বাকরখানি : পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার
- আলমগীর হোসেন
- ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:১২, আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:২৩
কাকডাকা ভোর। চারদিকে সুনসার নীরবতা। পুরান ঢাকার দালানগুলোতে কেবল আলো জ্বলতে শুরু করেছে। এমন সময়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন আশরাফ উদ্দীন। আটা দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি করছেন এক ধরনের রুটি, যার নাম বাকরখানি। আর এ বাকরখানি পুরান ঢাকাবাসীর এক পছন্দের খাবার। অতিথি আপ্যায়নে বাকরখানির রয়েছে বিশেষ কদর। সকাল বা বিকাল চা-বাকরখানি ছাড়া নাস্তা যে চলেই না। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছেই সমান পছন্দের খাবার এটা, যা পুরান ঢাকার আড়াই শ’ বছরের ইতিহাস বহন করে।
আশরাফ উদ্দীন গেন্ডারিয়ার নামাপাড়া এলাকার বাকরখানি দোকানের কর্মচারী। দোকানের পিছনেই রয়েছে ছোট্ট থাকার ঘর। সেখানেই থাকেন। প্রায় ২০ বছর ধরে বাকরখানির দোকানে কাজ করছেন তিনি। আগে সামান্য বেতন পেতেন। এখন থাকা-খাওয়া বাদে ১৫ হাজার টাকা বেতন পান। তা দিয়েই চলে পাঁচ সদস্যের পরিবার। দু’ ছেলে মাদরাসায় লেখাপড়া করে। মেয়েটাকেও ভর্তি করাবেন মাদরাসায়।
আশরাফ উদ্দীনের পাশেই খামি থেকে ছোট ছোট রুটি তৈরি করছেন রিফাত নামের এক তরুণ। তিনিও কাজ করেন দোকানে। তার বাবাও এই কাজ করেছেন দীর্ঘ ৩৫-৩৬ বছর। বর্তমানে তার বাবা আর পারছেন না। আশরাফ উদ্দীন চুলায় রুটি দিতে দিতে বলেন, ‘এটা অনেক আগের দোকান। মহাজনের বাপ-দাদাও একই কাজ করেছেন।’ চুলায় রুটি দেয়া, শিক দিয়ে রুটি তোলা এসব কাজের পাশাপাশি বেচা-বিক্রিও করছেন তিনি।
কথা হলো বাকরখানি কিনতে আসা চল্লিশোর্ধ্ব সেলিনা আক্তারের সাথে। তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকাতেই আমার বেড়ে ওঠা। ছোট থেকেই বাকরখানি খাচ্ছি। বাবাও এটা খুব পছন্দ করতেন। সকালের নাস্তায় এটা না হলে চলে না।’
তিনি হাতের বাকরখানির দিকে ইশারা করে বলেন, ‘এই দেখতেছেন না বাকরখানি, এটা না হলে আমার মেয়ে সকালে নাস্তা করবে না। তা অবশ্যই থাকতেই হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার বাবাও একই দোকান থেকে বাকরখানি কিনতেন। তবে তখন দাম অনেক কম ছিল।‘
ধোলাইখাল হয়ে নারিন্দা রোড ধরে সামনে এগোতেই চোখে পড়ল ‘বাদশাহর বাকরখানি’ লেখা লাল সাইনবোর্ড। কথা হলো দোকানের মালিক বাদশাহর সাথে। তিনি বলেন, ‘বাকরখানি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার। ৩৫ বছর আগে চাচার হাত ধরেই আমার এখানে আসা। আজও করছি। চাচাও অনেক আগে থেকেই এটা করতেন।’
তিনি জানান, প্রতিদিন ১০০-১২০ কেজি বাকরখানি বিক্রি করেন তিনি। দোকানে আরও পাঁচজন কর্মচারী রয়েছেন। থাকা-খাওয়া বাদে ১৫ হাজার টাকা করে বেতন দেন তাদের। ফজরের আজানের সময় থেকে শুরু করে কাজ চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। দুপুরের পর কয়েক ঘণ্টা ছুটি পান কর্মচারীরা।
তিনি আরো বলেন, ‘আমার দোকানে মোট ছয় ধরনের বাকরখানি পাওয়া যায়।
ঘি, পনির, তিল, চিনি ও নোনতা বাকরখানি। নোনতা বাকরখানি আবার দু’ ধরনের-পাতলা খাস্তা ও মোটা খাস্তা।’ বাদশাহ জানান, পরবর্তী প্রজন্ম এই কাজে আসতে চাচ্ছে না। আমিও চাই না আমার ছেলে এই কাজে আসুক। এটা অনেক কষ্ট, বিশেষ করে গরমের দিনে। সারাদিন আগুনের পাশে থাকতে হয়।’ ভবিষ্যতে এই ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বাকরখানি কিনতে নারিন্দা রোডে আসেন আইনজীবী সাহেদ সারওয়ার চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে এটা খেয়ে অভ্যস্ত। নাস্তাতে এটা থাকতেই হয়। তবে আমার ছেলে-মেয়েরা এটা তেমন পছন্দ করে না। তাদের পছন্দ পিৎজা, বার্গারসহ নানা ফাস্ট ফুড (খাবার)।’
ক্রেতার আশায় বসে আছেন আরেক দোকানি সুমন মিয়া। তিনিও আট বছর ধরে বাবার কাজে সাহায্য করছেন। তিনি বলেন, ‘বাবা কাজ করছেন ৩০ বছর ধরে। স্বাধীনতার দু’ মাস পর থেকেই আমার দাদা এটা শুরু করেছিলেন। আমরা বংশানুক্রমিকভাবেই এটা করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘দু’ জন কর্মচারীর বেতনসহ সব খরচ বাদে মাসে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আয় আসে এই ব্যবসা থেকে।’ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তিনি এমন পেশায় দেখতে চান কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকেরই আশা থাকে সন্তানাদি ভালো চাকরি-বাকরি করবে। তবে এই ব্যবসাও খারাপ না, এটা খানদানি ব্যবসা।’
পুরান ঢাকার চকবাজার, নাজিরাবাজার, বংশাল, ইসলামবাগ, হাজারীবাগ, সিদ্দিকবাজার, বনগ্রাম, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, একরামপুর, গেণ্ডারিয়া, নারিন্দা, দয়াগঞ্জসহ প্রায় সব এলাকায় রয়েছে বাখরখানির দোকান। পুরান ঢাকায় অনেক পরিবার বংশপরম্পরায় বাখরখানির কারিগর।
বাকরখানির মূল উপাদান ময়দা, দুধ, লবণ, ডালডা, ঘি ও তেল। বিশেষ কায়দায় টেনে টেনে বেলে খামির সাথে মেশানো হয় শুকনো ময়দা।
রুটির গায়ে তিনটি পোচ দেয়া হয় যাতে তা ফেটে না যায়। রুটির উপর হালকা পানির প্রলেপ দিয়ে তা দেয়া হয় সুতি কাপড়ের এক বড় পুটুলির গায়ে।
তারপর বিশেষ কায়দায় তা সেটে দেয়া হয় জ্বলন্ত তন্দুরের গহ্বরে। মিনিটদশেকের মধ্যেই তা লালচে আকার ধারণ করে। সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
জানা যায়, জমিদার আগা বাকের খাঁর নামানুসারে এ রুটির নামকরণ করা হয়। নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর দত্তক ছেলে আগা বাকের। কথিত আছে, মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগমের সাথে তার গভীর প্রেম ছিল। তার প্রিয় খাদ্য বিশেষভাবে তৈরি এই রুটির নামকরণও করা হয় তার প্রেমকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই।
পরে এই নাম কিছুটা অপভ্রংশ হয়ে বাকরখানি নাম ধারণ করে। নবাব পরিবারের বাবুর্চিরাই এ বাকরখানির আবিষ্কারক। স্যার সলিমুল্লাহ্ থেকে শুরু করে নবাব পরিবারের সকল সদস্যই ছিলেন বাকরখানির ভক্ত। তাদের সকালের নাশতায় গোশত ও বাকরখানি থাকতই। পরে আস্তে আস্তে বাকরখানির চাহিদা ছড়িয়ে পড়ে এলাকাবাসী সবার মধ্যে। যা এখনো রয়ে গেছে।