প্রবৃদ্ধি অপ্রবৃদ্ধির বিপ্রতীপ কথকতা
- জি. মুনীর
- ০৭ এপ্রিল ২০১৯, ২২:১২, আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৯, ২২:৪২
আমরা এখন প্রবৃদ্ধি বেড়ে চলার গর্ব নিয়ে দিন যাপন করছি। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। কারো কারো দাবি, এই হার চলতি অর্থবছরেই ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বা যাচ্ছে। গত শুক্রবারের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ উন্নয়ন প্রতিবেদন।
এ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি অর্থবছরে দেশে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক আরো বলেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী পাঁচ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি। রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
অপর দিকে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা করেছেন, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর ৩ এপ্রিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, প্রবৃদ্ধির হার হবে ৮ শতাংশ। সংস্থাটি বলেছে- ব্যাপক ভোগচাহিদা, রফতানি বেড়ে যাওয়া ও সরকারি বিনিয়োগের কারণে এ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে।
কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলেছে, ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে বাংলাদেশের সময় লাগবে। পরিস্থিতি যা-ই হোক, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধির পাঁচ দেশের একটি, এ কথা জেনে সরকার পক্ষের অনেকেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছেন বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির হারই যে অর্থনীতির সব কিছু নয়, এটা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। তা ছাড়া অর্থনীতিবিদদের অনেকেই এখন বলছেন, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে তোলাকে আজ হোক, কাল হোক অবশ্যই থামাতে হবে। কেন থামাতেই হবে, সে বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেই আজকের এই লেখা।
আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও বিশ্বের অর্থনীতি, উভয়ই বিগত শতাব্দীতে নাটকীয়ভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। একই সাথে বেড়েছে মানুষের গড় বয়স এবং বস্তুগত অগ্রগতিও। অর্থনীতিবিদেরাও এ পর্যন্ত বলে আসছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর বিষয়টি ভালো, অপরিহার্যও বটে এবং অন্তহীনভাবে সব সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতেই হবে। কারণ প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, বিনিয়োজিত অর্থ ফেরত পাওয়া যায় এবং রাজস্ব আয় বাড়ায়।
তাহলে প্রবৃদ্ধির খারাপ দিকটাই বা কী, যে কারণে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে চলা থামানোর প্রশ্ন উঠেছে। আমরা প্রবৃদ্ধি নিয়ে এতটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, সরকার, করপোরেশন ও ব্যাংকগুলো এখন নির্ভর করে ওই প্রবৃদ্ধির ওপর। আসলে আমরা সবাই অনেকটা সঙ্ঘবদ্ধভাবে প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে আসক্ত হয়ে পড়েছি- এমনটি বললে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বৃহত্তর প্রবৃদ্ধির বা অর্থনীতির দেশগুলো মানুষের কল্যাণ বা সুখ নিশ্চিত করতে পারছে না। আমরা যদি ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাই, শীর্ষ অবস্থানে থাকা পাঁচটি দেশ হচ্ছে- ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। এই পাঁচটি দেশের চারটিই নরডিক কান্ট্রি। এ দেশগুলো সুপরিচিত স্থিতিশীল, নিরাপদ ও সামাজিকভাবে প্রগতিশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে। সেখানে দুর্নীতি কম।
পুলিশ ও রাজনীতিবিদদের প্রতি সেখানকার নাগরিক সাধারণ আস্থাশীল। অপর দিকে, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বৃহত্তর অর্থনীতির বা প্রবৃদ্ধির দেশ তথা সবচেয়ে ধনী দেশগুলো এই হ্যাপিনেস ইনডেক্সে অবস্থান করছে নিচের দিকে। এটি প্রমাণ করে, প্রবৃদ্ধিই অর্থনীতির সব কিছু নয়। একটি বৃহত্তর অর্থনীতির দেশে থাকে অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতির দেশের তুলনায় বেশি অর্থনৈতিক উপাদান। অথচ আমরা বসবাস করি একটি সীমিত গ্রহে।
সে কারণেই অর্থনীতিবিদেরা আওয়াজ তুলেছেন, প্রবৃদ্ধির অবসান ঘটানো অপরিহার্য। বলা যায়, প্রবৃদ্ধির অবসান ঘটানোর বিষয়টি প্রত্যাশিত। কারণ, এমনটি দরকার যদি আমরা অর্থনীতির কিছু উপাদান- খনিজসম্পদ, বন-বনানী, জীববৈচিত্র্য ও স্থিতিশীল আবহাওয়া আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে চাই।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদের উদাহরণ টানা যেতে পারে। এক সময় আমরা শুনতাম, বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। কিন্তু এখন শুনছি ‘আমাদের গ্যাস সম্পদ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।’ বর্ধনশীল শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ঘর-গেরস্থালির ক্রমবর্ধমান গ্যাস চাহিদা এখনই আমরা মেটাতে পারছি না। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে আমাদের গ্যাস চাহিদাও আরো বেড়ে যাবে, তখন সে চাহিদা মেটানোর জন্য কোনো গ্যাস অবশেষ থাকবে না।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সামান্য গ্যাসও রেখে যাওয়া আমাদের পক্ষে তখন সম্ভব হবে না। অধিকন্তু, প্রবৃদ্ধির অর্থ যদি হয় এমন কিছু করা, যা মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে, মানুষের কল্যাণ বাড়িয়ে দেবেÑ তবে অনেক উদাহরণ রয়েছে যে, সে অবস্থা অর্থনীতির ভাষায় এরই মধ্যে তা ‘পয়েন্ট অব ডিমিনিশিং রিটার্ন’ অতিক্রম করে গেছে। এমনকি, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি প্রকৃত জিডিপি বিবেচনায় ১৯৬০ সালের তুলনায় বর্তমানে সাড়ে ৫ গুণ বেড়েছে, এরপরও আমেরিকা ‘হ্যাপিনেস সূচকে’ ক্রমাবনতি ঘটে চলেছে। জিডিপির হার বৃদ্ধিই যদি অর্থনীতির উন্নয়নের একটি সামগ্রিক সূচক হতো, তাহলে এমনটি ঘটত না।
এ কারণে বলা হচ্ছে, প্রবৃদ্ধিকে আজ হোক কাল হোক থামাতেই হবে। অতএব, প্রশ্ন আসে- কী করে আমরা জীবনকে দুর্ভোগের মধ্যে না ফেলে প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দিতে পারি? কিংবা কী করে প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দিয়ে আমরা জীবনমান আরো বাড়িয়ে তুলতে পারি?
কাজটি শুরু করতে অনেকের মতে দু’টি কৌশল রয়েছে। প্রথমত, আমরা বাজে জ্বালানি ভোগের জায়গায় নিয়ে আসতে পারি ভালো জ্বালানি ভোগ। যেমন- ফসিল জ্বালানির জায়গায় আমরা নিয়ে আসতে পারি নবায়নযোগ্য জ্বালানি। দ্বিতীয়ত, আমরা অর্থনীতির উপাদানগুলোকে আরো দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারি। এর মাধ্যমে আমরা এমন পণ্য উৎপাদন করতে পারি, যেগুলো দীর্ঘদিন টিকে থাকে।
এরপর কোনো পণ্যকে একবার ব্যবহারের পরে বর্জ্য হিসেবে তা মাটিচাপা দেয়ার পরিবর্তে রিসাইকল করতে পারি নতুন পণ্য উৎপাদন কিংবা মেরামত করার জন্য। এই কৌশল দু’টি নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কারণ, প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ফলে পরিবেশের ভারসাম্যের যে অবনতি ঘটে, এ ক্ষেত্রে তা ঘটে না।
কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তিতে এখনো বস্তুর (অ্যালুমিনিয়াম, গ্লাস, সিলিকন ও সৌর প্যানেলের জন্য তামা, কংক্রিট, ইস্পাত, উইন্ড টারবাইনের জন্য তামা ও নিওডাইমিয়াম) ব্যবহার করা প্রয়োজন। আর দক্ষতার রয়েছে একটি সীমাবদ্ধতা। যেমন- একটি মেসেজ পাঠানোর ক্ষেত্রে আমরা প্রায় প্রান্তিক দক্ষতায় পৌঁছে গেছি। মেসেজ পাঠানোর সময় আমরা প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছি।
এর খরচও আমরা প্রায় শূন্যতে নামিয়ে আনতে পেরেছি। এ থেকে আরো অগ্রগতি অর্জনের সম্ভাবনা একদম নেই বললেই চলে। অন্য কথায়, প্রতিস্থাপন ও দক্ষতা ভালো, কিন্তু শুধু সেগুলোই যথেষ্ট নয়। এমনকি, আমরা যদি কখনো কোনো উপায়ে নিয়ার-ভার্চুয়াল ইকোনমিতে পৌঁছে যাই এবং অর্থনীতি ভালোভাবে বেড়ে উঠতে থাকে, তখন আমাদের অধিকসংখ্যক উপাদান ব্যবহার করতে হবে। এর ফল দাঁড়াবে দূষণ ও সম্পদ কমে যাওয়া। ফলে একদিন না একদিন আমাদের প্রবৃদ্ধি থেকে সরাসরি সরে আসতে হবে।
আমরা যদি প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানগুলো এলোমেলোভাবে গড়ে তুলি, তবে এটি কি সামাজিক দুর্ভোগ ও বিশৃঙ্খলাকেই ডেকে আনবে না? হতে পারে, অপ্রয়োজনীয় ধ্বংস সাধন না করে প্রবৃদ্ধি থেকে সরে আসার জন্য প্রয়োজন হবে সমন্বিত সুষ্ঠু একটি পরিবর্তন। পরিণামে এর জন্য প্রয়োজন হয় সবার সহায়তার জন্য একটি সাপোর্ট সিস্টেম গড়ে তোলার। নীতিনির্ধারকদের কাজের ব্যাপারে হতে হবে স্বচ্ছ; আর নাগরিকদের চাহিদা হবে নির্ভরযোগ্য তথ্য ও প্রণোদনা। একটি কাজের সাফল্য নির্ভর করবে দুর্ভোগ সর্বোচ্চ মাত্রায় কমিয়ে আনা এবং উপকার সবচেয়ে বেশি বাড়িয়ে তোলার ওপর।
তখন মূল নজর থাকবে সাম্য, তথা আয়ে ও সম্পদে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর। এখন আমরা যে প্রবৃদ্ধি নিয়ে গর্ববোধ করি, সেখানে এই বৈষম্যের কারণে প্রবৃদ্ধি সবার জন্য সমান উপকার বয়ে আনে না। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, আয়বৈষম্য কমিয়ে আনায় ব্যর্থতার কারণে সবার জন্য সমান উপকার নিশ্চিত করা যায় না। এ কারণেই বিগত শতাব্দীর অর্থনীতির সম্প্রসারণ ও প্রবৃদ্ধি সমাজে সৃৃষ্টি করেছে দু’টি পক্ষ : উইনার ও লুজার। অন্য কথায়, উপকৃত ও অনুপকৃত। এরপরও অনেক মানুষ এই অর্থনৈতিক বৈষম্যকে উপেক্ষা করে আসছে। কারণ, তারা ভুল করে বিশ্বাস করে আসছে, একদিন না একদিন এরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লভ্যাংশ পাবে।
অর্থনৈতিক সঙ্কোচনের পরিস্থিতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের কাছে সহনীয় করে তোলার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে, জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। সামাজিক অবস্থান থেকে অর্থনৈতিক সাম্য কাজ করবে প্রবৃদ্ধির বিকল্প হিসেবে। সাম্যের ওপর বিশ্বাসনির্ভর অর্থনৈতিক নীতিমালার বিষয়টি বিশ্বজুড়ে এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে, যদিও বাংলাদেশে এ বিষয় তেমন কোনো আলোচনা শুরুই হয়নি।
কারণ, আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকেরা এখনো প্রবৃদ্ধির মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আমাদের দেশের সরকার প্রবৃদ্ধির গুণগান চালিয়ে যাচ্ছে সপ্তম সুরে। দেশে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক প্রবৃদ্ধির অর্থনীতির বদলে সাম্যের অর্থনীতি সৃষ্টির ব্যাপারে যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, সে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত আছে : কর্মসংস্থানের পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা, নিশ্চিত নিম্নতম মজুরি পাওয়া, প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা এবং সর্বোচ্চ আয় নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোও।
অপর দিকে, জীবনমানের উন্নয়নের কাজটি আমরা এগিয়ে নিতে পারি শুধু আরো সুনির্দিষ্টভাবে নীতি চিহ্নিত ও প্রকাশ করার মাধ্যমে। শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে তোলার ওপর সরকারের নীতির আলোকপাতের বদলে কেন আমরা নজর দেবো না ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ বাড়িয়ে তোলার ওপর? এই গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস পরিমাপ করা হয় সুনির্দিষ্টভাবে বাছাই করা কিছু সোস্যাল ইন্ডিকেটর বা সামাজিক নির্দেশক বা সূচকের মাধ্যমে। এসব উপায়ে আমরা অর্থনৈতিক সঙ্কোচনকে করে তুলতে পারি সন্তোষজনক। প্রশ্ন হচ্ছে, নীতিনির্ধারকেরা কী উপায় অবলম্বন করবেন প্রবৃদ্ধির রাশ টেনে ধরতে? সে মানসিকতা তৈরি করতে আমাদের নীতিনির্ধারকদের আরো সময় লাগবে বলেই মনে হয়।
একটি কৌশল হতে পারে, একটি স্বল্পতর দৈর্ঘ্যরে কর্মসপ্তাহের বাস্তবায়ন। স্বস্তির কথা, বাংলাদেশে সেটি ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচ দিনের কর্মসপ্তাহ চালু রয়েছে। যদি মানুষ কম কাজ করে, তবে অর্থনীতির গতি কমে আসবে। তখন সবাই নিজের পরিবারের দিকে বেশি সময় দেয়ার সুযোগ পাবে; অধিক পরিমাণে বিশ্রামের সময় পাবে। সেই সাথে পাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট হওয়ার অবকাশ। সন্দেহ নেই, এতে দেশের ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ বাড়বে।
এ ক্ষেত্রে একটি ওয়াস্টফুল স্পেকুলেশনের বদলে ফিন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন ট্যাক্স কার্যকর করা এবং ব্যাংকগুলোর জন্য ১০০ শতাংশ রিজার্ভের প্রয়োজনীয়তা চালু করার মাধ্যমে আমরা অর্থনীতিকে ডি-ফিন্যান্সিয়ালাইজ করতে পারি। ছোট পরিবার গড়ার বিষয়টিকে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনা এবং রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ কেয়ারের সুযোগ সৃষ্টি করে জনসংখ্যাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখতে পারি। এর মাধ্যমে সমাজে সাম্য সৃষ্টি সহজতর হতে পারে। উৎপাদক ও ভোক্তার সংখ্যাসাম্যও এর মাধ্যমে গড়ে তোলা যেতে পারে। পাশাপাশি, সীমিত করতে হবে সম্পদ উত্তোলন ও দূষণ। ফসিল জ্বালানি ব্যবহার রোধের মধ্য দিয়েই কাজটি শুরু করা যেতে পারে। বছরে কয়লা, তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সর্বোচ্চ মাত্রা বেঁধে দেয়া যেতে পারে। এর ফলে আবহাওয়া সুরক্ষা পাবে।
প্রবৃদ্ধির শাসন একই সাথে বয়ে আনবে বেশ কিছু পরিবেশগত কল্যাণ। কার্বনের উদগীরণ নেমে আসবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বনাঞ্চল থেকে শুরু করে মৎস্যসম্পদ সংরক্ষিত হবে। অন্যান্য সৃষ্টি জীবের বসবাসের জন্য অধিকতর স্থান মিলবে। এর ফলে আমাদের মূল্যবান এই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য হবে সুরক্ষিত। আর এসব পরিবেশগত উপকার দ্রুত মানবজাতির স্বাভাবিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে। এর ফলে জীবন হয়ে উঠবে আরো সুন্দর। তখন সবার জীবনে নেমে আসবে সুখ ও প্রশান্তি।
এটি ঠিক, এখানে আমরা কথা বলছি একটি অভূতপূর্ব সমন্বিত অর্থনৈতিক পরিবর্তনের। এই পরিবর্তন সাধনের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সাহস। কারণ, প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দেয়ার কথা শোনামাত্রই এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর লোকের সংখ্যা কম হবে না- এটি নিশ্চিত। এ কাজটি কঠিন হবে বিদ্যমান পুঁজিবাদী-সমাজবাদী সমাজব্যবস্থার আলোকে। কারণ, আমাদের বেশির ভাগই বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় অভ্যস্ত। হতে পারে, আমরা এটিকে নিয়ে ভাবতে পারি কো-অপারেটিভ কনজারভেটিজম হিসেবে। কেননা, এর লক্ষ্য হবে পারস্পরিক সহায়তা বাড়ানোর মাধ্যমে প্রকৃতিকে কনজার্ভ বা সুরক্ষা করা। এর জন্য প্রয়োজন সবার পক্ষ থেকে প্রচুর পরিমাণে সৃজনশীল চিন্তাভাবনা।
এ কথাটি শুনতে জটিলই মনে হয়। তবে আসল ব্যাপার হচ্ছে, বিষয়টি ঐচ্ছিক নয়। তবে একদিন প্রবৃদ্ধির অবসান ঘটবে এবং তা ঘটবে খুব শিগগিরই- আমরা এর জন্য তৈরি হই আর না হই। আমরা যদি তা মোকাবেলার জন্য পরিকল্পনা করি, এটি সবার জন্য বড় ধরনের উপকার ও কল্যাণ বয়ে আনবে। তা করতে আমরা ব্যর্থ হলে বৈপরীত্য মোকাবেলা করতে হবে বৈকি!