২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এক মিল্টনের শতাধিক মা-বাবা

এক মিল্টনের শতাধিক মা-বাবা - ছবি : নয়া দিগন্ত

শরীরে নানা রোগের বাসা। মাটি খেয়ে ফেলেছে শরীরের বিভিন্ন অংশ। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু কোলে ডলে পড়ছিলে শান্তি বেগম! কয়েক দিন আগে রাজধানী মিরপুরের একটি ডাস্টবিনের পাশে পড়েছিলেন মৃত্যু পথযাত্রী এই বৃদ্ধা। খবর পেয়ে মানবিক ডাকে সাড়া দিতে ছুটে যায় চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের কর্মীরা। এই আশ্রমের কর্মীদের নিরলস সেবায় এরই মধ্যে বৃদ্ধ শান্তি বেগম অনেকটা সুস্থ। শুধু শান্তি বেগমই নয়, তার মতো পরিবারহীন, অজ্ঞাত, অসহায় ও রাস্তায় পড়ে থাকা তিন হাজারের বেশি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শিশু এখন পর্যন্ত সেবা পেয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির আশ্রয়ে রয়েছে ১০৪ বৃদ্ধ ও ১৬ শিশু। এখন পর্যন্ত পরিচয় না-জানা শতাধিক ব্যক্তির দাফন করেছে এই প্রতিষ্ঠান। মানব সেবায় প্রায় এক দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছেন এর প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দার।

শুরুটা হয়েছিলো যেভাবে
মিল্টন সমাদ্দার ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। যিনি পেশায় নার্স। বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ এই কালজয়ী গানে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৪ সালে রাজধানীর কল্যাণপুর পাইকপাড়ায় (বাড়ি : ৪৬২, সড়ক : ০৮ দক্ষিণ পাইপাড়া) ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য এর প্রতিষ্ঠার পিছনে আছে এক মানবিক গল্প।

২০১৪ সালের কোনো একদিন। কাজ সেরে বাসায় ফিরছিলেন মিল্টন সমদ্দার। রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধের দুই পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। কোন কিছু না ভেবেই মিল্টন তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন নিজের বাসায়। নিজ হাতে গোসল করালেন। পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিয়ে খাওয়ালেন। পরিচয়হীন বৃদ্ধাকে পরম যত্নে মরণাপন্ন অবস্থা থেকে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু অসহায় বৃদ্ধের যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকায় তাকে আশ্রয় দিলেন মিল্টন। সেই থেকে শুরু। এখন প্রায় এক দশক হতে চললো। বর্তমানে এমন শতাধিক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শিশুর আশ্রয় হয়েছে দেশের ব্যতিক্রমী এই প্রতিষ্ঠানে।

পরম শ্রদ্ধায় চির বিদায়
আমাদের সমাজে এমন অনেকেই আছে যাদের পরিবার থাকার পরও চির বিদায় বেলায় তারা অজ্ঞাত। পরিবারহীন, অসহায় ও অজ্ঞাত শতাধিক ব্যক্তিকে মৃত্যুর পর যথাযথ সম্মানের সাথে কবরস্থ করেছে এই প্রতিষ্ঠান।

শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই মৃত্যুবরণ করেছে এমন পাঁচ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এদের কারোই পরিচয় জানা যায়নি। সবার মতো এই বৃদ্ধাদেরও প্রত্যাশা ছিল মৃত্যু হবে আপন গৃহে, স্বজনদের কাছে। কিন্তু এই বৃদ্ধদের স্বপ্ন স্বজনরা পূরণ না করলেও পরিবার প্রত্যাখ্যাত এই ব্যক্তিদের জীবনের শেষ ইচ্ছা পূরণ করছে ব্যতিক্রমী এই প্রতিষ্ঠান।

মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম
পরিবারহীন কুড়িয়ে পাওয়া শিশু এবং শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে গেল ডিসেম্বরে চালু করেছে মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির আশ্রয়ে বর্তমানে ১৬টি শিশু রয়েছে। এদের মধ্যে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ শিশুরা শিক্ষার আওতায় এসেছে। শিশু রাতুল ও তায়্যেবা এরই মধ্যে শিখেছে বেশ কয়েকটি সূরা। চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের পাশাপাশি স্থানীয় ৭১টি শিশু শিখছে ধর্মীয় শিক্ষা।

কিভাবে চলে দেশের বৃহৎ এই আশ্রম?
ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা দেশে বৃহৎ এই আশ্রমে প্রতি মাসে খরচ হয় ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু কিভাবে ম্যানেজ হয় এত টাকা? জানতে চাইলে পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার জানান, তিনি ও তার স্ত্রী দু’জনেই পেশায় নার্স। এছাড়া ‘মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লি:’ নামে তাদের একটি নার্সিং এজেন্সি আছে। যেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবা দেয়া হয়। প্রথম দিকে তাদের উপার্জিত অর্থ দিয়েই চলতে আশ্রমটি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আশ্রমে অসহায় বৃদ্ধ ও শিশুদের সংখ্যা বাড়েছে। ফলে খরচও বেড়েছে কয়েকগুণ। তবে মানবিক এই কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন বহু মানুষ।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজ ও প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দারের ফেসবুক পেজে মিলে ৫০ লাখ ফলোয়ার ছাড়িয়েছে। বর্তমানে এই ফেসবুক পেজের মাধ্যমেই দেশ ও দেশের বাইর থেকে অনেকেই সহযোগিতা করেন। তবে করোনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশের বৃহৎ এই আশ্রম বিভিন্ন সংকটের মধ্যদিয়ে কার্যক্রম চলমান রেখেছে। মানবিক এই কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং মানুষকে মানুষের মতো ভালোবাসতে সবার এগিয়ে আসা জরুরি বলে মনে করেন আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দার।

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকের বক্তব্য
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার আমৃত্যু মানুষের সেবায় কাজ করে যেতে চান। তার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, মানুষ কখনো রাস্তায় থাকতে পারে না। আমরা চেষ্টা করছি, পরিচয়হীন, অজ্ঞাত, অসুস্থ, রাস্তায় পড়ে থাকা বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধী ও অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়াতে। বিশেষ করে রাস্তায় পড়ে থাকা যে সব ব্যক্তি চলাফেরার ক্ষমতাটুকু হারিয়ে অচল হয়ে পড়েছে, কিংবা শরীরে পচন ধরেছে তাদের সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবন ফিরে দিতে।

আমাদের আশ্রয়ে থাকা বাবা-মায়েদের সুষম খাদ্য, বস্ত্র, নিরাপদ আবাসন, উন্নত চিকিৎসাসহ সব ধরনের পরিচর্যা ও সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। একইসাথে পরিচয় বা ঠিকানা খুঁজে তাদেরকে পরিবারের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। তাছাড়া এদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে যথাযথ সম্মানের সাথে আমরা তাদের দাফন বা সৎকারের ব্যবস্থা করছি।

এছাড়াও বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ নানা সংকটেও মানুষের পাশে ছুঁটে যান তিনি। প্রত্যাশা করে বলেন, এই বছর আমার স্বপ্নের স্থায়ী আবাসন নির্মাণ হতে যাচ্ছে। গত বছর সাভারে ২৫ শতক জায়গা কিনেছি। স্থায়ী আবাসন নির্মাণ হলে আশা করি প্রথম অবস্থায় ৪০০-৫০০ ব্যক্তিকে আশ্রয় দিতে পারবো। বৃহৎ এই কাজ দেশের দানশীল মানুষদের সহযোগিতায় সম্ভব হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, একদিন রাস্তায় থাকবে না কোনো অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবা ও কোনো শিশু।

সহযোগিতা করতে :
এই প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়া শতাধিক বৃদ্ধ বাবা-মা ও শিশুর দায়িত্বভার আমাদের সবার। সহযোগিতা করতে যোগাযোগ করুন-
পরিচালক- মিল্টন সমাদ্দার (০১৬২০-৫৫৫২২২ ও ০১৬২৬৫৫৫২২২), বিকাশ- ০১৬২৬৫৫৫২২২ (ব্যক্তিগত), বিকাশ- ০১৬১৫৫৫৪৪৪৪ (ব্যক্তিগত), নগদ- ০১৬১৫৫৫৪৪৪৪ (ব্যক্তিগত), রকেট-০১৬১৫৫৫৪৪৪৪৬ (ব্যক্তিগত), বিকাশ- ০১৯৫৫৫৪৫৩৩৩ (পেমেন্ট), ব্যাংক একাউন্ট : Child & Old Age Care, Account Number: 15011200000044, Bank Name: Premier Bank, Bank Address: Shyamoli Branch.


আরো সংবাদ



premium cement