২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সুবর্ণচরের ঘটনা সরকারের টেস্টকেস

সুবর্ণচরের ঘটনা - সংগৃহীত

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী এবং তাদের কোনো কোনো নষ্টভ্রষ্ট সহযোগী এ দেশের বহু নারীর ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছিল। এক সময় বলা হতো, মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ নারী নিপীড়নের শিকার হন। সম্প্রতি কেউ কেউ সেই সংখ্যাটি চার লাখ বলেও উল্লেখ করছেন। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে কোনো সংখ্যাই প্রমাণিত নয়। তাই ধর্ষণের ব্যাপকতা বা ধর্ষিতার সংখ্যা নিয়ে কারো মনে সংশয় বা মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। 

আসলে শুধু আজকের দিনে নয়, সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই আক্রান্ত হয়ে এসেছে নারী। কখনো ধর্ষকামী পুরুষের লালসার শিকার হয়ে, কখনো বা সবল প্রতিপক্ষের প্রতিশোধের। যুগে যুগে দেশে দেশে যুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে নারী ধর্ষণ। সম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান নারীরাও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। রোহিঙ্গাদেরকে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে দেশত্যাগে বাধ্য করতে সে দেশের সেনাবাহিনী গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি নারীদের নির্বিচারে ধর্ষণ করে। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনে একটি দলকে ভোট না দেয়ায় সেই দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা একজন নারীকে গণধর্ষণ করেছে, এমন ঘটনা নজিরবিহীন। স্বাধীন বাংলাদেশে এই নজির সৃষ্টি হলো নোয়াখালীর সুবর্ণচরে। সেখানে গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের দিন একটি কেন্দ্রে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ধর্ষিত হন চল্লিশোর্ধ্ব এক গৃহবধূ। দুর্বৃত্তরা রাতের বেলা ওই নারীর বাড়িতে গিয়ে তাকে ঘরের দরজা খুলতে বাধ্য করে। এরপর রাতে নিজের বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হন বাগ্যা গ্রামের এই নারী। স্বামী ও স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে বেঁধে রেখে তাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার সহচরেরা দলবেঁধে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ করেন ওই নারী।

একই ধরনের অভিযোগ উঠেছিল ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সিরাজগঞ্জের কিশোরী পূর্ণিমাকে নিয়ে। তোলপাড় হয়েছিল দেশজুড়ে। কিন্তু সেই ঘটনা কতটা সত্যি ছিল তা নিয়ে তখনই সংশয় প্রকাশ করেছিল তৎকালীন গণমাধ্যম। তাই সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত কিছু না বলাই ভালো।

এর আগেও এ ধরনের দু-একটি ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। রংপুরে পুলিশের ধর্ষণের শিকার ইয়াসমিনের বিষয়টি নিয়ে যে মহাতুলকালাম কাণ্ড ঘটেছিল, তা আজো অনেকের মনে স্থায়ী দাগ কেটে রেখেছে। সেই কাহিনী নিয়ে এমনকি গল্প-উপন্যাসও লেখা হয়েছিল। আসলে ধর্ষণের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর আমাদের সমাজে। ইউরোপ-আমেরিকায় এটি অপরাধ হলেও সম্ভবত খুব বড় অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না। যে জন্য পুলিশ নারীদের পরামর্শ দেয় ধর্ষণকারীর আক্রমণের শিকার হলে তারা যেন প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি না নেন। অর্থাৎ প্রয়োজনে ধর্ষিত হোন, আত্মসমর্পণ করুন; তবুও জীবনের ঝুঁকি নেবেন না। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে এত সহজভাবে গ্রহণ করার উপায় নেই। কারণ, ধর্ষিত নারীর প্রতি আমাদের সমাজ কিছুটা বিমুখ। তাকে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। তার স্বাভাবিক জীবন তছনছ হয়ে যায়। সুবর্ণচরের নিপীড়িত নারীর ঘটনাটিও একই প্রেক্ষাপটে রেখে আমাদের বিবেচনা করতে হবে।

সুবর্ণচরে ধর্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা। তিনি স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিন। তারই নির্দেশে তার ১৫-১৬ জন সহচর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ওই নারীর ওপর পৈশাচিক নিপীড়ন চালায়। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবরে এটা স্পষ্ট, ভোটের বুথে রুহুল আমিনের একজন সহচরের সাথে ওই নারীর বিতণ্ডা হয়। তাকে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার জন্য চাপ দেয়া হয়; কিন্তু সাহসী ওই নারী চাপের মুখে নতি স্বীকার না করে ধানের শীষে ভোট দেন। এ নিয়ে ওই সহচর এবং অন্যদের সাথে তর্কবিতর্কও হয় ওই নারীর। তারপর সেই রাতেই তিনি আক্রান্ত হন নিজ বাড়িতে। ঘটনাটি অবশ্যই রাজনৈতিক প্রতিহিংসাজনিত। এটিকে অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই।

ঘটনাটি স্বাভাবিকভাবেই দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছে, ধিক্কার জানিয়েছে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ ও বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেছে। শত শত শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন মানবাধিকার ও নারী সংগঠন সুবর্ণচরের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে, ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এবং মানববন্ধনও করেছে। সবাই ঘটনার দলীয় প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছে। 
উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। এক বিবৃতিতে তিনি ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।

ড. কামাল বলেন, ‘এ ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের অত্যন্ত হেয় প্রতিপন্ন করেছে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমন ঘটনা কল্পনাও করা কঠিন।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘সরকার এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে কার্যত সন্ত্রাসী ধর্ষকদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। পুলিশ বাদির কথিত মতে, হুকুমের আসামিসহ অনেকের নাম বাদ দেয়ায় আমি ক্ষোভ প্রকাশ এবং অবিলম্বে তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি করছি।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শনিবার নোয়াখালীর হাসপাতালে গিয়ে সুবর্ণচরের ধর্ষিতার সাথে কথা বলেন ও তার চিকিৎসার খবর নেন। তিনি ওই নারীর মাথায় হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে এই ঘটনার বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। দল ও জোটের শরিক নেতারা মির্জা ফখরুলের সাথে ছিলেন। ফখরুল ওই নারীর মাথায় হাত বুলিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘বোন আমরা তোমার পাশে আছি। তোমার কোনো ভয় নেই। এই নির্মমতার অবশ্যই একদিন বিচার হবে। আল্লাহ বিচার করবেন।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকীও ওই নারীকে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেন।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরজুবলীতে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে নারীকে গণধর্ষণের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ ধরনের ঘটনা সারা দেশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। সুবর্ণচরে ধর্ষণের ঘটনা পরিদর্শন শেষে গত রোববার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

যারা সুবর্ণচরে ধর্ষণকে প্রতিশোধের পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছে, তারা স্থানীয় পর্যায়ে বিরাট প্রভাব-প্রতিপত্তিসম্পন্ন তাতে সন্দেহ নেই। আর সে জন্যই অভিযোগকারী নারী ও তার স্বামী-পরিবার শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় জাগে। কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, যারা অত্যাচারিত হয়েছেন, তারা ‘পূর্ববিরোধের’ কারণে এই ঘটনা ঘটেছে এমন কথা বলেছেন; অন্য কোনো ঘটনার কথা বলেননি। সম্ভ্রম তো গেছেই, এখন হয়তো তাদের জীবনও বিপন্ন।
রুহুল আমিনকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগ। এটি প্রাথমিকভাবে ঠিকই আছে। তবে বহিষ্কার কোনো শাস্তি নয়। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করাও দল তথা সরকারের দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্য গঠিত সরকার দায়িত্ব নিয়েছে মাত্র দুই দিন হলো। তাদের ওপর দেশবাসীর প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন তারা চান, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠাও দেখতে চান। কিন্তু ঘটনার পর যেভাবে এটিকে পুরনো বিরোধের জের হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে, সেটি অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত। 

গত সোমবার পর্যন্ত মামলার এজাহারভুক্ত আটজন এবং ঘটনার মূল নির্দেশদাতা রুহুল আমিনসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাতজনকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। নোয়াখালী ডিবির ওসি আবুল খায়ের সাংবাদিকদের বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তারা একটা ইতিবাচক ফলাফল পাবেন বলে আশা করছেন। 

এ ধরনের হীন পাশবিক ঘটনায় কেবল ধিক্কার জানানো কিংবা তার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠাই যথেষ্ট নয়, বরং নির্মম ক্ষমাহীন দৃষ্টিতে এটিকে দেখতে হবে। আর সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ প্রভাবমুক্ত তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে, সরকারের কাছে এটাই চান দেশের মানুষ।
সুবর্ণচরের ন্যক্কারজনক ধর্ষণ ঘটনার বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন সরকারের দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সামান্য প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে আমাদের ধারণা। নির্বাচনে বিপুল বিস্ময়কর বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের মাটিলগ্ন পা যদি হাওয়ায় ভাসতে শুরু না করে তাহলে তারা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট থাকবেন, এমনটাই প্রত্যাশিত। সুবর্ণচর সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের আন্তরিকতা প্রমাণের একটি প্রারম্ভিক টেস্টকেস হতে যাচ্ছে বলে মনে করি। হ


আরো সংবাদ



premium cement