আসছে ‘বেল্ট রোড সামিট টু’ ঝড় : চীনা দাপটে উড়ে যাবে সবাই!
- গৌতম দাস
- ১৫ এপ্রিল ২০১৯, ০৫:৫৩
গ্লোবাল অর্থনীতিতে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে আমেরিকার বদলে চীন মূল ভূমিকা নেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়েই চলেছে এবং এই পরিবর্তনে চীনের জিডিপি সব সময় ইতিবাচক থেকেছে, যদিও সময়ে তা কম-বেশি হয়েছে। তবে কখনোই এখন পর্যন্ত তা (জিডিপি-৬) এর নিচে নামেনি। অগ্রগতির সে বিচারে গত কয়েক মাস ছিল চীনের দিক থেকে খুবই নির্ধারক কিছু ঘটনা চীন ইতিবাচক সাফল্যের সাথে পার হয়েছে। আর এমন সাফল্যের ওপর চড়ে চলতি এপ্রিল মাসে চীন আরেক সাফল্য লাভ করতে যাচ্ছে, যা আগামী ইতিহাসে চীনা উত্থানের দ্বিতীয় পর্যায় বলে চিহ্নিত হবে মনে হচ্ছে। কিন্তু কী সেটা?
চীনা বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ (বিআরআই) সম্পর্কে এত দিনে আমরা সবাই কমবেশি জেনে গেছি যে, এটা ৬৫টিরও বেশি রাষ্ট্রকে একসাথে ভৌত অবকাঠামোগতভাবে সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথে কানেক্ট করার এক মহাপ্রকল্প। কাঠামোগতভাবে এটা মূলত এশিয়া ও সারা ইউরোপকে সংযুক্ত করে ফেলার প্রকল্প। আর এর সাথে মাঝখানে সেন্ট্রাল এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের সবাই যুক্ত হবে। আর ওই দিকে এই কানেক্টিভিটি প্রকল্পের আরেক প্রান্ত কেনিয়া ও ইথিওপিয়া দিয়ে পূর্ব আফ্রিকার সাথেও সংযুক্ত হবে। এ ছাড়া পুরো প্রকল্পই স্থানে স্থানে ছয়টিরও বেশি গভীর সমুদ্রবন্দর দিয়ে সমুদ্রপথের সাথেও যুক্ত থাকবে। আইডিয়া হিসেবে বিআরআই উদ্যোগের মূল ধারণা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রথম হাজির করেছিলেন অক্টোবর ২০১৩ সালে, যা গত ২০১৭ সালের মে মাসে প্রথম সামিট (বা সদস্য রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানদের নিয়ে সভা, বেল্ট রোড সামিট) নামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে অবশ্য মূল আলোকপাত ছিল- কোন কোন রাষ্ট্র এই বড় প্রকল্পের অংশ হতে চায় তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো। আজ এই ২০১৯ সালের চলতি এপ্রিল মাসের শেষে ‘বেল্ট রোড সামিট টু’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সামিট টু কেন গুরুত্বপূর্ণ বা এর মূল তাৎপর্য কী হতে যাচ্ছে?
বেল্ট রোড অবকাঠামো প্রকল্পের মূল কাঠামো হলো মূলত এশিয়া ও সারা ইউরোপকে সব উপায়ে সংযুক্ত করে ফেলা। অর্থাৎ এশিয়ার অপরপ্রান্ত হবে ইউরোপ, এত দিন যা খুবই সীমিত সুযোগে কানেক্টেড ছিল। আর এখানে ইউরোপ মানে সারা ইউরোপ; অর্থাৎ ২৫ সদস্য রাষ্ট্রের ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্ত হবে। যদিও সংখ্যায় ২৫ অনেক বেশি, কিন্তু আসলে ইউরোপের প্রভাবশালী মাতবর চার থেকে আট রাষ্ট্র, যারা যেকোনো সিদ্ধান্তের নির্ধারক। এই প্রথম চার রাষ্ট্রের মধ্যে মূল দুই রাষ্ট্র আবার হলো ফ্রান্স ও জার্মানি। এর সাথে আর দুই রাষ্ট্র ব্রিটেন আর ইতালি। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির রাষ্ট্রজোট হলো ‘গ্রুপ সেভেন’ বা জি-৭। ইউরোপের সেই চার রাষ্ট্র ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, ইতালি- এই চার রাষ্ট্রই হলো ‘গ্রুপ সেভেন’-এর চার সদস্য; আর বাকি কানাডা, আমেরিকা ও জাপান মিলে পূর্ণ হয় ‘গ্রুপ সেভেন’।
বিআরআই উদ্যোগের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে এর অপর প্রান্ত ইউরোপ। অথচ ২০১৭ সালে প্রথম বেল্ট রোড সামিট অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত এর অগ্রগতি ও অর্জন মাপার ক্ষেত্রে বড় খামতির দিক ছিল যে, সেকালে পর্যন্ত ইউরোপের কে কে বা বিশেষ করে প্রভাবশালী চার রাষ্ট্রের কাউকে এই প্রকল্পে যোগ দিতে আগ্রহী করাতে পারেনি বা কমপক্ষে কাউকে দিয়ে আনুষ্ঠানিক ওয়াদা চীন আদায় করতে পারেনি। সেই খমতিই এবার পূরণ হতে চলেছে।
তবে এত দিন চীন কেন তা পারেনি তা বুঝতে প্রথমত চীনের কাছে জি-৭ কী, এটা বুঝলে অনেকটাই স্পষ্ট হবে সমস্যার জটিলতা কোথায়? গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা বা প্রধান পরিচালক হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত চীন ও আমেরিকার মধ্যে। আমেরিকার জায়গা নিতে চায় চীন। আর এখানে ইউরোপ বিগত-যৌবনা। ফলে সে ওই দুয়ের কারো জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীই নয়, যদিও ইউরোপও দুনিয়ার নেতা এবং তার রুস্তমি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত।
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় (১৯৪২) থেকেই গ্লোবাল নেতৃত্ব আমেরিকা নিজের হাতে নিয়ে নিতে সক্ষম হয়ে যায়; আর সারা ইউরোপ ছোট-বড় সবাই হয়ে যায় আমেরিকার অনুগ্রহ প্রার্থী। ওই বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ইউরোপের প্রায় সবাইকে যুদ্ধ সাহায্য করা, প্রধান খরচগুলো নিজে বহন করা, অনুদান দেয়া তো বটেই এমনকি যুদ্ধ সমাপ্তিতে অর্থনীতিগুলোকে পুনর্বাসনের যে অবকাঠামো বিনিয়োগ, সেটিও একা আমেরিকা জুগিয়েছিল। তাই আমেরিকা ও ইউরোপের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায় যেন, আমেরিকা একাই ত্রাতা আর ইউরোপ পাণিপ্রার্থী। সে সম্পর্কই সেই থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসছে জি-সেভেন ধরনের গ্রুপেও, এক উঁচু-নিচু সম্পর্কে। আমেরিকা কী বলে বা সে কী চায়, তা আমল করে শুনতে ইউরোপ অভ্যস্ত হয়ে যায়। যদিও ১৯৪৪ সাল থেকে গ্লোবাল ইকোনমিক সিস্টেম, যা বহুরাষ্ট্রীয় নানান আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল, তা গড়তে ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ ও নেতারা আমেরিকার পাশে থেকে নিজেদেরকেও গুরুত্বপূর্ণ করে নিয়েছিল।
এভাবে ইউরোপের প্রভাবশালী চার-ছয় রাষ্ট্র আমেরিকার পাশে ছোট-তরফ বা সাগরেদ হয়ে উঠতে জায়গা পেয়েছিল।
তাহলে অর্থ দাঁড়াল, আমেরিকাকে সরিয়ে গ্লোবাল নেতৃত্বের সে জায়গা চীন নিতে চাইলে ইউরোপের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোকেও চীনমুখী করতে হবে আগে। আমেরিকা-ইউরোপের সম্পর্কের বদলে একে ছাপিয়ে চীন-ইউরোপের মধ্যে সম্পর্ক হতে হবে বেশি প্রবল প্রভাবশালী। আর এটাই হবে বাস্তবত আমেরিকাকে দুনিয়ায় কম গুরুত্বপূর্ণ করে দেয়া। অতএব, বিশাল হইচই ফেলে দেয়া ঘটনা হলো ইতালির বিআরআই প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা। গত মার্চ মাসের ২১ তারিখ থেকে চীনা প্রেসিডেন্ট শি-এর সপ্তাহব্যাপী ইউরোপ সফর ছিল। আর সেখানেই স্বাক্ষরিত ১৭টি চুক্তির মধ্যে একটি হলো চীনা বিআরআই প্রকল্পে ইতালির যুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে ‘প্রাথমিক বোঝাবুঝিগুলো’ (এমওইউ) দলিল করে স্বাক্ষর হয়েছে। আর চলতি মাসের বেল্ট রোড সামিট টু-তে অংশ নেয়ার সময় তা পূর্ণতা পাবে।
ইতালি ইউরোপের সবার আগে এত গভীরভাবে জড়িত হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এর প্রধান বস্তুগত স্বার্থের দিক হলো- পুরো বেল্ট রোড প্রকল্পে ইউরোপীয় প্রান্ত বা শেষ মাথা হবে ইতালি। আর ইউরোপের যে গভীর সমুদ্রবন্দর বেল্ট রোডের সড়ক ও রেলকে সংযুক্ত করাবে, সেই বন্দর হয়ে উঠবে ইতালিতে। যার মানে হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেতা মুসোলিনির হিটলারের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার কারণে পরাজিত হয়ে সেই থেকে পিছিয়ে পড়া আর ধুঁকে চলা অর্থনীতির ইতালি এবার সামনের সারিতে চলে আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। ইতালি হয়ে উঠবে ইউরোপের হাব- সড়ক, রেলের সাথে সমুদ্রপথ যুক্ত হওয়ার সংযোগস্থল। সব দিকের সাথে কানেক্টিভিটির এই বিশেষ সুবিধার জন্য ইতালি হয়ে উঠবে বুড়ো শরীরে আবার যৌবনের জোয়ার, ইতালি হবে এখন ইপিজেড-ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের হাবও। তাই নিজ বিপুল সম্ভাবনার সামনে আমেরিকার হাত হালকা করে ধরা আর ইউরোপের অন্যরা ফ্রান্স, জর্মানি বা ব্রিটেন- এদের সবাইকে টপকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে চীনের হাত শক্ত করে জাপটে ধরা হবে ইতালির কাছে খুবই জায়েজ।
কিন্তু তাই বলে জার্মান, ফ্রান্স বা ব্রিটেনকেও চীন বিমুখ করেনি। ব্যাপারটা বিস্তারে বুঝতে আরেকটা ধারণার সাথে পরিচয় করাতে হবে। ‘কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার’ হলো সেই নতুন শব্দগুচ্ছ। বাংলায় ‘সামগ্রিক কৌশলগত মিত্র’ চীন দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর সবাইকে কৌশলগত মিত্র হিসেবে পেতে চায়। এটা এক বেল্ট রোড প্রকল্পেই কেবল সবাইকে পেতে চাওয়া নয়। আসলে খোদ বিআরআই প্রকল্পটি চীনের একটি কৌশলগত প্রকল্প।
স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগতর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত অর্থ হলো, যা কেবল অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক লাভালাভই নয়, আরো অনেক কিছু। কী সেটা? অন্তত আপাতত অর্থ হলো আমেরিকাকে বাইরে রাখা হয়েছে এমন এক পক্ষজোট- যার মধ্যে রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক ইত্যাদি সব (এই অর্থে তা সামগ্রিক) স্বার্থই এখানে চীনের নেতৃত্বে সবার আছে। এই অর্থে এটা আমেরিকাকে বাইরে রেখে এক রাষ্ট্রস্বার্থ জোট। আবার এর কাম্য সদস্যরা মানেই এরা সবার বড় ক্ষমতার রাষ্ট্র, ঠিক তা নয়। যেমন হাসিনার বাংলাদেশ (অন্তত ঘোষিতভাবে) চীনের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। ব্যাপারটা আর একটু বিস্তার করতে আরেক দিকে আলো ফেলি।
ক্রাইস্টচার্চ ম্যাসাকার সামলানোর জন্য সুখ্যাত নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা, এ মাসের ১ এপ্রিল চীন সফরে গিয়ে চীনের ‘সামগ্রিক কৌশলগত মিত্র’ হয়ে এসেছেন। এমন মিত্র হওয়াতে এর অর্থ বুঝতে হবে এভাবে, সে বেল্ট রোড প্রকল্পকে কৌশলগত সম্পর্কের গভীরতা থেকে যুক্ত হয়েছে ও নিয়েছে। অর্থাৎ চীনের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার না হয়েও কেউ বেল্ট রোড প্রকল্পকে যুক্ত হতে পারে। এই সুযোগ থাকলেও জেসিন্ডা স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের গভীরতা থেকে যুক্ত হওয়া বেশি লাভজনক মেনেছেন। আর বিপরীতে কেবল বেল্ট রোড প্রকল্পকে যুক্ত হলে স্বভাবতই সে ক্ষেত্রে সেটা কেবল বাণিজ্যিক স্বার্থ ধরনের সম্পর্ক হতো। ফলে চীনের দেয়া অন্য অনেক সুযোগ সুবিধা সে পেত না। যেমন- কোনো রাষ্ট্র ঋণের কিস্তি শোধ দিতে পারছে না। এমন ক্ষেত্রে ওই রাষ্ট্র আবার চীনের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হলে চীন ব্যাপারটাকে কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যিক দিক থেকে দেখে থেমে থাকবে না। চীন তাকে বরং অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম করে তুলতে, বিপদ থেকে বের হয়ে আসতে আরো সব সাহায্য করবে। চীনের নীতি-কৌশল হলো সব রাষ্ট্র বা প্রকল্পের সম্পর্ককে সব সময় স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার সম্পর্ক পর্যন্ত বিস্তৃত করা। যদি পার্টনার রাজি থাকে তখন সেটা আনুষ্ঠানিকতা পায়, কিন্তু চীনের দিক থেকে আগ্রহ জারি থাকে সব ক্ষেত্রে ও সময়ে।
কিন্তু নিউজিল্যান্ডের উদাহরণ কেন আনলাম? কারণ, ঠিক এর বিপরীত ঘটনা বা রাষ্ট্র হলো অস্ট্রেলিয়া। মনে রাখতে হবে, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড প্রায় সময় একসাথে উচ্চারিত শব্দ। মূল কারণ তারা একইভাবে, একই ভাগ্যে ব্রিটেনের কলোনি হয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। ফলে রাষ্ট্রস্বার্থ ও নীতিগত মিল এক হতে বেশির ভাগ সময় দেখতে পাওয়া যায়।
চীন-আমেরিকার প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রবল দ্বন্দ্ব অনেক আগে থেকেই অন্তত ওবামা আমল থেকে, তবে চাদরের নিচে থেকে। যা কেবল এ কালে ট্রাম্পের আমলে এসেই চাদর উঠে গেছে। আর সবচেয়ে বড়ভাবে আরেকবার চাদর উঠেছিল চীনের বিশ্বব্যাংক (এআইআইবি) বিকল্প গড়ার সময়ে। ওবামা লজ্জার মাথা খেয়ে খোলাখুলি সেই সময়ে ওই ব্যাংক প্রকল্পে যেন এশিয়ার জাপান, কোরিয়া তাইওয়ান বা অস্ট্রেলিয়া (যারা আমেরিকার বহু পুরনো বন্ধু) এরা তো বটেই, এমনকি ইউরোপও যেন যোগ না দেয় এর লক্ষ্যে কারো বিয়ে ভেঙে দেয়ার মতো করে ব্যাপক প্রপাগান্ডা আপত্তিতে ছেয়ে ফেলেছিল। যদিও ফলাফল হয়েছিল আমেরিকার হার; শেষে প্রায় সব রাষ্ট্রই ওই ব্যাংক প্রকল্পে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু চীনের নেতৃত্বে স্ট্র্যাটেজিক জোট আর আমেরিকার নেতৃত্বে স্ট্র্যাটেজিক জোট সেই থেকে প্রায় প্রকাশ্যেই তৎপর হয়ে যায়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া আমেরিকার জোটে যোগ দিয়েছিল। আর এখানে মূল সদস্যরা হয়েছিল জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ানের মতো রাষ্ট্রগুলো এবং স্বভাবতই চীন ঠেকানোর ঠিকা নেয়া ভারতও ছিল।
অস্ট্রেলিয়া ২০১৬ সালে নিজের উপকূলে এক আমেরিকান সামরিক ঘাঁটিও স্থাপন করতে দিয়েছিল। কিন্তু প্রায় সবাই ধরা খেয়ে যায় জাতীয়তাবাদী ট্রাম্পের কারণে, তার আমলে এসে। ট্রাম্পের সারকথা, বিড়াল যেন বলছে আর মাছ খাবো না। গ্লোবালাইজেশনের অর্থনীতিতে রূপান্তরে দুনিয়া নেতৃত্ব দেয়া সেই আমেরিকা, ট্রাম্পের হাতে পড়ে হয়ে গেল অ্যান্টি-গ্লোবাল এক জাতিবাদী আমেরিকা, আমেরিকা ফাস্টের নীতি চর্চা শুরু করল। ফলে আমেরিকার স্ট্র্যাটেজিক জোট মুখ থুবড়ে পড়লেও চীনেরটা সদর্পে আরো এগিয়ে গেল। সেটারই স্পষ্ট সফলতা এখন প্রমাণ হলো প্রেসিডেন্ট শি-এর ইউরোপ সফরে। মুখ পোড়ানো অস্ট্রেলিয়ার অতি উৎসাহ যে ভুল ছিল তা যেন আরো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে নিউজিল্যান্ড এবার অস্ট্রেলিয়ার অকেজো স্ট্র্যাটেজিক জোটের পাল্টা চীনা স্ট্র্যাটেজিক জোটে যোগ দেয়া।
ওই দিকে ইউরোপের জার্মানি যে ট্রাম্পের সবচেয়ে বেশি পাল্টা অবস্থান নিয়েছিল এবং ভোকাল ছিল, সেই জার্মানির সাথে চীনের সম্পর্ক গভীর হয়ে যায়। চীনা শিল্প-উদ্যোগের এখন দ্বিতীয় পর্যায় চলছে, যার সারকথা প্রত্যেক ট্রেডকেই হাইটেকে বা উচ্চ প্রযুক্তিতে নিয়ে যাওয়া। এখানেই জার্মানির সাথে চীন গভীর পার্টনারশিপ হয়। চীনের মতো বড় আর ব্যাপক বাজার পেয়ে যাওয়া জার্মানির জন্য বিরাট কিছু। সাধারণভাবে হাইটেকে আর বিশেষত গাড়ি তৈরির অটো শিল্পে চীনের মূল পার্টনার এখন জার্মানি। গত তিন বছরে লাগাতার চীনে জার্মান সংশ্লিষ্টতা ও বিনিয়োগ বেড়ে চলা চলছেই, গ্রোথ রেট ১৪০ শতাংশ বলা হচ্ছে। ওই দিকে ফ্রান্সের সাথে চীনের সম্পর্ক আর এক মাত্রায় হাজির। এবার প্রেসিডেন্ট শি-এর সফরে ইতালির বাইরে আরেক গুরুত্বের জায়গা ছিল ফ্রান্স। এই সফরে যত না চীনের খুশির, এর চেয়ে বড় প্যারিসের, সে গদগদ। মূল কারণ চীন, আমেরিকার বোয়িংয়ের চলতি খারাপ সময়ে ইউরোপের ফ্রান্সের বড় শেয়ারের (চীনে অবস্থিত ফ্যাক্টরি থেকে) এয়ারবাস থেকে বিমান কেনার জন্য ৪৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। অর্থাৎ জার্মান-ফ্রান্স চীনের পক্ষে কৌশলগত জোটের প্রত্যক্ষ পার্টনার না হলেও তারা ঘনিষ্ঠ; অন্তত তারা আমেরিকার জোটের নয়। ওই দিকে ব্রিটেন এত বাছবিচার না রেখে খোলাখুলি বেল্ট রোড প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হতে লম্বা পরিকল্পনা করছে ২০১৭ সাল থেকে। ব্রিটিশ অর্থ মন্ত্রণালয় হংকং ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ডগলাস ফ্লিন্টকে প্রধান করে এ লক্ষ্যে কাজ ও পরিকল্পনা শুরু করেছে। বেল্ট রোড সামিট টু ব্রিটেনের জন্য এক বিরাট সুযোগ বলে ডগলাস ফ্লিন্ট প্রকাশ্যেই জানাচ্ছেন।
এককথায় চলতি এপ্রিলের ‘বেল্ট রোড সামিট টু’ থেকে এর ওলটপালট ঝড় আসন্ন; গ্লোবাল নেতৃত্বে চীনের আসীন হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হতে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশ? গত বেল্ট রোড সামিট ওয়ানের সময় ভারতের মন রক্ষা করতে বাংলাদেশ বড় প্রতিনিধি অন্তত কোনো মন্ত্রী পাঠাতে পারেনি। কিন্তু বেল্ট রোড প্রকল্পে চীনের সাথে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত লুকাতেও চায়নি বা পারেনি; বরং ভারতকে বুঝিয়ে রাজি করতে আমাদের পররাষ্ট্র সচিবকে ভারতে পাঠানোয় ভারতের সাথে আমাদের অবস্থান-ভিন্নতা আরো প্রকট হয়ে উঠেছিল। অবস্থা এখন ভারতের মুখ চেয়ে স্থবির হয়ে থাকা যাবে সে জায়গাতেও আর নেই। অন্তত এ বছর আমাদের নির্বাচনের পরে চীনা ঘনিষ্ঠতা প্রদর্শন আর বিশেষ করে সিএনএন-নিউজ১৮ নামে ভারতীয় টিভিতে হাসিনার সাক্ষাৎকার খুবই বোল্ড ছিল এবং তা এক স্থির সিদ্ধান্তের প্রকাশ দেখিয়ে ফেলেছিল যে, সোনাদিয়া বন্দরসহ বেল্ট রোড প্রকল্পে যুক্ত হতে হাসিনা সরকার আর থামবে না। এমনকি ওই সাক্ষাৎকার আসলে খোদ ভারতকেই চীনের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বেল্ট রোড প্রকল্পে যুক্ত হতে আহ্বান রাখা হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকারের আলো অনুসরণে চিন্তা করলে মনে হয়, এবারের এপ্রিলে বেল্ট রোড সামিট টু-তে চীনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিনিধিত্ব করতে আমরা দেখব।
কিন্তু এর ভারতীয় প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? প্রথমত, ভারতে এখন রুটিন সরকার; মানে মোদিসহ রাজনৈতিক নেতাদের সময় নেই কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার। এর চেয়ে নিজ নিজ এলাকায় মাঠের নির্বাচনী প্রচারে যোগ দিয়ে নিজের আসন নিশ্চিত করা তাদের একমাত্র কাজ। ফলে আগামী মাসে ২৩ মের আগে সরকারে কে আসবে, কে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তা জানার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় এক কথায় ভারতের নিজের বেল্ট রোড সামিট টু-এর পক্ষে কোনো অবস্থান দেখতে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশকে এবারো কি তারা ঠেকাতে পারবে?
ঠেকাতে আগেরবারই পারেনি। ফলে এবারো পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে, সাক্ষাৎকার দিয়ে বলা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি দিক থেকে দেখলে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিত্ব আমাদের দেখতে পাওয়ার কথা। যদি তা আমরা না দেখতে পাই, তবে বুঝতে হবে সরকার আবার আপস করল। সেটা হবে বাংলাদেশের প্রবল সব সম্ভাবনাগুলোর মাথা মুড়িয়ে ফেলে রাখা আর পিটিয়ে কাউকে খাটো বামন বানিয়ে রাখার মতো একটা কাজ।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com