১২৫ দেশ ভ্রমণ করা বাংলাদেশী নাজমুন নাহার কী দেখলেন আফ্রিকায়?
- বিবিসি বাংলা
- ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:০৫, আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:২৬
নাজমুন নাহার তার বিশ্ব ভ্রমণে আপাতত বিরতি দিয়ে ফিরছিলেন সুইডেনে নিজের বাড়িতে। পথে কয়েকদিনের জন্যে থামলেন লন্ডনে। এবার যখন বিবিসির স্টুডিওতে এলেন, আগের বারের চেয়ে তাকে দেখতে লাগছিল কিছুটা অন্যরকম - গায়ের রঙে রোদে-পোড়া ছোপ লেগেছে, হেয়ার স্টাইলও একেবারে নতুন।
আফ্রিকান নারীদের মতো তিনি কোঁকড়ানো চুলের বেণী করেছেন মাথায়।
নানান রঙের কাপড়ের তৈরি পোশাক আর চুলের স্টাইলেই তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন এবার তিনি ঘুরে এসেছেন আফ্রিকায়।
গত তিন মাস ধরে পশ্চিম আফ্রিকার ১৫টি দেশে ভ্রমণ করেছেন বাংলাদেশী পর্যটক নাজমুন নাহার। এর আগে যখন বিবিসিতে এসেছিলেন তখনও পর্যন্ত তার দেখা ছিল ১১০টি দেশ। এবার পশ্চিম আফ্রিকায় সাহারা মরুভূমির আশেপাশের এই দেশগুলো যোগ করার পর তার ভ্রমণ করা মোট দেশের সংখ্যা দাঁড়ালো ১২৫।
যেখানেই গেছেন তিনি, সাথে করে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের পতাকা। কোন বাংলাদেশী নারীর বিশ্ব ভ্রমণে নিঃসন্দেহে এটা একটা রেকর্ড। তিনি জানালেন, এখানেই শেষ নয়। এই জীবনে বিশ্বের সবকটি দেশই ঘুরে দেখার ইচ্ছে আছে তার।
নাজমুন নাহারকে জিজ্ঞেস করলাম মাথার এই হেয়ার ব্রেইড তিনি কোথায় করিয়েছেন? বললেন, "টোগোতে। স্থানীয় চারজন নারী মিলে চুলের এই স্টাইল তৈরি করে দিয়েছে।"
এর পেছনে কারণ দুটো- প্রথমত: যেখানেই গেছেন সেখানকার মানুষের মতো রূপ নিতে চেয়েছেন তিনি, যাতে স্থানীয় লোকজন তাকে আপন করে নেয়।
"এরকম হলে ওই দেশের সংস্কৃতিকে বোঝা সহজ হয়। বিদেশি কোন পর্যটক যখন বাংলাদেশে এসে আমাদের শাড়ি কিম্বা লুঙ্গি পরেন, আমরাও তো অনেক খুশি হই, তাই না? একারণে ওরাও আমাকে খুব আপন করে নিয়েছে।"
আর দ্বিতীয় কারণ হলো: নিরাপত্তা। "বেনিন হয়ে আমি যখন নাইজেরিয়ায় যাচ্ছি, শুনেছি ওখানে অনেক দুর্ঘটনা হয়। বিশেষ করে নারীদের। তখন আমার মনে হলো আমাকে যদি ওদের মতো দেখায় তাহলে হয়তো অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যেতে পারবো।"
এই দফায় তিনি এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়েছেন সড়ক পথে। শুরু করেছিলেন মৌরিতানিয়া থেকে আর শেষ করেছেন পশ্চিম আফ্রিকার শেষের দিকের দেশ নাইজেরিয়ার লাগোস শহরে। একেকটি দেশে গিয়ে তিনি প্রতিবেশী দেগুলোতে যাওয়ার ভিসা নিয়েছেন। উদ্দেশ্য ছিল সময় ও অর্থের সাশ্রয়।
মিজ নাহার এবার যেসব দেশে গেছেন তার তালিকাটি এরকম: সেনেগাল, মালি, গাম্বিয়া, গিনি বিসাও, গিনি কোনাক্রি, সিয়েরা লিয়ন, লাইবেরিয়া, টোগো, ঘানা, আইভোরি কোস্ট, বুরকিনা ফাসো, নিজার, বেনিন এবং নাইজেরিয়া।
কখনো বাইকে, ভেঙে ভেঙে, কখনো ট্যাক্সিতে বা গাড়িতে, আবার কখনো মিনিবাসে এবং পায়ে হেঁটে হেঁটে তিনি এসব দেশের সীমান্ত পাড় হয়েছেন।
"এসব দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো এতো দুর্গম যে বেশিরভাগ সময় বাইকে যেতে হয়েছে। পাঁচ থেকে ছ'ঘণ্টার পথের জন্যে বাইক ভাড়া করতাম। চালক সামনে আর ব্যাক-প্যাক নিয়ে আমি বসতাম পেছনে।"
তিনি জানান, রাস্তাগুলো একেবারে ভাঙাচোরা। দু'পাশে গভীর অরণ্য। রাস্তায় বড় বড় গর্ত। কখনো কখনো তাকে বাইক থেকে নেমে পায়ে হেঁটে কিছুটা পথ যেতে হতো। হাঁটু পানি ডিঙিয়ে এসব গর্ত পার হয়ে যেতেন তিনি। তারপর আবার চড়ে বসতেন বাইকের পেছনে। এসময় তাকে অনেক পোকামাকড়ের কামড়ও খেতে হয়েছে।
"গিনি বিসাউ সীমান্ত পার হয়ে যখন গিনি কোনাক্রিতে গিয়ে পৌঁছাই, তখন আমি ২২ ঘণ্টা পথে আটকে ছিলাম। রাত তখন তিনটা বাজে। হঠাৎ করে আমাদের গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। আমরা ন'জন প্যাসেঞ্জার ছিলাম। আমিই ছিলাম একমাত্র পর্যটক। দু'পাশে গভীর জঙ্গল আর ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি শুনেছি যে এর আগে এখান থেকে বহু মানুষ অপহরণ করা হয়েছিল। "
তখন তিনি সবাইকে নিয়ে রাতের অন্ধকারের ভেতর দিয়ে একসাথে হাঁটতে শুরু করেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর তারা দূরে একটি গ্রাম দেখতে পান। সেখানে ছিল কয়েকটি শনের ঘর। ওই বাড়ির সামনে গিয়ে বসে পড়লেন তারা।
"যখন ভোর হলো তখন বাড়ির ভেতর থেকে একজন মহিলা বের হয়ে এলেন। আমরা তাকে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। তারা তখন আমাদেরকে সেখানে আশ্রয় দিলো। খাবার দিলো। এর মধ্যে আমাদের গাড়ির চালক শহরে গিয়ে সেখান থেকে মেকানিক নিয়ে ফিরে এলো পরদিন রাতে। গাড়ি ঠিক করে তারপর আবার শুরু হলো আমার যাত্রা।"
মিজ নাহার বলেন, যে ১৫টি দেশে তিনি গিয়েছিলেন এগুলো সাহারা মরুভূমির নিচের দিকে। ফলে তিনি বেশ কয়েকবারই ধূলিঝড়ের মুখে পড়েছিলেন। সব জায়গায় ঠিক মতো খাওয়ার পানিও পাওয়া যায় নি। কোথাও হারিয়ে গিয়েছিলেন জঙ্গলের ভেতরে। কয়েক ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করে আবার পথ খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
"কোথাও দেখা গেল যে হয়তো দশটা গ্রামের মানুষ মিলে একটা টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করছে। বহু দূর থেকে এসে মানুষ প্রতিদিন ভোর বেলায় কলসি দিয়ে সেখান থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পানির সঙ্কট এতোটাই প্রকট ছিল যে পানি না পেয়ে আমি গাছ থেকে মাল্টা পেড়ে তার রস খেয়ে বেঁচে পানির তৃষ্ণা মিটিয়েছি।"
তিনি জানান, আফ্রিকার এসব দেশে গ্রামে-গঞ্জের লোকেরা বাংলাদেশকে চিনতে না পারলেও প্রায় সবকটি প্রধান শহরের লোকেরাই বাংলাদেশকে কম বেশি চেনে। তার একটি কারণ হচ্ছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশি সৈন্যদের ভূমিকা।
"যেমন সিয়েরা লিয়ন, লাইবেরিয়া এবং আইভোরি কোস্টের মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশের সৈন্যরা প্রচুর কাজ করেছে। সেকারণে তারা বাংলাদেশকে বেশ ভালোভাবে চেনে। তারা বলে যে যুদ্ধের সময় তোমাদের সৈন্যরা আমাদেরকে রক্ষা করেছে, খাবার দাবার, ওষুধ ও আশ্রয় দিয়েছে। একারণে বাংলাদেশের জন্যে তাদের অনুভূতিটাও অন্য রকম।"
"এই তিনটি দেশের মাটিতে পা দিয়েই অনুভব করতে পেরেছি এখানকার মানুষ বাংলাদেশকে প্রচণ্ড রকমের শ্রদ্ধা করে," বলেন তিনি।
আফ্রিকার স্থানীয় আদিবাসী লোকজনের বাড়িতে থেকেছেন নাজমুন নাহার। মাটিতে ঘুমিয়েছেন, রাত কাটিয়েছেন জঙ্গলে। কখনও কখনও আদিবাসীদের সনাতন ও ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়েও দিন কাটিয়েছেন তিনি।
এসব মানুষের খাবারের মধ্যে আছে শুটকি দিয়ে শুধু সেদ্ধ ঘাস, ইয়াম নামের আলু ইত্যাদি।
এর আগে তার দেখা ১১০টি দেশের সাথে পশ্চিম আফ্রিকার এই ১৫টি দেশের তফাৎ কোথায়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও দুর্গম পথ আমি সেখানেই পাড়ি দিয়েছি। এতো কষ্ট পৃথিবীর আর কোথাও ভ্রমণ করতে গিয়ে হয়নি।"
তবে তিনি বলেন, এই কষ্টের মধ্যেও তার একটা আনন্দ ছিল একারণে যে তিনি এর ভেতর থেকে জীবনের কঠিন সংগ্রামকে নতুন করে চিনতে পেরেছেন।
"বুরকিনা ফাসোতে দেখেছি মেয়েরা তাদের পেছনে ছোট্ট একটা সন্তানকে কাপড় দিয়ে বেঁধে বাইক চালাচ্ছে। তাদের মাথার ওপর একটা ঝুড়িতে রাখা শাক সব্জি। বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। নারীরা সেখানে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে। তারা দরিদ্র হলেও হৃদয়টা অনেক বড়।"
নাজমুন নাহার এর আগে পূর্ব আফ্রিকার প্রতিটি দেশ ভ্রমণ করেছেন। এবার দেখলেন পশ্চিম আফ্রিকা। তিনি জানান, তার এর পরের গন্তব্য মধ্য আফ্রিকা।
কয়েক মাস বিরতি দিয়ে তিনি যাবেন সেখানে এবং তখনই সম্পূর্ণ হবে তার আফ্রিকা দর্শন।