২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

লেগুনা বন্ধ কতটা বাস্তব?

-

রাজধানীতে বিকল্প গণপরিবহনের ব্যবস্থা না করেই হঠাৎ লেগুনা বন্ধ ঘোষণা করার পর আবার যথারীতি চলতে দিচ্ছে যানবাহনটি। গণপরিবহনের তীব্র সঙ্কট ও সব রাস্তায় বাস চলাচল না করার অজুুহাতে হিউম্যান হলার বা লেগুনা সার্ভিস নগরীর প্রধান সড়ক ও শাখা রাস্তাগুলোয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঝুঁকি সত্ত্বেও দ্রুত গন্তব্যে যেতে এটিতে অভ্যস্ত নগরীর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ। শিশুরা লেগুনার হেলপার হিসেবে কাজ করছে এবং এমনকি অনেক শিশু লেগুনার মতো ছোট বাহন চালাচ্ছে, যা এসব শিশুর পাশাপাশি যাত্রীদেরও ঝুঁকির কারণ হচ্ছে। অনেক গাড়ির হেলপারের বয়স ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। এর চেয়ে কম বয়সেরও আছে। এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। অনেক সময় দেখা যায়, ড্রাইভার ক্লান্ত হয়ে হেলপারকে দিয়ে গাড়ি চালায়। তখন দুর্ঘটনা ঘটে।
এ গাড়ির চালকদের অধিকাংশের কাছেই ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অল্পবয়সী কিশোরের হাতে স্টিয়ারিং থাকায় ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে ছুটতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এ কারণে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। যদিও মোটর ভেহিক্যাল অ্যাক্ট, ১৯৮৩ অনুযায়ী, ২১ বছর বয়সী পেশাদার চালককে প্রথমে হালকা যান চালনার জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়। অথচ লেগুনা চালকদের ৯০ শতাংশের বয়স ১৫-১৮-এর কোটায়। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছেÑ চার চাকার এই গাড়িতে হেলপার হিসেবে দায়িত্বরতরা প্রায় সবাই ৮-১০ বছর বয়সী শিশু। অনেক সময় এরাও চালকের ভূমিকায় থাকে। কিন্তু এ যানকে নিরাপদ রাখার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তৎপরতা দেখা যায় না।
মহাসড়কে লেগুনা চলাচলে প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ায় গত ২৭ আগস্ট সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় লেগুনা চলাচলে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর ডিএমপি রাজধানীতেও লেগুনা বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। ওই ঘোষণার আগে লেগুনার বিকল্প পরিবহন কী হতে পারে তা নিয়ে ডিএমপি অংশীজনদের নিয়ে কোনো বৈঠকও করেনি। রাজধানীর ১৫৯টি রুটে প্রায় ছয় হাজার লেগুনা চলাচল করে। বন্ধের পর যাত্রীরা বিপাকে পড়লে জনদুর্ভোগের বিষয়টি সামনে এনে ডিএমপি রাজধানীর শতাধিক রুটে আবার লেগুনা চলতে দিচ্ছে। পুলিশের দাবি, প্রধান সড়ক ছাড়া সংযোগ সড়কে লেগুনা চলাচলের সুযোগ দেয়া হয়েছে। যদিও গতকাল রাজধানীর গুলিস্তান, পান্থপথ, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন স্থানে প্রধান সড়কেও দাপিয়ে লেগুনা চলতে দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় লেগুনা চালু করতেই হতো। কারণ বিকল্প যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। বাস সঙ্কট তীব্র হওয়ায় বিভিন্ন রুটে লেগুনা ভরসা হয়ে উঠেছে যাত্রীদের।
লেগুনা হঠাৎ বন্ধ করে আবার চালু করার কারণ খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পরিবহন নেতা ও পুলিশের চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখতেই মূলত লেগুনা চালু করা হয়েছে। পরিবহন মালিক, চালক, লাইনম্যানসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন হারে প্রতিটি লেগুনা থেকে দিনে চাঁদা তোলা হচ্ছে গড়ে ৭০০ টাকা। বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ২০০ রুটে ছয় হাজার লেগুনা থেকে দিনে চাঁদা তোলা হয় প্রায় ৪২ লাখ টাকা। এই চাঁদা যায় মালিক সমিতি, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের নেতা এবং শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের হাতে। এর বাইরে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশকেও দিতে হয় গোপন চাঁদা। এটি মূলত মালিক সমিতির মাধ্যমে দেয়া হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ অটোরিকশা, অটো টেম্পো পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক বলেন, পরিবহন ব্যয় পরিচালনার জন্য চাঁদা নেয়ার রীতি রয়েছে। আমাদের পায়ে পায়ে চলায় দোষ আছে। তাই পুলিশও সুবিধা নেয় বলে অভিযোগ আছে। তবে এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে বর্তমান পুলিশ কমিশনার আন্তরিক। লেগুনা বন্ধ থাকলে চাঁদার উৎসও বন্ধ থাকে। ফলে তা চালু করতে উঠেপড়ে লাগে মালিক ও শ্রমিক নেতাদের বড় একটি অংশ। ওই নেতারা অজুহাত দেখান, নির্বাচন সামনে রেখে গণপরিবহনের ব্যাপক সঙ্কটের এ সময়ে লেগুনা বন্ধ রাখলে জনদুর্ভোগ হবে এবং তাতে ভোট কমে যেতে পারে। এই যুক্তি দেখিয়ে তারা লেগুনা আবার চালুর জন্য চাপ দেয় পুলিশ প্রশাসনকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আবার চালু হয়েছে লেগুনা।
লেগুনা বন্ধ ঘোষণার পর পুলিশ বিকল্প যানবাহন কী হতে পারে তা নিয়েও পথ বের করতে পারেনি। গত ১০ সেপ্টেম্বর ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বৈধ কাগজপত্র আছে এমন লেগুনা সীমিতভাবে চলাচলের সুযোগ দেয়ার কথা মালিক ও নেতাদের জানানো হয়।
গতকাল আগারগাঁও বেতার ভবনের সামনে থেকে ৬০ ফুট সড়ক ধরে মিরপুর ২ নম্বর সড়কে চলতে দেখা গেছে লেগুনা। বিকেলে ৬০ ফুট সড়কে মহানগর ডিজিটাল সিটি পরিবহন, ঢাকা ইন্দিরা পরিবহনের লেগুনায় অবিরত যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছিল।
মহানগর ডিজিটাল সিটি পরিবহনের ২০টি লেগুনার রুট পারমিট আছে। এগুলোই চলছে ৬০ ফুট সড়কে। এর বাইরে প্রধান সড়কে কোনো লেগুনা চলছে না। ঢাকা ইন্দিরা পরিবহন লিমিটেড কোম্পানির ২০টি লেগুনা ফার্মগেট থেকে মিরপুরের বড়বাগ পর্যন্ত চলছে।
ফার্মগেট থেকে নিউ মার্কেট রুটে চলাচল করতে দেখা যায় একের পর এক লেগুনা। এই রুটে আনন্দ পরিবহনের লেগুনা আগে চলত ৫০টি, এখন চলছে ২০টি। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে ঢাকা থেকে তিন চাকার ৪০ হাজার অটো-টেম্পো তুলে দিয়ে বিকল্প হিসেবে নামানো হয়েছিল কমসংখ্যক সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও লেগুনা। বিআরটিএর গত জুলাই মাসের পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা আছে প্রায় ১৩ হাজার। এগুলোর আয়ুও শেষ হয়ে গেছে।
চাঁদাবাজি
একই সংগঠনের নামে মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে একেকটি লেগুনা থেকে দিনে চার দফায় ৫০ টাকা করে ২৫০ টাকা চাঁদা নেয়ার অভিযোগ আছে। লেগুনাচালকেরা জানান, ঢাকা জেলা হালকা যানবাহন সড়ক পরিবহন ইউনিয়নের (ঢাকা-২১২৪) বনানী, তেজগাঁও, শিল্পাঞ্চল ও কাফরুল থানা কমিটির নামে এই চাঁদা নেয়া হয়। জানা গেছে, গাবতলী, সিপাহীবাগ, গুলিস্তান, জিগাতলা, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে এভাবে বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদা তোলা হয়।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমশিনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা প্রধান সড়কে লেগুনা চালাতে বারণ করেছি। লেগুনায় চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু অনিয়ম তো আছে। ধীরে ধীরে তা নিয়মে আনতে হবে। আমাদের নিয়মিত তদারকি আছে।
মতামত
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ঢাকা মহানগরীতে লেগুনাজাতীয় হিউম্যান হলার যদি হঠাৎ করে নিষিদ্ধ করা হয়, তা হলে তা বাস্তবায়ন কঠিন। দীর্ঘ দিনের অভ্যস্ত মানুষ বিকল্প বাহন খুঁজবে। আমরাও লেগুনা চলাচল বন্ধের পক্ষে। কিন্তু এর আগে দরকার মানুষের যাতায়াতে বিকল্প ব্যবস্থা করা। রুট ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোম্পানির আওতায় গণপরিবহন নিশ্চিত করা জরুরি। নতুবা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। মহাসড়কেও লেগুনার মতো ছোট যান নিষিদ্ধ করা আছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। মহাসড়কের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের ফিডার রোড যুক্ত হয়ে গেছে। দরকার ধীরগতির যানবাহনের পৃথক লেন। বিভিন্ন এলাকার জনসাধারণ যাতায়াতের জন্য হালকা গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। হিউম্যান হলার বন্ধ করেল এখন তারা কিভাবে যাতায়াত করবেন সে পথও থাকা উচিত।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বলেন, লেগুনার মতো হালকা যান গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা বাড়াচ্ছে। আমরা চাই, এগুলো বন্ধ হোক। তবে সমাধানের পথও আগে বাতলে দিতে হবে। যাতে নতুন করে বিশৃঙ্খলা না হয়।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেন, এনফোর্সমেন্টের মূল কাজই পুলিশের। তারা যদি লেগুনা বন্ধ করতে চায়, করুক। গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগ নিতেই পারে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement