২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চীন-মার্কিন সমীকরণ নিয়ে ইমরান খানের ভাবনা

ইমরান খান - ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তানের রাজনৈতিক বৃত্তে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) নিয়ে একটি নতুন বিতর্ক চলছে। এই বিতর্ক হলো, সিপিইসি দেশের জন্য কতটা কল্যাণ বয়ে আনবে আর এটি পুনর্মূল্যায়ন করার কি সময় এসেছে? ইমরান খান সরকারের এই পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি কৌশল বলে মনে হচ্ছে। জনাব খান সিপিইসির ব্যয় ও প্রাপ্তি বিশ্লেষণ করতে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন।

দেশটির বাণিজ্য, বস্ত্র, শিল্প ও বিনিয়োগমন্ত্রী আবদুল রাজ্জাক দাউদ বলেছেন, ‘পূর্ববর্তী সরকার সিপিইসিকে নিয়ে চীনের সাথে যে চুক্তি-সমঝোতা করেছে, তা ঠিকভাবে করেনি। তারা সঠিকভাবে তাদের হোমওয়ার্ক করেনি এবং সঠিকভাবে আলোচনাও করেনি।’ তিনি উল্লেখ করেছেন, সিপিইসি-সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগে কর ও অন্যান্য রেয়াতসহ চীনা কোম্পানিগুলো ‘অযৌক্তিক সুবিধা’ পেয়েছে। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, ‘(পাকিস্তান) এক বছরের জন্য সব কিছু স্থগিত রাখতে পারে, যাতে এরপর আমরা একসাথে আমাদের কাজ করতে পারি।’

শুরু থেকেই সিপিইসি পাকিস্তানের জন্য একটি ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে, যা পাকিস্তানের অবকাঠামোকে উন্নত করবে, চাকরির সুযোগ তৈরি করবে, অসুস্থ অর্থনীতির উন্নতি করবে এবং দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হবে দেশটি। তবে সিপিইসির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জুন ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসে। দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে শ্রীলঙ্কা চীনা ঋণ পরিশোধের জন্য গুরুতর পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার পর পাকিস্তানের বিশ্লেষকেরা সিপিইসিতে পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষা ও স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখন পাকিস্তান সরকার সিপিইসিকে পুনর্বিবেচনার কথা কেন বিবেচনা করছে? এই সময়টাকে আরো বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

সিপিইসির নবায়ন নিয়ে বিতর্কের একটি কারণ হলো, পাকিস্তান সরকারের নতুন প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতার বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরার জন্য প্রধানমন্ত্রী খানের দৃষ্টিভঙ্গি। ইমরান খান একসময় সিপিইসিকে নিয়ে গোপনীয়তা এবং পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর মধ্যে প্রকল্পটির অসম সুবিধার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তার দলের এক সদস্য একবার সিপিইসিকে ‘চীন-পাঞ্জাব অর্থনৈতিক করিডোর’ বলে অভিহিত করে তুলে ধরেন যে, পাঞ্জাব সিপিইসি প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগ পেয়েছে আর অন্যান্য প্রদেশ বঞ্চিত হয়েছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, খান ও তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) বারবার সমঝোতায় স্বচ্ছতার অভাবের জন্য নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পূর্ববর্তী সরকারকে সমালোচনা করেছিল এবং খান প্রাথমিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী বক্তব্য নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে এখন এটি বোঝানো পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে যে, তার সরকারের চীনের সাথে কার্যক্রমে গোপনীয়তা কিছু নেই এবং সিপিইসি সম্পর্কিত বিষয়ে পাকিস্তান তার স্বার্থে কোনো আপস করবে না।

আরেকটি কারণ হলো, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রত্যাশিত পুনরুদ্ধার কর্মসূচির সাথে যুক্ত, আমেরিকান চাপ বাড়তে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিয়েছে, ওয়াশিংটনে ইসলামাবাদকে আইএমএফ ঋণ প্রদানের অনুমতি দেয়া হবে না, যদি পাকিস্তান ঋণ হিসেবে প্রদত্ত অর্থ সিপিইসির সাথে যুক্ত চীনা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যবহার করে। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য আইএমএফ পুনরুদ্ধার ঋণ যখন জরুরি প্রয়োজন, এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে পারে না ইসলামাবাদ। আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তির জন্য বেইজিংকে অর্থ পরিশোধ বিলম্বিত এবং চীন-নির্ভরতা হ্রাস করার জন্য সিপিইসির শর্তগুলো পুনর্নির্ধারণ করার একটি ধারণা আছে পাকিস্তান সরকারের।

এ প্রসঙ্গে ইমরান খানের সরকার সিপিইসির আওতায় বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের মতো মানব উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণ প্রকল্পগুলো অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় বিবেচনা করতে চায়। পিটিআইয়ের নির্বাচনী প্রচারণায় সামাজিক সেবা চালুর জন্য একটি উচ্চাকাক্সক্ষী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে এবং দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সিপিইসিকে পাকিস্তানের জন্য সহজ করবে। এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে জনাব খান এবং পিটিআই দু’টি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন।

সিপিইসিতে একটি মানবিক বিকাশের দৃষ্টিকোণ যোগ করে খান শুধু সামাজিক স্কিম প্রদানের পক্ষে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করেই নয়, একই সাথে বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখাওয়ায় যারা সিপিইসির ওপর সেভাবে আস্থা না রেখেও শান্তি বজায় রেখেছেন, তাদের স্বার্থকেও সমুন্নত করে বোঝাতে চাইছেন; এই চীনা প্রকল্পটি প্রকৃতপক্ষে সার্বিকভাবে পাকিস্তানি জীবনমানকে উন্নত করতে ভূমিকা রাখতে পারবে। সিপিইসিকে নিয়ে নতুন বিতর্ক শুধু চীনের ‘ঋণফাঁদ কূটনীতি’কে সামনে আনেনি, বরং ড্রাগন এবং ডলারের মধ্যে পাকিস্তানের ডায়ালেমাকেও সামনে নিয়ে এসেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও-এর পরপরই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের পাকিস্তান সফর সিপিইসি নিয়ে পাকিস্তানকে প্রভাবিত করার জন্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত দেয়। যদি পাকিস্তান স্বচ্ছতা ছাড়াই সিপিইসি প্রকল্প চালিয়ে যায়, তবে দেশটি আইএমএফের পুনরুদ্ধারঋণ পেতে মার্কিন সমর্থন হারানোর ঝুঁকির মুখে পড়বে এবং ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্ক আরো খারাপ হয়ে যাবে। অন্য দিকে, পাকিস্তান যদি সিপিইসির বিষয় চীনের সাথে পুনর্নির্ধারণের চেষ্টা করে, তবে এটি বেইজিংয়ের সাথে ইসলামাবাদের সর্বকালের বন্ধুত্বের সম্পর্কের জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে এবং ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রচেষ্টায় তা বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। কিভাবে পাকিস্তানের ক্যাপ্টেন এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনবেন, সেটিই দেখার বিষয়।
সাউথ এশিয়ান ভয়েস থেকে অনুবাদ মাসুমুর রহমান খলিলী


আরো সংবাদ



premium cement