২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সুলতান সুলায়মানের সমাধি

সুলতান সুলায়মানের সমাধি
ড্যান ম্যাকললিন - ছবি : সংগৃহীত

দক্ষিণ হাঙ্গেরির প্রান্তভাগের একটি ছোট্ট শহর। নাম জিগেতভার। এর একেবারে প্রান্তভাগটির নাম তুরবেক হিল। কারো স্মরণশক্তি যত দূর যেতে পারে, সেই সময় থেকে এ নামেই স্থানটি পরিচিত। বাগ-বাগিচা আর আঙুর বাগানের জন্য বিখ্যাত ত্রিভুজের মতো দেখতে নিরিবিলি এ স্থানটি। কিন্তু এখন তুরবেকের মাটি গোলযোগপূর্ণ অতীতের রহস্য প্রকাশ করে দিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট, অধ্যাপক এবং সম্ভাব্য ও আকর্ষণীয় তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের জোরালোভাবে আকর্ষণ করছে। কারণ ইউরোপের ইতিহাস নির্ধারণ করে দেয়ার মতো একটি ঘটনা ঘটেছিল এখানে। হাঙ্গেরি আর তুর্কি গবেষকেরা

এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তারা উসমানিয়া সালতানাতের শ্রেষ্ঠ শাসক মহান সুলায়মানের সমাধি খুঁজে পেয়েছেন। প্রায় ৪৫০ বছর আগে ১৫৬৬ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে তিনি জিগেতভারেই ইন্তেকাল করেছিলেন। সুুলতান তার ৭২তম জন্মদিনের মাত্র দুই মাস আগে এখানেই ইহজীবনের সমাপ্তি টেনেছিলেন। তখনো তার বাহিনী নির্মম ও রক্তাক্তভাবে জিগেতভার দুর্গ ঘিরে রেখেছে। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার বিশাল সেনাবাহিনী জিগেতভার রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত হাবসবার্গ বাহিনীকে পরাজিত করে। তবে এই বিজয়ের মূল্য ছিল অনেক চড়া।


উসমানিয়াদের ক্ষতি এত বেশি ছিল যে, ভিয়েনা দখল করার পরিকল্পনা তাদের বাদ দিতে হয়। এর পরিণতি সম্পর্কে পরে ফরাসি কূটনীতিক কার্ডিনাল রিচেলিউ বলেছিলেন, জিগেতভার যুদ্ধ রক্ষা করেছিল সভ্যতাকে। অর্থাৎ তখন তুর্কিরা ভিয়েনা দখল করতে পারলে পুরো ইউরোপ তাদের শাসনে চলে যেত। সুলতান শাসনকাজ পরিচালনা করেছিলেন চার দশক।

সৈন্যদের প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় তার সহযোগীরা তার মৃত্যুর খবর গোপন রাখেন। তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, তার কবর হবে তার নির্মাণ করা সুলায়মানিয়া মসজিদে; কিন্তু অত দূরে লাশ নিয়ে যাওয়া ছিল ভয়াবহ মাত্রার কঠিন কাজ। অধিকন্তু আবহাওয়া ছিল গরম। ফলে সুলায়মানের হৃৎপিণ্ড এবং আরো কয়েকটি অঙ্গ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এখানে রাখা হয়েছিল। কিংবদন্তি অনুসারে, একটি স্বর্ণের কফিনে তার সমাধির গভীরে সেগুলো রাখা হয়। এখানে উসমানিয়াদের দোর্দণ্ড প্রতাপ স্থায়ী হয়েছিল ১৫৭০-এর দশক পর্যন্ত। ক্রমাগত বেশি বেশি পর্যটকের আগমনের রেশ ধরে এখানে সোলায়মানিয়া মাজার, একটি মসজিদ, একটি দরগাহ, একটি ব্যারাক গড়ে ওঠে।

আর বসতিটি পরিচিত হয় তুরবেক নামে। শব্দটির উৎপত্তি তুর্কি শব্দ ‘তুরব’ থেকে, যার মানে সমাধি। হাপসবার্গরা ১৬৮০-এর দশকে এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ আবার নিয়ে উসমানিয়াদের বিজয়ের সব প্রতীক মিশিয়ে দেয়। পরের কয়েক শ’ বছর ধরে সুলায়মানের সমাধি গুজব, জল্পনা-কল্পনা আর কিংবদন্তির মধ্যেই আটকে থাকে। নতুন আলো জ্বালেন কাছের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক নরবার্ট প্যাপ। সমাধিটি কোথায় ছিল, তা নিয়ে নানা কথা প্রচারিত ছিল। কারো কারো মতে, ১৮ শতকের তুরবেক চার্চটির স্থানেই ছিল সমাধিটি। অন্যদের ধারণা, স্থানটি ছিল ১৯৯৪ সালে সুলায়মানের জন্মের ৫০০ বছর উদযাপন উপলক্ষে তৈরি করা হাঙ্গেরি-টার্কিশ ফ্রেন্ডশিপ পার্কে। প্যাপ তার আবিষ্কারের কাহিনী স্মরণ করে জানান, ২০১২ সালে কাজ শুরুর সময় আমরা অনেক প্রাচীন সূত্র বিশ্লেষণ করেছি; ভূমি ব্যবহার এবং স্থানীয় ভূগোলের দিকে তাকিয়েছি। ওই সময়ের পরিবেশ নতুন করে তৈরির চেষ্টা করেছি।

তিনি বলেন, চার্চ আর পার্কটি যখন বানানো হয়েছে, তখনকার অবস্থান নিশ্চিতভাবেই এখনকার চেয়ে ভিন্ন ছিল। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, আসল স্থানটি অবশ্যই ছিল উঁচু এবং জিগেতভার দুর্গ থেকে বেশ দূরে। সমসাময়িক ইতিহাসবিদেরা বলেছিলেন, সুলায়মানের রাজকীয় তাঁবুটি থেকে যুদ্ধক্ষেত্র এবং অবরুদ্ধ দুর্গটি দেখা যেত; কিন্তু চার্চ আর পার্কটি থেকে তা দেখার কোনো সুযোগ নেই।

এ কারণেই আরো গরম, আরো আর্দ্র স্থান তুরবেক হিলের দিকে তাদের নজর পড়ে। এই পাহাড়ে যে কিছু একটা আছে, তা স্থানীয় লোকজন আগে থেকেই টের পাচ্ছিলেন। কারণ যখনই তারা মাটি খুঁড়তেন, তারা ইটের দেখা পেতেন। আগেও কিছু প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা হয়েছে, খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে। ওই সময়ের গবেষকদের মনে হয়েছে, এটি উসমানিয়া আমলের কোনো একটা স্থাপনা হবে হয়তো। তবে এর বেশি আর এগোনো সম্ভব হয়নি। তবে প্যাপ আর তার দলের ভাগ্য ভালো। তারা হাঙ্গেরি ও তুরস্কের তহবিল থেকে অর্থ পেয়ে পাহাড়টি খনন শুরু করেন এবং উসমানিয়া ধ্বংসাবশেষের সুস্পষ্ট নিদর্শন পান।

২০১৪ সাল নাগাদ তারা নিশ্চিত হন, তাদের অনুমান ঠিক। তারা ভূমির নিচে একটি বড় প্রাচীর দেখতে পান। এতে মক্কার দিকটি নির্দেশ করা ছিল। আঙ্কারার মিডলইস্ট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী উজায় পেকেরও ছিলেন এই দলে। তাদের আবিষ্কারে খুশি আর ধরছিল না তার। এরপর গত বছর একটি বর্গাকার ভবন আবিষ্কৃত হয়। প্রমাণিত হয়, এটিই ছিল সুলায়মানের সমাধি। আর চলতি বছর তারা মসজিদ এবং দরগাহটির সন্ধান পান। তারা ১৬ শতকে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত মুদ্রা, ছুরি, ঢাকনা, পাইপ ইত্যাদি পেয়ে নিশ্চিত হয়েছেন, এটিই সুলায়মানের সমাধি।

সুলায়মান সুলতান হয়েছিলেন ১৫২০ সালে। তার আমলে উসমানিয়া সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও বলকান পর্যন্ত। ১৫৬৬ সাল নাগাদ, তার প্রাধান্য মক্কা থেকে আলজিয়ার্স, আধুনিক হাঙ্গেরির বেশির ভাগ এলাকায় বিস্তৃত ছিল। আর দেশে তিনি যে আইন সঙ্কলন করেছিলেন, সে কারণে তার পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায় ‘কানুনি’। পেকেরের কাছে সুলায়মান হলেন ‘উসমানিয়া শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক।’

তিনি বলেন, ‘তিনি ছিলেন মহান শাসক। একই সাথে সাহিত্য, শিল্পকলা এবং স্থাপত্যের মহান পৃষ্ঠপোষক। সুলায়মানের আমলে তুর্কি শিল্পকলা ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে যায়। ফলে এই আবিষ্কার তুর্কিদের কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা অনুমান করা যেতে পারে।’ আগামী ৭ সেপ্টেম্বর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান জিগেতভার স্মারক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তুরস্কের সোনালি অতীতের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার জন্য অনেকেই এরদোগানকে ‘নতুন সুলতান’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। তার কাছে এই আবিষ্কার সত্যিই মূল্যবান।

অনুষ্ঠানে তার সাথে থাকবেন হাঙ্গেরি ও ক্রোয়েশিয়ার নেতারা। এ দুই দেশের সৈন্যদের নিয়েই হাপসবার্গ বাহিনী গঠিত ছিল। বিশেষ করে জিগেতভার দুর্গ রক্ষায় সবচেয়ে বেশি সৈন্য ছিল ক্রোটদের। ৪৫০ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক রোমাঞ্চকর ও সাহসিকতাপূর্ণ ঘটনার বার্ষিকী উদযাপন শহরটির ১০ হাজার লোককে আবেগপ্রবণ করে তুলেছে। স্থানীয় নগর পরিষদের সহসভাপতি রবার্ট ফ্যাজেকাস বলেন, ‘মি. এরদোগান আগেও এখানে এসেছিলেন, তিনটি হেলিকপ্টার নিয়ে। তখন তিনি ছিলেন স্রেফ প্রধানমন্ত্রী, তখন কোনো অভ্যুত্থানচেষ্টা ছিল না।’

বার্ষিকী সপ্তাহে তিনজন প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানানো, তাদের সাথে থাকা নিরাপত্তা বহর এবং সম্ভাব্য আরো লাখো মানুষের ভিড় সামলানো সহজ কথা নয়। তবে শহরবাসী মনে করছে, তাদের সুদিনই বুঝি আসছে। সেখানে কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ ছিল না। বেকার লোকজন শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিল।

সুলতান সুলায়মানের আবির্ভাব এখন তাদের ভাগ্য বদলে দেবে। পর্যটকের যে ঢলের আশা তারা করছে, তাতেই তারা ভেসে যেতে পারে। তবে এখানেও কিছু দ্বিধা রয়েছে। হাঙ্গেরির নেতারা ‘ইসলামোফোবিয়া’য় আক্রান্ত। ফলে তুর্কি বা মুসলিমদের কতজন সেখানে সফর করবেন বা করতে পারবেন কিংবা বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন, সে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান জিগেতভার শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে সীমান্তে বেড়া নির্মাণ করেছেন মুসলিম উদ্বাস্তুদের ঠেকাতে। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, মুসলিম উদ্বাস্তুরা ইউরোপের নিরাপত্তা, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের জন্য হুমকি।

উদ্বাস্তুদের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নজুড়ে ছড়িয়ে দেয়ার জার্মান নেতৃত্বাধীন পরিকল্পনাও তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বরং এ নিয়ে অক্টোবরে গণভোটের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশে বেশি মুসলমানকে না নেয়ার অধিকার আমাদের আছে।’

অরবান ঘোষণা করেছেন, ‘আমি বলব, মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে বসবাসের প্রশ্নটি এলে আমরাই হবো একমাত্র জাতি, যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কারণ আমরাই ১৫০ বছর ধরে সেই অবস্থায় পড়েছিলাম।’ অরবান উসমানিয়া শাসনকালকে আদর্শ হাঙ্গেরিয়ান দৃষ্টিকোণ থেকে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে এটিই হাঙ্গেরির একমাত্র ভাষ্য নয়, বরং ক্যাথলিক হাপসবার্গরা উসমানিয়াদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করেছিল। তাদের কাছে ক্যাথলিক হাপসবার্গরাই ছিল প্রধান শত্র“। এ প্রেক্ষাপটে প্যাপ বলেন, ‘সাধারণভাবে সরকারি ভাষ্যে সুলায়মানের কাহিনী খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। তুরবেক মুসলমানদের পবিত্র স্থান এবং তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হলে তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হবে বলেই অনুমান করতে পারি।’ তিনি বলেন, একই সাথে সরকার এ বিষয়ে গবেষণার জন্য প্রচুর টাকা দেয় এবং স্থানীয় লোকজনের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক।

তুর্কিদের সাথে আমরা হাঙ্গেরিয়ানদের ৬০০ বছরের ইতিহাস রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ৩০০ বছর আমরা লড়াই করেছি, আর গত ৩০০ বছর আমরা সাধারণত মিত্র হিসেবে রয়েছি। ফলে সম্পর্কটা কেবল ঝামেলার নয়। উসমানিয়া আমল সম্পর্কে ক্যাথলিক হাঙ্গেরিয়ানদের বৈরিতা দেখা গেলেও সুলতানের রাজদরবারের প্রতি তারা মোহাবিষ্ট। সুলায়মানের জীবনীনির্ভর তুর্কি সোপ অপেরা ‘জুলেমান’ হাঙ্গেরিতে বেশ জনপ্রিয়। সুলতান পঞ্চম মুরাদের নাতির নাতনী কেনিজে মুরাদ এবং তার বোন মেদিহাও সুলতান সুলায়মানের দেহাবশেষ যে স্থানে রাখা হয়েছিল তা পরিদর্শন করেছেন।

কেনিজে তার চুলের একটি নমুনাও দিয়েছেন, যদি ডিএনএ পরীক্ষার জন্য দরকার পড়ে। এখানে এসে কেনিজে মুরাদ যেন নিজের অতীতকেই ফিরে পেয়েছেন। তিনি জানান, ‘তারা যখন আমাকে ঠিক স্থানটি দেখাল, আমি আবেগ চেপে রাখতে পারিনি, কান্না ধরে রাখতে পারিনি। আমি হাত তুলে সুলতান সুলায়মান কানুনির জন্য দোয়া করেছি- হে আল্লাহ, তুরস্ককে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করো।’ তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন, ‘স্বীকার করতেই হবে ৪৫০ বছর পর আমাদের পূর্বপুরুষের কোনো অবশেষ এখানে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে তারা যদি বলে, তার হৃৎপিণ্ড এবং ভেতরের কিছু অঙ্গ এখানে আছে, তবে তা হয়তো... হ অনুবাদ : মোহাম্মদ হাসান 


আরো সংবাদ



premium cement