২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কার মতিভ্রম কে দেয় মাশুল

-

বাংলা ‘মতি’ শব্দের একাধিক অর্থ। এর মধ্যে একটি হচ্ছে স্মৃতি বা স্মরণশক্তি। আর ‘ভ্রম’ মানে নাশ, লোপ, নষ্ট বা ভ্রষ্ট। এই দুয়ে মিলে ভিন্ন আরেকটি শব্দ হয় মতিভ্রম, মানে স্মৃতিভ্রষ্ট। কারো স্মৃতি লোপ পেলে অনেকসময় অন্যের জন্য তা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন ঘটনার নজির সমাজে ভূরি ভূরি। তেমন একটি ঘটনার বয়ান করতে এ লেখার শিরোনাম ‘কার মতিভ্রম কে দেয় মাশুল’। একজনের মতিভ্রমে আরেকজন কিভাবে মাশুল গোনেন সাম্প্রতিক একটি ঘটনা এর জ্বলন্ত উদাহরণ। ধর্ষণ মামলায় এক নয়নের পরিবর্তে আরেক নয়ন গ্রেফতার হয়েছিলেন। ঘটনাটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। ওই ঘটনায় বিনা দোষে নির্দোষ নয়নকে যেনতেন মূল্য পরিশোধ নয়, একেবারে কারাবাস করতে হলো। ২৭ দিন কারাবন্দী থাকার পর জামিনে মুক্তি মিলেছে।

ক্ষণিকের জন্য হলেও কপালে জোটে কলঙ্কতিলক। লেপটে যাওয়া সেই তকমা ভয়ঙ্কর। রাতারাতি হয়ে যায় ধর্ষক অর্থাৎ র‌্যাপিস্ট। ঘটনা জেনে তার জন্য অনেকের মন খারাপ হবে। কারো গা শিউরে উঠবে এই ভেবে যে, এ-ও কি সম্ভব! চেনাজানা প্রেমিকের চেহারা ভুলে যাওয়া? মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে এটি কেমন ‘প্রেম’? গ্রাম্য চালাকির গ্যাঁড়াকলে পড়ে দুর্বিপাকে পড়েছিলেন ওই তরুণ। তবে বলতে হবে, তার ‘কপাল ভালো’। অবশেষে আসল আসামি ধরা পড়ায় মুক্তি মিলেছে। তা না হলে জাহালমের মতো কত দিন যে জেলের ঘানি টানতে হতো, বলা দুষ্কর। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, জাহালম আর নির্দোষ ওই তরুণের বাড়ি একই জেলা টাঙ্গাইলে। করুণাময় আল্লাহ দু’জনকেই রক্ষা করেছেন।

বাংলায় প্রবাদ আছে- ‘নামে নামে যমে টানে’। বেচারা নির্দোষ নয়নেরও হয়েছে সে দশা। অভিযুক্তের নামের সাথে নামের মিল থাকায় তাকে ধকল পোহাতে হলো। এই স্মৃতি তাকে বয়ে বেড়াতে হবে জীবনভর। মানসিক ক্ষত কাটিয়ে উঠতে কত দিন লাগবে, আল্লাহ মালুম। তাৎক্ষণিকভাবে বৈষয়িক লোকসানও গুনতে হয়েছে কড়ায়-গণ্ডায়। প্রকৃত আসামি নয়ন পুলিশের কাছে ধরা পড়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দীও দেন। তারপরও নির্দোষ নয়নকে অতিরিক্ত ১৬ দিন হাজত খাটতে হয়। অথচ এবার স্নাতক (পাস) তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু কারাগারে থাকায় পরীক্ষা দেয়া হয়ে ওঠেনি। শিক্ষাজীবনের এই অপূরণীয় ক্ষতি কিভাবে পুষিয়ে নেবেন, বলা মুশকিল। যে কিশোরীর শনাক্তকরণের ভুলে তাকে চড়া মূল্য দিতে হলো, এর দায় কার? সে প্রশ্নই ঘুরেফিরে উচ্চারিত হচ্ছে। টাঙ্গাইলের সখীপুরে এটা ঘটেছে।

ঘটনার সূত্রপাত- বেড়ানোর কথা বলে কক্সবাজার নিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এমন অভিযোগে থানায় মামলা করার পর। ওই মামলায় নির্দোষ নয়ন গ্রেফতার হলেন। কারাগারে যাওয়ার আগে নয়নের আকুতি ও ভুক্তভোগী কিশোরীর কথাবার্তায় গ্রেফতারকৃত নয়নই প্রকৃত আসামি কি না, সে বিষয়ে পুলিশের সন্দেহ হলো। এরপর পুলিশ তদন্ত করে মামলার প্রকৃত আসামি, বাসাইল উপজেলার বাঘিল গ্রামের ফারুক হোসেনের ছেলে নয়নকে গ্রেফতার করে। আসামি নয়ন ৮ অক্টোবর টাঙ্গাইল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। প্রকৃত আসামি ধরা পড়ার ১৬ দিন পর নির্দোষ নয়ন কারাগার থেকে ছাড়া পেলেন। সখীপুর থানা থেকে এই নয়নের বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন পাঠানোর পরও ছেলের জামিনের জন্য শাহজাহান মিয়াকে আদালতে গিয়ে আইনজীবীদের পেছন পেছন ঘুরতে হয়েছে। আইনের মারপ্যাঁচে মুক্তি পেতে নির্দোষ নয়নকে প্রায় এক মাস অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়।

প্রেমিকের ফোন পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। মেয়েটিকে কক্সবাজারে নিয়ে একটি হোটেলে দুই রাত রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ এনে কিশোরীর মা ২৬ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের সখীপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। দুর্ভাগ্য, ওই কিশোরী এ বয়সেই প্রেমের চড়া মাশুল দিলো! মামলার পরদিন এজাহারে থাকা ঠিকানা মোতাবেক আসামি নয়নকে (মেয়ের শনাক্তকরণের ভিত্তিতে) গ্রেফতার করা হয়। আদালতের মাধ্যমে কারাগারে যাওয়ার আগে নয়ন পুলিশকে বলেছিলেন, তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। মেয়েটিকে চেনেন না তিনি। এমনকি কোনো দিন দেখেনওনি। তিনি সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য স্কিল সেন্টারে ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ওই সেন্টারে ক্লাস করেছেন। জীবনে কোনো দিন কক্সবাজারে যাননি। নয়নের মা-বাবাও পুলিশকে বলেছিলেন, তাদের ছেলে প্রতিদিন রাতে খাবার খেয়ে ঘরে ঘুমিয়ে পড়ত। ঘুম থেকে জেগে সকালের নাশতা খেয়ে আবার ট্রেনিং সেন্টারে ক্লাস করতে যেত। বিকেলে ফিরে আসত। কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। কারণ, সখীপুর থেকে কক্সবাজার যেতে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা লাগে। আসা-যাওয়ায় ২৪ ঘণ্টা লাগলে তাদের ছেলে কিভাবে কক্সবাজারে গেল, বিষয়টি তদন্ত করে দেখলেই প্রকৃত রহস্য জানা যাবে।

ছেলেটি ও তার বাবা-মায়ের কথা বিশ্বাস করে পুলিশ তদন্ত শুরু করে। মেয়েটির কাছে কক্সবাজারের হোটেলের একটি কার্ড ছিল। হোটেলটির ব্যবস্থাপকের সাথে যোগাযোগ করে দুই দিনের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। হোটেলের রেজিস্টারে থাকা নয়নের ফোন নম্বর সংগ্রহ করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ফোন নম্বরের সূত্র ধরে আসল আসামি নয়নকে মামলা দায়েরের ১১ দিন পর ৭ অক্টোবর বাসাইল উপজেলা সদর থেকে গ্রেফতার করা হয়। সিসিটিভির ফুটেজে থাকা ছবির সাথে এই নয়নের হুবহু মিল পাওয়া যায়। একপর্যায়ে মেয়েটি প্রকৃত আসামি নয়নকে শনাক্ত করে এবং ভুলের জন্য ক্ষমা চায়।

মেয়েটি কেন নির্দোষ নয়নকে আসামি হিসেবে শনাক্ত করল, এর জবাবে মামলার বাদির বক্তব্য সত্যিই কৌতূহলোদ্দীপক। চার দিন পর ফিরে এসে তাদের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে জানায়। সে সময় তাদের চাপে প্রেমিকের নাম ‘নয়ন’ বলে উল্লেখ করেছে। বাড়ি থেকে ২০০ গজ দূরের এক নয়নের নাম বললে মেয়েটি তাতে সম্মতি জানায়। পরে ওই নয়নের ঠিকানা সংগ্রহ করে তাকে একমাত্র আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করা হয়। এর এক দিন পর পুলিশ নয়নকে গ্রেফতার করলে তাদের মেয়ে থানায় গিয়ে তাকে ‘শনাক্ত’ করে। ওর মায়ের ভাষ্য, ৭ অক্টোবর দোষী নয়ন গ্রেফতার হলে তখন তাদের মেয়ে জানায়, প্রতারক নয়নের নাম ছাড়া আর কোনো তথ্যই তার জানা ছিল না। ফলে পরিবারের চাপ ও মারধরের ভয়ে সে সময় গ্রেফতার হওয়া নির্দোষ নয়নকে সে শনাক্ত করেছিল। তার মেয়ে এ ঘটনায় অনুতপ্ত। এখন আসল নয়ন গ্রেফতার হয়েছে। নির্দোষ নয়ন কারাগার থেকে ছাড়া পেলে তার কাছে মাফ চাইবে তাদের মেয়ে। বাদির এমন কথায় সাধারণের আক্কেলগুড়ুম। তার ‘মতিগতি’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। একেই বলে ‘গরু মেরে জুতা দান’। অথচ আসামি শনাক্ত করতে ভুল করায় নির্দোষ নয়ন বিনা অপরাধে প্রায় এক মাস কারাভোগ করলেন, তার কী হবে? এ নিয়ে বাদির কোনো অনুতাপ রয়েছে কি না, বোঝা মুশকিল। নির্দোষ নয়নের বাবা প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করায় পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে দেশজুড়ে তার ছেলে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন বলে বড়ই মর্মবেদনা তার। একই সাথে পরিবারের সম্মানহানির কী হবে, এই চিন্তায় দিশেহারা। তাই মামলার বাদির শাস্তি দাবি করেছেন তিনি। এতে কিছুটা হলেও তার মর্মবেদনা কমবে। এ ঘটনায় আরেকটি বিষয় ফের প্রমাণ হলো- আমাদের দেশের পুলিশ চাইলে অপরাধের রহস্য উদঘাটনে সক্ষম।


আরো সংবাদ



premium cement