২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

২০২০ সালের মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়ার ভূমিকা

-

দ্রুত পরিবতনশীল ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলের একটি মধ্যপ্রাচ্য। চলতি দশকের শুরু থেকে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন অবয়ব ও মেরুকরণ ঘটছে এই অঞ্চলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন একতরফা প্রভাব বিস্তারে আর কোনো বাধা থাকেনি। সোভিয়েত বলয়ে থাকা দেশগুলো নিজস্ব শক্তি বা আঞ্চলিক মেরুকরণের মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের সরকার ভেঙে পড়ে। আরব বসন্তের রেশ ধরে ক্ষমতার অবসান ঘটে লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহর। আরব বসন্তের শেষ আঘাত মোকাবেলা করে টিকে থাকার প্রয়াস চালাতে থাকে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ। আঞ্চলিক শক্তি ইরান ও এর ছায়া শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ সহায়তায় কয়েক বছর পার করার পর বিমান ও সেনা সহায়তা নিয়ে হাজির হয় রাশিয়া। এরপর মাঠ পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার পরও টিকে যায় বাশার আল আসাদ।

সিরিয়ার রুশ নীতির সাফল্য ও বাশার আল আসাদের টিকে যাওয়া পাল্টে দেয় মধ্যপ্রাচ্যের হিসাব-নিকাশ। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার নীতি গ্রহণ করে। ঐতিহ্যগত মার্কিন মিত্র দেশগুলো নিজেদের অরক্ষিত ভাবতে শুরু করে। আরব বসন্তে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে একের পর এক আমেরিকান মিত্র সরকারের পতনের পর ওয়াশিংটনের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজা ও আমির শাসিত কয়েকটি দেশও আস্থাহীন হয়ে পড়ে। এ সময়ে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে অসামান্য অগ্রগতি এবং পুতিনের আক্রমণাত্মক কৌশলী নীতি রাশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যে বিকল্প আস্থার শক্তিতে পরিণত করে। অর্থনৈতিক জায়ান্ট হিসাবে আবির্ভূত চীনের সাথে রাশিয়ার বিশেষ কৌশলগত সমঝোতা দুই শক্তির প্রাধান্য বিস্তারে সহায়ক হয়। এতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর হিসাব-নিকাশেও পরিবর্তন দেখা দেয়। তবে এর মধ্যেও রাশিয়ার রয়েছে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা। এসব বিশ্লেষণ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির নতুন ভূমিকা নিরূপণের চেষ্টা হয়েছে এখানে।

রাশিয়া প্রধান খেলোয়াড় হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে এলেও এর প্রভাব বিস্তারের উপকরণ বা সামর্থ্য সীমিত। মোটা দাগে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নীতিগত পরিবর্তনগুলো রাশিয়ার সামনে একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ২০১৫ সালে সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ মস্কোর মধ্যপ্রাচ্যের নীতির এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। পূর্বের দুই দশকের মধ্যপ্রাচ্য থেকে মোটা দাগে অনুপস্থিত থাকার পর রাশিয়া বাশার আল-আসাদের শাসনকে রক্ষায় দেশটিতে হস্তক্ষেপ করে, আর এ অঞ্চলের ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজেকে একজন প্রধান খেলোয়াড় হিসাবে আবির্ভূত করে। মস্কোর সামরিক শক্তির সাহসী ব্যবহারই পুতিনকে মধ্যপ্রাচ্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেকে প্রত্যাহার এবং সেখানে ওয়াশিংটনের ভবিষ্যৎ ভূমিকা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধির পটভূমিতে এই হস্তক্ষেপ হয়। লিবিয়া ও সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের কারণে ভৌগোলিক পুনর্জাগরণ ও অস্থিতিশীলতা এবং ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার বৈরিতা রাশিয়ার পক্ষে পুরনো সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং নতুন সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে। সম্পর্কের নতুন এই গুণগত অবস্থাটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মধ্যে ব্যক্তিগত কূটনীতির পক্ষে একটি বড় অর্জন। তবে সিরিয়ায় রাশিয়ার বড়ভাবে উপস্থিতিতে ইসরাইলের এখন মস্কোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া আর উপায়ও নেই। কিছু ইসরাইলি কর্মকর্তা আশা করছেন, সবচেয়ে বড় হুমকি সিরিয়া-ইরান এবং হিজবুল্লাহর মোকাবেলায় মস্কো তাদের সহায়তা করবে। এখন অবধি রাশিয়া ইসরাইলের কিছু চাহিদা হয়তো এ ক্ষেত্রে পূরণ করেছে, তবে ইসরাইল দেশটির কাছ থেকে যা চায় তা থেকে বাস্তব প্রাপ্তি বেশ দূরে। আর সিরিয়ায় রাশিয়ার মূল অংশীদার ও সহযোগী ইরানের সাথে সম্পর্ক মস্কো ভাঙতে চায় এমন সামান্য লক্ষণই রয়েছে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ফলে রুশ-ইরান সম্পর্ক অস্বাভাবিক এক মাত্রায় রূপান্তরিত হয়। তাদের যৌথ বিজয় সম্ভবত কিছু ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থগত বৈপরীত্য সৃষ্টি করতে পারে। রাশিয়া সিরিয়াকে আগের মর্যাদায় ফিরিয়ে দিতে এবং শান্তি ও পুনর্গঠনের সুবিধাগুলো কাটাতে আগ্রহী। অন্য দিকে ইরান ইসরাইলের বিরুদ্ধে অভিযানে সিরিয়াকে প্লাটফর্ম হিসেবে কাজে লাগাতে চায়। ইরানকে প্রভাবিত করতে রাশিয়ার পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি এবং কূটনৈতিক সুবিধার কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে মস্কোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন ক্ষেত্রেও একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ফলে রাশিয়া-তুরস্ক সম্পর্ক একটি নতুন পর্যায়ে এসেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে রাশিয়া-তুরস্ক সম্পর্কের বেশ উন্নতি হয়; বাণিজ্য ও জ্বালানি সম্পর্ক এবং পশ্চিমের প্রভাব থেকে দূরবর্তী হওয়ার ধারণা এখন সেই সম্পর্কের মূল চালিকাশক্তি। সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এটিকে একটি নতুন গুণগত অবস্থা এনে দিয়েছে। যেহেতু এটি সিরিয়ায় তুর্কি হিসাব-নিকাশে পরিবর্তন এনেছে, ফলে সেখানে আঙ্কারার সামনে রাশিয়ার অগ্রাধিকারের সাথে মানিয়ে চলার বিকল্প নেই। আগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি এবং আঙ্কারার নিরাপত্তা স্বার্থকে অব্যাহতভাবে উপেক্ষার কারণে তুরস্ক ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদ রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে আরো গভীর করেছে। যাহোক, ভূ-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক পার্থক্য যা দুই শক্তির মধ্যে বিভক্তি এনেছিল সেসব ক্ষেত্রে সম্পর্কটিকে সত্যিকারের অংশীদারিত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অবকাশ খুব কমই রয়েছে।

তুরস্কের মতোই, সৌদি আরবেরও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের বিকল্প ছিল না। সিরিয়ার দ্বন্দ্ব এবং ইরানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফলের অংশীদারিত্ব ছাড়াও, সৌদি আরবের এমন একসময় রাশিয়ার সাথে তেল উৎপাদন সমন্বয়ে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে যখন উভয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জ্বালানি উৎপাদন ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তীব্র লড়াইয়ে নামে। সৌদি বাদশাহ সালমানের ২০১৭ সালের মস্কো সফর প্রথম এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ ছিল এবং এ সময় দুই জ্বালানি শক্তি তাদের তেল রফতানি নীতি সমন্বয় করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে ইসরাইলিদের মতো সৌদিদেরও হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যে, রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক আরো নিবিড় করার জন্য ইরানের সাথে অংশীদারিত্ব পরিত্যাগ করার যে প্রত্যাশা রিয়াদের এক সময় ছিল সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবুও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মধ্য প্রাচ্যের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ও অংশগ্রহণ কমানোর পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। এ কারণে রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক খুব নির্ভরযোগ্য না হলেও অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে একটি বাড়তি অবলম্বন সৃষ্টি করতে পারে মনে করে সব দেশই মস্কোর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় এখন বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে।

উত্তর আফ্রিকাতে রাশিয়ার প্রত্যাবর্তনকেও এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রের নিষ্ক্রিয়তার পটভূমিতে বিবেচনা করতে হবে। ১৯৭০ এর দশকে মস্কো এবং কায়রোর মধ্যকার সম্পর্ক অবনতির দিকে যায় মিসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আকস্মিকভাবে ঝুঁকে পড়ার কারণে। মিসরে ২০১৩ সালের গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পরে এবং রাষ্ট্রপতি পদে আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির উত্থানের পরে এই সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য পাশ্চাত্যে সমালোচিত, সিসি ওয়াশিংটনের পরিত্যাগের অবস্থা সৃষ্টি হলে সহায়তা করতে একজন সুবিধাজনক অংশীদার হিসেবে পান পুতিনকে। আর রাশিয়ার অস্ত্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মিসর। তাদের বোঝাপড়া ও লেনদেন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, রাশিয়া ও মিসর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে জেনারেল খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে (এলএনএ) সমর্থন করার ক্ষেত্রে অংশীদার হয়েছে। আর এর বিপরীতে জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত জিএনএ সরকারকে সমর্থন ও সহায়তা দিচ্ছে তুরস্ক। এলএনএর পক্ষে সিদ্ধান্তকারী জয় অর্জনে রুশ সমর্থনপুষ্ট অভিযানে দেশটি খুব খারাপভাবে ভেঙে পড়েছে। মস্কো আশা করে, এ সঙ্ঘাতের অবসানের পর মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুতে হারানো বাণিজ্যিক সুযোগ আবার ফিরে পাবে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের গতিপথকে উল্টে দিয়ে এবং একজন পুরনো মিত্রকে পতনোন্মুখ অবস্থা থেকে বাঁচিয়ে মস্কো মধ্যপ্রাচ্যের অন্য সরকারগুলোকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল যে, রাশিয়া নির্ভরযোগ্য অংশীদার। খুব সম্ভবত কেউ এখন আর দ্বিমত করবে না যে, মস্কো নিজেকে কয়েক দশকের অবিসংবাদিত মার্কিন সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। রাশিয়া এ অঞ্চলের সব দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে সব পক্ষের কাছে নিজেকে মূল্যবান মধ্যস্থতাকারী বা কথোপকথক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

এটিই মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য আর এটি আবার রুশ শক্তি ও প্রভাবের সীমাবদ্ধতারও প্রতীক। মারাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জর্জরিত এক অঞ্চলে, পক্ষ না নিয়ে সবার সাথে কথা বলার এক ধরনের অবস্থানের সীমিত উপযোগিতা রয়েছে। ক্ষমতা প্রদর্শন এবং অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার সীমিত সংস্থানের কূটনৈতিক লিবারেজ বা সুবিধাকে মূলত সব পক্ষের সাথে কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। এ অঞ্চলের অগণিত সমস্যার কোনোটির সমাধান করতে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এ কারণে যথেষ্ট হবে বলে মনে হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে আসাটি গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার নীতিগত অবস্থান পাল্টানোর ক্ষেত্রে এটি খুব কমই ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয়। রাশিয়া যা অর্জন করেছে এর বেশির ভাগের জন্য এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্বিবেচনা তথা নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার নীতি দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো সেখানে তার নিজস্ব স্বার্থকে সংজ্ঞায়িত করা এবং রক্ষা করা। আর রাশিয়ার স্বার্থ এবং নীতি-চালকদের সম্পর্কে আরো ভালো ধারণা অর্জন করা। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ান স্বার্থ কোনো ক্ষেত্রে সঙ্ঘাতে পড়বে সেটিও নিরূপণ করতে হবে। আমেরিকান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির বিকাশ কিভাবে করবে, কিভাবে সিরিয়ায় রাশিয়ার সাথে সঙ্ঘাত এড়ানোর প্রচেষ্টা সফর করবে এবং সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলে সহাবস্থানের একটি মডেল তৈরি করবে সেই ধরনের চিন্তাভাবনার মধ্যে রয়েছে বলে মনে হয়। এই বাস্তবতায় ২০২০ সালে মধ্যপ্রাচ্যের গতি-প্রকৃতিকে বিবেচনা করতে হবে।

২০২০ সালের যাত্রালগ্নে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তিধর দেশ রয়েছে তিনটি- ইরান, সৌদি আরব ও তুরস্ক। এর বাইরে রয়েছে বৈশ্বিকভাবে প্রভাবশালী ক্ষুদ্র দেশ ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ও বিন্যাসে এই চার দেশের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। সৌদি আরব ও তার উপসাগরীয় মিত্র দেশগুলো নিজস্ব নিরাপত্তায় প্রায় শতাব্দীকাল ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ছিল অঙ্গীকারবদ্ধ। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করেছে সব সময়। ইসলামের শিয়া ধারার শক্তিমান এই দেশ আঞ্চলিকভাবে প্রভাব বিস্তারের জন্য শুরু থেকে সক্রিয় ছিল। তুরস্ক হলো মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। কিন্তু নিজস্ব নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্বার্থ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নানা স্বার্থ-দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে দেশটি। ইসরাইল হলো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবিসংবাদিত মিত্র। যে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিশেষভাবে নির্ভরশীল, আবার যুক্তরাষ্ট্রও মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য নির্ভরশীল এই দেশটির ওপর।

আঞ্চলিক শক্তিধর প্রতিটি দেশই তার নিজস্ব নিরাপত্তা ও প্রভাব বিস্তার করতে রাশিয়ার সাথে বিশেষ কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বোঝাপড়া করছে। প্রতিটি দেশ ও শক্তির সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক হলো স্বার্থ নির্ভর ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশকেন্দ্রিক। এ অবস্থায় ২০২০ সালে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত ইস্যুগুলোর সমাধান বা পরিণতি কী হবে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নতুন বছরে যেসব ইস্যু বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে সেগুলো হলো- সিরীয় পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট অবয়ব প্রদান। রাষ্ট্রের ওপর সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, তুরস্কের নিরাপত্তা করিডোর ও কুর্দি ইস্যুর নিষ্পত্তি এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণের মাধ্যমে চূড়ান্ত শান্তি ফিরিয়ে আনা। আমেরিকা উত্তর সিরিয়া থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার মধ্য দিয়ে মনে হয় সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ওয়াশিংটন বড় কোনো ভূমিকা নেবে না। এখানে রাশিয়া ইরান তুরস্কের সমন্বয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো নিষ্পত্তির যে প্রয়াস চলছে সেটি এগিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বেইস লাইন হতে পারে দেশটির অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। এর জন্য সিরিয়ার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা নির্ধারণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি ব্যবস্থা চালু করার প্রতি সব পক্ষকে গুরুত্ব দিতে হবে। ২০২০ সালে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হতে পারে।

লিবিয়ায় জিএনএ ও এলএনএর মধ্যকার গৃহযুদ্ধ এখন বাজে এক অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। হাফতারের বাহিনীকে সমর্থন করছে মিসর, সৌদি আরব, আমিরাত ও রাশিয়া। অন্য দিকে জিএনএ সরকারের পক্ষে রয়েছে তুরস্ক ও কাতার। যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা পালন করছে একবারে নিষ্ক্রিয়। এ অবস্থায় রাজধানী ত্রিপোলি রক্ষায় জিএনএ সরকার ব্যর্থ হলে একটি বিপর্যয় নামতে পারে দেশটিতে। তুরস্ক কতটা কার্যকর ভূমিকা জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সরকারের পক্ষে পালন করে, সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে লিবিয়ার রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে পড়েছে। সব পক্ষ লিবিয়ার তেল সম্পদ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। রাজনৈতিক সমঝোতাই এ ক্ষেত্রে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করতে পারে।

ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের অবসান মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সৌদি আরব ও হাউছিদের মধ্যে সমঝোতার একটি প্রচেষ্টা নিয়েছিল পাকিস্তান। ইমরান খান সৌদি চাপের মুখে মধ্যবর্তী ক্ষমতাশালী মুসলিম দেশগুলোর কুয়ালালামপুর সম্মেলন থেকে শেষ মুহূর্তে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এই পদক্ষেপ দেশটির সমঝোতার সক্ষমতাকে কিছুটা দুর্বল করতে পারে। তবে সব পক্ষের জন্য ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো খুবই প্রয়োজন। রিয়াদ ও তেহরান দুই পক্ষের মধ্যেও এই উপলব্ধি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে ডোনাল্ট ট্রাম্প বসার পর ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যু এখন এক ক্রান্তিকালে চলে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই একটি ইস্যুতেই ট্রাম্প প্রশাসন সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। ট্রাম্প এর আগের দুই রাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সমাধানের উদ্যোগ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে জেরুসালেমে ইসরাইলের রাজধানী স্থানান্তর এবং পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকে বৈধতা দিয়েছেন। এর ফলে শান্তি প্রক্রিয়া এক প্রকার ভেঙে পড়েছে। আরব স্বার্থ সুরক্ষার মৌলিক এজেন্ডা পরিত্যাগ করে আমিরাত আর সৌদি আরব ক্ষমতার নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এর ফলে ফিলিস্তিন ইস্যুর মৌলিকভাবে অবনতি ঘটেছে। তুরস্ক উম্মাহর ইস্যুটিকে কতটুকু সামনে নিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে। তবে সার্বিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে এক ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আরব জাগরণের শক্তিগুলোর পুনরুত্থানও ভেতর থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২০ সালে সার্বিকভাবে এটি আশাবাদী একটি দৃশ্যপট সৃষ্টি করতে পারে।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement