২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এক মহান দরবেশের কথা

এক মহান দরবেশের কথা - ছবি : সংগৃহীত

এক বাদশাহ একজন দরবেশকে বললেন, যদি আপনার কোনো প্রয়োজন থাকে তাহলে বলেন। দরবেশ জবাবে বললেন, ‘আমার গোলামদের গোলামের কাছে কিছু চাই না।’ বাদশাহ বললেন, এটা কিভাবে বললেন? দরবেশ বললেন, আমার দু’টি গোলাম রয়েছে, যারা তোমার মালিক। দু’টির একটি হচ্ছে লোভ, অপরটি আশা।’ এ কাহিনী হজরত দাতা গঞ্জবাখশ আলী হাজবেরি রহ: তার বিখ্যাত ‘কাশফুল মাহজুব’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এটি এমন এক গ্রন্থ যার ব্যাপারে হজরত খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া রহ: বলেছিলেন, যে ব্যক্তির কোনো মুরশিদ নেই, সে যেন এ গ্রন্থ পাঠ করে। গ্রন্থটি অধ্যয়নের বরকতে সে মুরশিদ পেয়ে যাবে।’ প্রতি বছর হজরত দাতা গঞ্জবখশ রহ:-এর বার্ষিক ওরসে সারা পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মানুষ লাহোরে তার মাজারে সমবেত হন, তবে খুব কম লোকই কাশফুল মাহজুবের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত। দাতা গঞ্জবাখশ রহ: মূলত একজন আলেম ছিলেন। আবু সাঈদ হাজবেরির পক্ষ থেকে তাকে তাসাউফ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করা হলে তিনি এর জবাবে গ্রন্থ রচনার ইচ্ছা করে ছিলেন।

গ্রন্থ রচনার আগে তিনি ইসতেখারা করেন। গ্রন্থে ইসতেখারার কারণও বর্ণনা করেছেন। তিনি গ্রন্থে কয়েকটি স্থানে নিজের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘একবার এক ব্যক্তি আমার কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়ে তা আর ফেরত দেয়নি। আমার কাছে এর দ্বিতীয় কোনো পাণ্ডুলিপি ছিল না। সে আমার নাম বিলুপ্ত করে তার নামে ওই কাব্যসঙ্কলন প্রকাশ করেছে। এভাবে সে আমার পরিশ্রম পণ্ড করে দেয়।’ তবে দাতা গঞ্জবখশ রহ: তার গ্রন্থে ওই চোরের নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছেন। বরং তিনি লিখেছেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করুন। সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি বলেন, “আমি তাসাউফ শাস্ত্রের ওপর একটি গ্রন্থ লিখেছি, যার নাম ‘মিনহাজুদ দীন’।


এক তোষামোদকারী, যার নাম আমি প্রকাশ করতে চাচ্ছি না, সে গ্রন্থের সূচনা থেকে আমার নাম সরিয়ে দিয়ে তার নাম লিখে দিয়েছে। আর বলে, এটা তার রচনা। অথচ তার যোগ্যতা সম্পর্কে জানা ব্যক্তিরা এ কাণ্ড দেখে হেসেছিলেন।” তিনি মনসুর হাল্লাজের বাণীর ওপর ‘শরহে কালামে মনসুর’সহ আরো গ্রন্থ রচনা করেছেন, তবে এখন শুধু কাশফুল মাহজুবেরই অস্তিত্ব দেখা যায়। কিছু মানুষ ‘কাশফুল আসরার’ নামের একটি পুস্তিকাকেও দাতা গঞ্জবখশ রহ:-এর রচনা বলে অভিহিত করেছে। তবে তার কয়েকজন জীবনীকার কাশফুল আসরারকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না। কাশফুল মাহজুবকে অনেক অমুসলিম গবেষকও তাসাউফের ওপর ফারসি ভাষার সর্বপ্রথম লিখিত ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ গ্রন্থের ভাষা প্রাচীন ফারসি।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর রেনল্ড এ নিকলসন প্রথমবার এ গ্রন্থকে প্রাচীন ফারসি থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে ১৯১১ সালে ব্রিটেনে প্রকাশ করেন। প্রফেসর নিকলসন ওই ব্যক্তি, যিনি মাওলানা রুমি রহ:-এর মসনবী, আল্লামা ইকবালের আসরারে খূদি, শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই ও বুল্লে শাহ-এর কবিতাও ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। আল্লামা ইকবাল ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর নিকলসনের ছাত্র ছিলেন। ধারণা করা হয়, ইকবালের মাধ্যমে কাশফুল মাহজুবের সাথে তার পরিচয় ঘটে। এক রুশি গবেষক যুকোভস্কিও দাতা গঞ্জবখশ রহ:-এর এ গ্রন্থ নিয়ে বেশ গবেষণা করেছেন এবং তা রুশ ভাষায় অনুবাদ করেন। এরপর ইরানে এ গ্রন্থের আধুনিক ফারসি সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। উর্দুতে কাশফুল মাহজুবের বেশির ভাগ অনুবাদক প্রফেসর নিকলসনের কাছে কৃতজ্ঞ। কেননা ইংরেজি থেকে উর্দুতে অনুবাদ করতে তাদের বেশ সুবিধা হয়েছে।

দাতা গঞ্জবখশ রহ:-এর প্রতি আল্লামা ইকবালের শ্রদ্ধা বেশ প্রসিদ্ধ। একবার তিনি আফগানিস্তান গিয়ে গজনীতে ওই স্থান খুঁজে বের করলেন, যেখানে দাতা গঞ্জবখশ রহ:-এর শ্রদ্ধেয় পিতা হজরত উসমান আলী হাজবেরি রহ:-এর মাজার। ওই মাজার জিয়ারতের কাহিনী বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) জাভেদ ইকবাল তার বাবা আল্লামা ইকবালের জীবনচরিত ‘যিন্দারূদ’-এ বর্ণনা করেছেন। সে তথ্যের সহযোগিতায় আমিও কয়েক বছর আগে গজনিতে হজরত উসমান আলী হাজবেরি রহ:-এর মাজার খুঁজে বের করে সেখানে ফাতেহা পাঠ করেছি। গজনীতে দাতা গঞ্জবখশ রহ:-এর মায়ের কবর স্বীয় ভাই তাজুল আওলিয়ার কবরের সন্নিকটে। দারাশিকোহ তার বাবা সম্রাট শাহজাহানের সাথে আফগানিস্তানে গেলে তিনি দাতা গঞ্জবাখশ রহ:-এর মামা তাজুল আউলিয়া ও তার মায়ের কবরে ফাতেহা পাঠ করেন। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাঝে মূল বন্ধন এই ওলিদের রক্তের সাথে সম্পর্কিত। দাতা গঞ্জবখশ রহ:ও গজনীর মানুষ ছিলেন। তবে তিনি ‘গজনবী’ নামে পরিচিত নন। তিনি নিজেকে জুল্লাবি ও হাজবেরি বলতেন।

জুল্লাব ও হাজবের মূলত গজনীর দু’টি মহল্লার নাম। দাতা গঞ্জবখশ রহ: মাহমুদ গজনবীর ছেলে মাসউদ গজনবীর সময় গজনী থেকে লাহোর আসেন। মাহমুদ রাজ্য জয় করতেন। আর দাতা গঞ্জবখশ রহ: জয় করতেন মানুষের হৃদয়। তার মুরিদরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন। ২৭ অক্টোবর লাহোরে তার মাজারে ‘গঞ্জবখশ রহ: আন্তর্জাতিক সম্মেলনে’ আফগানিস্তানের শহর গজনী থেকে আসা ভক্তরাসহ ইরান, তুরস্ক, ইরাক, ইয়েমেন, তিউনিসিয়া, সৌদি আরব, ভারত, ব্রিটেন ও আমেরিকার আলোচকদের দেখে অনুভব করলাম, সুফিদের শিক্ষা আন্তর্জাতিক সীমারেখার ঊর্ধ্বে।

দাতা গঞ্জবখশ রহ: আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেছিল পাঞ্জাবের ওয়াকফ অধিদফতর। সম্মেলনে পাঞ্জাবের ওয়াকফ মন্ত্রী পীর সায়্যিদ সাঈদ আল হাসান শাহকে একই সাথে উর্দু, ইংরেজি ও আরবি বলতে দেখে মনে বেশ সান্ত্বনা অনুভব করি যে, আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কিছু লোক এমনও আছেন, যারা নিজেদের পাণ্ডিত্য ও সুমিষ্ট ভাষা দিয়ে শ্রোতাদের প্রভাবিত করার যোগ্যতা রাখেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের রাজনীতিতে এমন চাটুকারদের সংখ্যা কম নয়, যারা ধর্মের নামে খারাপ কথা বলতে কুণ্ঠা করে না। নিজে আল্লাহকে ভয় করে না, সব সময় অন্যদের ভয় দেখায়। সাঈদ আল হাসান শাহ এক রুহানি পরিবারের সন্তান। পাঞ্জাবের ডাইরেক্টর জেনারেল সায়্যিদ তাহির রেজা বুখারিও একজন শিক্ষিত মানুষ। তার কাছে আবেদন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর নামে মন্দ কথা উচ্চারণকারী এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা বিস্তৃতকারী ব্যক্তির কাছে কাশফুল মাহজুবের অনুবাদ প্রেরণ করুন।

কেননা এ গ্রন্থে, দাতা গঞ্জবখশ রহ: তাসাউফকে শরিয়তের অনুগামী আখ্যায়িত করেছেন। যে ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে সুফি-দরবেশ আখ্যা দেয় শরিয়তের বিধানাবলিকে উপেক্ষা করেন, তিনি ইসলামের কোনো খেদমত করছেন না। এ গ্রন্থের ২৫তম অধ্যায়ে কথা বলার নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ভালো কথা ব্যতীত কিছুই বলো না। যদি নিজের জিহ্বাকে সংযত রাখো, তাহলে শয়তানের ওপর বিজয়ী হবে।’ দাতা গঞ্জবখশ রহ: নবী করিম মুহাম্মদ সা:-এর এ মহান বাণী উদ্ধৃত করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ও কিয়ামতের দিবসে বিশ্বাস করে, তার উচিত ভালো কথা বলা অথবা চুপ থাকা।’ এরপর রাসূলুল্লাহ সা:-এর আরো একটি বাণী উদ্ধৃত করেছেন, ‘আমার উম্মতের নিকট সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বস্তু জিহ্বা। আমি এটাকে ভয় করি।

নিজের আশপাশে একটু নজর বুলালেই আপনি মুখের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দাপট দেখতে পাবেন। তাদের মধ্যে এমন বাকপটুও আছে, যারা যুবকদের বিভ্রান্ত করে ওলিদের মাজারে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে এবং মুসলমানদের পরস্পরে লড়াই বাধাচ্ছে। কাশফুল মাহজুবে আপনি এশকে রাসূলই, সাহাবায়ে কেরামের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা দেখতে পাবেন; যা মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু ধর্মের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কুফরের ফতোয়া আরোপ করে থাকে।

এসব ব্যক্তিকে নিন্দা করার পরিবর্তে তাদের কাশফুল মাহজুব অধ্যয়নের প্রতি আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করা উচিত, যাতে তারাও কোনো মুরশিদ পেয়ে যায়, যিনি তাদের আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল সা:-এর ভালোবাসার দাবিগুলো বোঝাবেন। প্রিয় পাঠক! যদি আপনি কাশফুল মাহজুব এখনো অধ্যয়ন করে না থাকেন, তাহলে তা পড়ে নিন। হতে পারে আপনিও মুরশিদ পেয়ে যাবেন। 

হামিদ মীর : পাকিস্তানের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)

দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব


আরো সংবাদ



premium cement
চোখের সেবা সম্প্রসারণে অরবিসের সাথে কাজ করব : ড. ইউনূস ‘দিনে দাওয়াতি কাজ করতে হবে আর রাতে আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে’ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রাণি ও পরিবেশের জন্য বড় হুমকি নতুন পর্যটন গন্তব্যের সন্ধান করছে সরকার : হাসান আরিফ বানারীপাড়ায় হত্যা ও প্রতারণা মামলায় গ্রেফতার ২ রাবির আরবি বিভাগের নতুন সভাপতি অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম ‘ট্রাম্পের সাথে অভিন্ন ক্ষেত্র খুঁজে পাবেন অধ্যাপক ইউনূস’ তাজিকিস্তানকে হারাল বাংলাদেশ ছাত্র-জনতা বুকের রক্ত দিয়ে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছে : মির্জা ফখরুল খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি ফেরতের দাবি জানালেন আলাল টানা দুই ওভারে ২ উইকেট শিকার তাসকিনের

সকল