বিশ্বের জনবহুল শহর ঢাকা
- মুহমুদুল হাসান
- ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
দেশে দ্রুত বাড়ছে শহুরে মানুষের সংখ্যা। বর্তমানে এ বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের প্রক্ষেপণ বলছে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ হবে শহুরে। যদিও ঢাকার জনসংখ্যা বাড়ছে আরো দ্রুতগতিতে। গত দুই দশকে ঢাকার জনসংখ্যা দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে। ঢাকাই এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর। পরিবেশ দূষণের কারণে ঢাকায় আর্থিক ক্ষতিও তাই বেশি। ২০১৫ সালে দূষণের কারণে ঢাকায় মারা গেছে ১৮ হাজার মানুষ। একই কারণে ঢাকাবাসীর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে পাঁচ লাখ ৭৮ হাজার ঘণ্টা। বছরটিতে দূষণের কারণে শুধু ঢাকায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৪৪ কোটি ডলার, ওই সময় দেশের মোট জিডিপির যা দশমিক ৭ শতাংশ। আর্থিক ক্ষতি পরিমাপে পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি বায়ুদূষণের কারণে পোশাক শিল্পে উৎপাদনশীলতা হ্রাস, শিল্পকারখানার সিসা দূষণে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা কমে যাওয়া এবং বায়ুদূষণে মৃত্যুকে হিসাবে নেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দেশে মোট মৃত্যুর ২৮ শতাংশের জন্য দায়ী পরিবেশ দূষণ। এ হার বৈশ্বিক গড় এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সর্বোচ্চ। পরিবেশ দূষণে মৃত্যুজনিত শ্রমের ক্ষতি বিবেচনায় নিলে এর আর্থিক মূল্য বছরে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে নগরায়নের মতো দেশে শিল্পায়নও হচ্ছে দ্রুত। তবে তা পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ না করেই। নিয়ন্ত্রণহীন এ দূষণ ক্ষত বাড়াচ্ছে অর্থনীতির।
দেশের তিনটি জেলা ঢাকা, কক্সবাজার ও পাবনার ওপর ২০১৫ সালে একটি জরিপ চালায় বিশ্বব্যাংক। জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে তৈরী ‘এনহ্যান্সিং অপরচুনিটিজ ফর ক্লিন অ্যান্ড রেজিলিয়েন্ট গ্রোথ ইন আরবান বাংলাদেশ : কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিবেশ দূষণে ২০১৫ সালে শুধু শহরাঞ্চলেই মারা গেছে ৮০ হাজার ২৯৪ জন। বায়ুদূষণ, আর্সেনিকযুক্ত পানি, কর্মক্ষেত্রে দূষণজনিত কারণে মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ২৬ লাখ ২৭ হাজার ৯২৬ ঘণ্টা। দূষণের কারণে মৃত্যু ও কর্মঘণ্টা হারিয়ে যাওয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতি ৬৫২ কোটি ডলার বা ৫১ হাজার কোটি টাকা । এই ক্ষতি ওই সময় দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। যদিও পরিস্থিতির উন্নয়নে সুনজর নেই বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, বিশ্বের দূষণপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম তদারকি ও আইনের প্রয়োগ হচ্ছে। শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্য নদী-খালে গিয়ে পড়ছে, যা রাজধানীর আশপাশ এলাকার দরিদ্র মানুষের মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পরিবেশ দূষণের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর রাজশ্রী পারালকার প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, নগর এলাকায় পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। সবুজ প্রবৃদ্ধির জন্য সঠিক নীতি ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পকারখানায় পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতে এখনই পদক্ষেপ থাকা দরকার।
পরিবেশ দূষণের সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, প্রায় ১০ লাখ দরিদ্র মানুষ সিসা দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শিশুর বুদ্ধিমত্তা (আইকিউ)। নারীদের গর্ভপাত ও মৃত সন্তান প্রসবের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেতে পারে।
এখানকার উন্নয়ন অনেকটা আরোপিত মন্তব্য করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, মানুষ চায়, তেমন উন্নয়ন হয় না। এ উন্নয়ন কোনোভাবেই টেকসই নয় বরং আত্মঘাতী। আমরা যাকে উন্নয়ন বলছি, সেটা যে জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে, তা বুঝতে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন প্রয়োজন হয় না। দুঃখজনক হলো, বিশ্বব্যাংক আগেও এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করেছিল। এটা নিয়ে যাদের কাজ করার কথা, তারা আদৌ চিন্তিত নয় বলে মনে হচ্ছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন বড়-ছোট সব ধরনের নগরের ওপরই প্রভাব রাখছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, গত ৪০ বছরে ঢাকা প্রায় ৭৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়েছে। জলাভূমি ভরাট করে বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে নগরের বিভিন্ন অংশ বন্যার সময় প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ছোট নগরগুলো পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে। ১৯৯০ সাল থেকে পাবনা অর্ধেক জলাভূমি হারিয়েছে। মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে জেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতী নদী।
অবৈধ দখল রোধ ও খাল-জলাভূমি রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে জানান বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক প্র্যাকটিস ম্যানেজার কেসেনিয়া লভভস্কি। তিনি বলেন, এটা করা সম্ভব। আমরা মাধবদীতে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার সাফল্য দেখেছি। সেখানে দেখা গেছে, নগর পরিকল্পনায় স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ, সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃঢ় মনোবলের স্থানীয় নেতৃত্ব অপরিকল্পিত নগরায়ন ও দূষণের ধারা পাল্টে দিতে পারে।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। পরিবেশের উন্নয়নে নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ তার নীতি ও আইনি কাঠামোর উন্নতি করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে। ইটভাটা ও অন্যান্য দূষণকারী শিল্পে পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি চালু করেছে। প্রধান নগরগুলোয় নিরবচ্ছিন্ন বায়ুর গুণমান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে।
পরিবেশ দূষণ নতুন কিছু নয় জানিয়ে তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের পাশে গেলে এটি আরো পরিষ্কার হয়। তারপরও আমরা পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে দখলকৃত সব জমি উদ্ধারে কাজ চলছে। বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। দখলকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার নিয়ম করা হচ্ছে। তাদের জরিমানার আওতায় আনতে জমি বিনিময় প্রথাসহ কার্যকর বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তর করা হয়েছে।