নির্বিচার গ্রেফতারের শিকার হচ্ছে শ্রীলঙ্কার মুসলিমেরা
- লিসা ফুলার ও রুকশানা রিজভি
- ১৭ জুন ২০১৯, ০৮:৪৫
গত ১৭ মে মধ্য শ্রীলঙ্কার পুলিশ আবদুল রহিম মাজাহিনাকে নামের এক ৪৭ বছর বয়স্ক নানিকে গ্রেফতার করে। তার পোশাকের ধরনের জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়।
পোশাকটির মটিফ ছিল জাহাজের চাকার মতো। কিন্তু পুলিশ মুসলিম নারী মাজাহিনাকে জানায়, তারা মটিফটি বৌদ্ধপ্রতীক ধর্মচাকার মতো মনে হওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
মাজাহিনার হাঁপানি ও উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, আগেও তিনি এই পোশাক অনেকবার পরেছেন। তিনি বলেন, এটা যদি ধর্মচাকা হতো, তবে আরো আগেই অনেকে বলত।
শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক বিভাগ পরে কর্তৃপক্ষকে জানায়, প্রতীক সত্যিই ধর্মচাকা কিনা তা তারা নির্ণয় করতে পারছে না।
রাজধানী কলম্বো থেকে ১৩০ কিলোমিটার পূর্বে থাকা হাসালাকা পুলিশ বিদ্বেষ প্রচারের আইনে মাজাহিনাকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতি উস্কে দেয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে বলে তার আইনজীবী ফাতিমা নুশরা জারুক জানান।
পুলিশের মুখপাত্র রুয়ান গনেসেকারা আলজাজিরাকে বলেন, ইস্টার বোমা হামলা বা এর সাথে সম্পৃক্ত ঘটনার জন্য মোট ২২৮৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে মুসলিম হলো ১,৭২০ জন। আর মাজাহিনার বিরুকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার পোশাকের কারণে।
গত ২১ এপ্রিল বিলাসবহুল হোটেল ও চার্চে হওয়া ওই হামলায় ২৫০ জনের বেশি নিহত ও ৫০০ জন আহত হয়। ইসলামিক স্টেট (আইএস) এই হামলার দায়িত্ব শিকার করেছে।
আটকদের মধ্যে ১,৬৫৫ জন জামিনে মুক্তি পেলেও এখনো ৬৩৪ জন হেফাজতে রয়েছে। আর যে ৪২৩ জন রিমান্ডে রয়েছেন, তাদের মধ্যে ৩৫৮ জন মুসলিম।
মাজাহিনা কান্না দমন করতে করতে বলেন, থানায় দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা আমার স্কার্ফ খুলে নিতে বলে, অন্য অফিসাররা আমার ফটো তোলে।
কারাগারে ১৭ দিন অবস্থানকালে প্রহরীরা প্রায়ই তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে ডেকেছিল। ৩ জুন আদালত তার জামিন দেয়। তবে তাকে নভেম্বরে আদালতে ফিরতে হবে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে দুই বছর পর্যন্ত কারাভোগ করতে হবে।
গভীর উদ্বিগ্ন ইইউ
শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ বৌদ্ধ, মুসলিম ১০ ভাগেরও কম। হিন্দু ও খ্রিস্টানরা বাকি জনসংখ্যা।
কারাগারে থাকার সময় মাজাহিনার রক্তচাপ বেড়ে যায়। বাড়ি ফেরার পর থেকে তিনি অসুস্থ রয়েছেন। তার স্বামী দিনমজুর। তার পরিচর্যার জন্য তিনি এখন কাজে বের হতে পারছেন না। ফলে পরিবারটির আয়ের কোনো উৎস নেই।
মুসলিমদের টার্গেট করা নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছে হিউম্যান রাইটস কমিশন অব শ্রীলঙ্কা। এটি সরকারি সংস্থা।
সংস্থার চেয়ারম্যান দীপিকা উদুগামা বলেন, আমরা এ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত প্রধানকে বিষয়টি জানিয়েছি।
জাতিসঙ্ঘ নির্বিচার গ্রেফতারবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, দেশটির বিচারব্যবস্থা এমনই যে নির্বিচার গ্রেফতার এড়ানো খুবই কঠিন কাজ।
অবশ্য ইস্টার হামলার আগে নির্বিচার গ্রেফতারের শিকার হতো হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী জাতিগত তামিলরা।
শ্রীলঙ্কায় ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের সময় তালিম টাইগাররা স্বাধীন তামিল রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করেছিল।
মুসলিমদের নির্বিচারে গ্রেফতার প্রসঙ্গে পুলিশের মুখপাত্র গুনাসেকারা বলেন, এটা কিভাবে বলা সম্ভব। কারো কোনো আপত্তি থাকলে তারা অভিযোগ দায়ের করতে পারে।
তিনি দাবি করেন, পুলিশ এ ধরনের কোনো অভিযোগ পায়নি।
বুধবার ইউরোপিয়ান কমিশন এক বিবৃতিতে জানায়, তারা শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের ওপর পরিচালিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চাপ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এতে দেশটির শান্তি ও ঐক্যপ্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জেজিমা (ছদ্মনাম), ৫৮, আলজাজিরাকে বলেন, তার স্বামী পুলিশ হেফাজতে থাকার সময় নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর তিনি অভিযোগ দিতে গেলেও তা নেয়া হয়নি।
ওই লোকের কাছে দুটি পাসপোর্ট কেন, তা জানতে চেয়েছিল পুলিশ। তিনি তা জানাতে থানায় যাওয়ার পর হারিয়ে যান।
জেজিমা বলেন, দুটি পাসপোর্ট থাকা কোনো বিষয় নয়। এর একটি মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া পুরনো, অপরটি নতুন।
তিনি বলেন, থানায় যাওয়ার পর তার স্বামী আর ফেরেনি। পুলিশ তার সম্পর্কে কোনো খবর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
আল জাজিরা ২০ বছর বয়স্ক আসলাম রিজভির সাথে কথা বলেছে। তাকে আটক করা হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত একটি এসডি মেমরি কার্ডের জন্য। আর তার প্রতিবেশী আবদুল আরিসকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ইস্টার হামলার ফুটেজ রাখার জন্য।
শ্রীলঙ্কা মুসলিম কংগ্রেসের নেতা রউফ হাকিম বলেন, তুচ্ছ কারণেও গ্রেফতার ও হয়রানি চলছে। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
তিনি বলেন, এটা সত্য যে ২১ এপ্রিলের হামলাকারীরা আমাদের সম্প্রদায়ের সদস্য ছিল। কিন্তু হামলার প্রথম দিন থেকেই মুসলিমরা তদন্তকারীদের সাথে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু তবুও মুসলিমরা মারাত্মক দুর্ভোগে রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি দমনপীড়ন হচ্ছে পূর্ব উপকূলের কাতানকুডিতে। এখানেই ইস্টার হামলার মাস্টারমাইন্ড জাহারান হাশিমের বাড়ি।
সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলেন, আমরা এখানে সবাই ভীত। অনেক নির্দোষ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ সন্দেহজনক মনে করলেই আমাদের ডাকছে।
আল জাজিরা