে ইন্টারভিউ দিতে থাকলেন তিনি। ইন্টারভিউ দিতে দিতে পাসপোর্টই জব্দ করে নিল এক ট্রাভেল এজেন্সি। ম্যানুয়াল পাসপোর্ট ছিল। তারপর এমআরপি পাসপোর্ট বানাতে হলো। এরপর ইন্টারভিউ না দিয়ে পাসপোর্টের ফটোকপি সরাসরি পাঠালেন ওমান, দুবাই, সৌদি, কাতার এবং সিঙ্গাপুরের অনেক কোম্পানিতে।
কোনো সাড়া না পেয়ে বুঝে গেলে, ঢাকাতেই কাজ করে খেতে হবে। নতুন আরেকটা চাকরিও পেয়ে গেলেন; উত্তরায় অফিসে।এর মাঝে তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রায় এক বছর চিকিৎসা চালানোর পর বাবা চলে গেলেন আপন ঠিকানায়। মাকে দেখার কেউ ছিলো না তাই নিজেই বাড়িতে থেকে মায়ের দেখাশোনার পাশাপাশি টুকটাক কাজ করতে থাকেন। বাবা চলে যাওয়ার দুই বছর পর বিয়েও করেন।
আর বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ২০১৬ সালে চলে আসেন এক সময়ের স্বপ্নের প্রবাসে; স্ত্রীর বড় ভাই আর্থিক সহযোগিতা করেছিল। জিপসনের কোম্পানিতে যোগদানের কথা থাকলেও সেটা না হয়ে প্রথম দুই-তিন মাস বেকার থাকতে হলো। তিন মাস পর কাজ পাওয়া গেল। এর পাঁচ মাস পর আবার কাজ নেই; ফের দুই মাস বসে থাকা। তারপর অন্য কন্ট্রাক হলো। কিন্তু এখানেও বছর শেষ করে ঠিক মতো বেতন পাওয়া গেল না। তিন মাস পর এক মাসের বেতন হাতে আসতো।
প্রবাসীদের সব অনিশ্চয়তা কেউ বুঝতে চায় না। মনে করে এখানে অনেক অনেক টাকা। এখানে অনেক প্রবাসী বেতন উঠিয়েই নিজ দেশে পরিবারের কাছে টাকা পাঠিয়ে দেয়। বিদেশি নোটগুলো নিজের জন্য গুণে দেখার সুযোগ পায় না তারা। পরিবারের স্বচ্ছলতাসহ সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে নিজ মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে কাটাতে হয় প্রবাসজীবন। হয়তো একেই বলে এক ধরনের দেয়ালবিহীন কারাগার। প্রবাসে সবাই ব্যস্ত যে যার কাজে। সবার একই চিন্তা কিভাবে বেশি উপার্জন করা যায়। মা-বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তানদের মান অভিমান পূরণ করতে গিয়ে তারা ভুলে যান নিজের শখ।
প্রবাসে কেউ কারো নয়, নিজেই নিজের আপন। প্রবাসীদের সব থেকে বড় সমস্যা হলো একাকিত্ব, আর এ কারণেই অনেক সময় অনেক ছোট সমস্যাগুলোও অনেক বেশি অস্থির ও যন্ত্রণা দেয়। আর প্রবাসীদের তার আপনজন বা প্রিয়জন কষ্ট দিলে সেটা সহ্য করার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলে। অনেকে একাকিত্বের কারণে আত্মহত্যাও করে।
দীর্ঘ দশবছর ধরে আরব আমিরাতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করা আব্দুল আলীম বলেন, ‘আমরা তো একটু সুখের আশায় পাড়ি দিয়েছি অজানার দেশে। দুঃখ নিয়ে বিলাসীতা করার সুযোগ আমাদের নেই। দুঃখ নিবারণ করার ইচ্ছা নিয়ে মা মাটি ছেড়ে অজানা অচেনা এক দেশের মাটিতে আশার ঘর বেঁধেছি, আমরা দুঃখ বিলাসী নই, আমরা সুখের কাঙাল।’
শারজাহ’র জামাল আব্দুল নাসের রোডে দীর্ঘ তিন বছর লন্ড্রি ব্যবসা করেন আনিসুর রহমান। মাস তিনেক আগে এক বাংলাদেশি দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন তিনি। তিনি জানান, এই প্রবাস জীবনে নিজের দেশের মানুষকে বিশ্বাস করাটাই আমার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। সেই সাথে আছে ঋণের বোঝা।
প্রবাসীদের কেউ কেউ আবার প্রবাস জীবনকে বিলাসিতায় পরিণত করে ফেলেছেন। কেউ হারিয়েছে পথ। কিছু যুবক প্রবাসে এসে মদপানের মধ্যদিয়ে রক্তের বিনিময়ে উপার্জিত টাকা নষ্ট করে দিচ্ছে। ‘বিয়ার’ নামের ড্রিংক দিয়ে নেশার প্রথম শুরু করে। এমন কিছু প্রবাসী আছে বিয়ার পানে বাধা দিতে চাইলে বলে এটা এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু বিয়ারের পরেই শুরু হয় ফেন্সিডিল, ইয়াবা, বিদেশী মদ। মদপান করে শুধু নিজের শারীরিক ক্ষতি করছেনা সাথে পরিবারের জন্য কষ্টের কারণ হচ্ছে। এসংখ্যা যদিও খুব বেশি নয়।
সব কিছুর পরেও বাংলাদেশর অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছেন প্রবাসীরা।বাংলাদেশ ব্যাংক বছর ঘুরে গুনছে হাজার কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা! পরিবারের সুখের উৎস হতে দিয়ে তারা দেশের অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছে। তাদের হাড়ভাঙা খাটুনিতে ঘুড়ছে দেশের অর্থনীতির চাকা।