২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সাত নভেম্বর বিপ্লবের মূলে

-

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিপ্লবের মূল অনুসন্ধানে এখনো অনেকের অনীহা। কেন এই বিপ্লব ঘটল, কিভাবে ঘটল তা অনেকের কাছে সুস্পষ্ট নয়। এ দেশের ইতিহাসবিদেরাও এ দিকে খুব বেশি দৃষ্টি দিয়েছেন বলে মনে হয় না। খালেদ মোশাররফের ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের পরই যেহেতু এর বিস্ফোরণ ঘটে, তাই বেশির ভাগ লেখক তাদের ভাবনার জ্যোতিকেন্দ্র ওই অভ্যুত্থানেই নিবদ্ধ রেখেছেন। আসলে এর মূল অনুসন্ধান করতে হবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছাড়িয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গতিসূত্রে, এমনকি তারও পেছনে গিয়ে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে, শুধু পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সামগ্রিক প্রবাহে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক The Frontier (১৩ ডিসেম্বর ১৯৭৫)-এর সম্পাদকীয়তে লিখিত হয়েছিল : ‘নির্দেশদানকারী সামরিক কর্মকর্তাদের নির্দেশ অমান্য করে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা শুধু এজেন্ট খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করার জন্য এই বিপ্লব ঘটায়নি। তাদের বিপ্লব ছিল তাদেরই রচিত ১২ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। দুপুরে বাড়তি এক কাপ চা এবং বাড়তি কিছু খাবারের জন্য তাদের এসব দাবি রচিত হয়নি। তাদের দাবি ছিল অত্যন্ত বৈপ্লবিক, যা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নিয়মিত সামরিক বাহিনীতে অতীতে কখনো শোনা যায়নি। একটি নিয়মিত বা কনভেনশনাল সামরিক বাহিনী ১৯৭১ সালে গেরিলা বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েই এ নতুন ফসলের জন্ম দিয়েছে। চার বছর সময়ে অতি সঙ্গোপনে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে বিস্ফোরিত হয় (৭ নভেম্বরে)।’
যে ১২ দফা দাবির ভিত্তিতে এই বিপ্লব, সেদিকে দৃষ্টি দিন, দেখবেন কত বিপ্লবাত্মক ছিল সৈনিকদের দাবি। প্রথম দফার প্রথম দু’টি লাইনে লেখা হয়েছিল : আমাদের বিপ্লব শুধু নেতৃত্বের পরিবর্তনের জন্য নয়, এই বিপ্লব হলো দরিদ্র শ্রেণীর দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে...। দীর্ঘ দিন আমরা ধনিক শ্রেণীর সৈনিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছি। ধনিক শ্রেণী আমাদের ব্যবহার করেছে তাদেরই স্বার্থে। তৃতীয় দফায় বলা হয়েছিল, সব দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ও ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হোক অবিলম্বে এবং বিদেশী ব্যাংকে তাদের গচ্ছিত সম্পদ দেশে ফিরিয়ে এনে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে বিনিয়োগ করা হোক। চতুর্থ দফায় সুপারিশ করা হয়েছিল কর্মকর্তা এবং সাধারণ সৈনিকের মধ্যে সব পার্থক্য মুছে ফেলে প্রত্যেকের কাজ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বেতন নির্ধারণ করা হোক। ৯ ও ১০ দফায় দেশময় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠনের কথা বলা হয়। এসব সংস্থাই সামরিক বাহিনীর মূলনীতিসহ দেশের প্রতিরক্ষা নীতি নির্ধারণ করবে। সুতরাং অনুধাবনে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না যে, এই ১২ দফা দাবির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল সত্যি সত্যিই বৈপ্লবিক। পুরনো সমাজকে ভেঙেচুরে, এত দিন ধরে যারা সামাজিক সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করে এসেছেন, তাদের গুঁড়িয়ে দিয়ে, বঞ্চিত ও শোষিতদের হাতে শাসনযন্ত্রের দায়িত্ব তুলে দিয়ে, নতুনভাবে, সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে সমাজ গঠনের অঙ্গীকার ছিল ৭ নভেম্বর বিপ্লবের লক্ষ্য। এ অঙ্গীকার এক দিনে জন্মলাভ করেনি। জন্মলাভ করেনি এক বছরেও। দীর্ঘ দিন সমাজতান্ত্রিক আঙ্গিকে সমাজ গঠনের আন্দোলন অব্যাহত ছিল দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। অব্যাহত ছিল দক্ষিণ ভারতেও। বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরা-আসাম এলাকায়, দক্ষিণের কেরালা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। পূর্ব পাকিস্তানেও তার প্রবল ঢেউ আছাড় খায় ষাটের দশক থেকে। হাজারো বিভক্তি সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে ওঠে বেশ কিছু বামপন্থী রাজনৈতিক দল। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলে কঠোর পেশিশক্তির প্রভাবে, বিশেষ করে বামপন্থী দলগুলো নিষিদ্ধ থাকার কারণে। প্রকাশ্যে এসব দলের কার্যক্রম পরিচালিত না হলেও সমাজের একাংশে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার জনপ্রিয়তা ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। ভারতের বিভিন্ন অংশে বামপন্থার আবেদন হয়ে ওঠে আকাশচুম্বী। যুক্ত হয় চারু মজুমদারের নকশালপন্থী হঠকারিতা। সব মিলিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে।
অনেক বিশ্লেষকের অভিমত, বাংলাদেশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ অংশ নেয়ার লক্ষ্য ছিল দু’টিÑ এক. ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানের পূর্ব দিকের ডানা ছেঁটে ফেলা। দুই. এই সুযোগে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনপন্থী বামপন্থীদের উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া প্রভাবকে ঠাণ্ডা করে দেয়া, বিশেষ করে নকশালপন্থীদের নির্মূল করা। ভারতের নিরাপত্তাবিশারদ সুব্রাহমানিয়ামের ওই সময়ের বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করুন, দেখবেন ভারতের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা তখন কী ভাবতেন এবং কিভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের Indian Instiute of Defense Studies and Analysis-এর পরিচালক কে সুব্রাহমানিয়াম ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ দিল্লির (Indian Council of World Affairs-এর এক সভায় বলেন, ‘পাকিস্তানের ভেঙে যাওয়া ভারতীয় স্বার্থের অনুকূল। তাই পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট আমাদের জন্য যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে তা হাতছাড়া করা আমাদের উচিত নয়। এমন সুযোগ আর কোনো দিন আসবে না।’
পাকিস্তানের খণ্ডছিন্ন করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি ভারত ঠিকই, কিন্তু তার আগে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্বের প্রকৃতি সম্পর্কে। ভারত যখন নিশ্চিত হয় যে, আওয়ামী লীগ বামপন্থী কোনো দল নয় এবং এই দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বামপন্থীদের বন্ধুও নন, তখনই এগিয়ে আসে ভারতে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনে, ২৫ মার্চের প্রায় তিন সপ্তাহ পরে, ১৭ এপ্রিলে। সুব্রাহমানিয়াম তার Bangladesh and Indias National Security শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখেছিলেন : ‘বিপ্লববাদী বামপন্থী কোনো নেতৃত্ব যেন স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন না হতে পারে, ভারত আগেভাগেই নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাও নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ ভারত এখানেই থামেনি। মুক্তিযুদ্ধে সব দল ও মতের তরুণ-তরুণীরা অংশ নিলেও বামবিরোধী আওয়ামী লীগের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে মুক্তিবাহিনীর বিপরীতে ভারতপন্থী মুজিববাহিনীও গঠন করে, যদিও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। মুজিববাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ ছিল উন্নততর। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল উন্নতমানের। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার { Research and Analysis Wing (RAW)} তত্ত্বাবধানে এই বাহিনী প্রবাসী সরকারকে এড়িয়েও কাজ করত। এই তো হলো বামপন্থা সম্পর্কে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম। এ সময়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় লক্ষাধিক নকশালপন্থীর জীবনাবসান ঘটে। কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হয়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বামপন্থীদের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়।
সপ্তম দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের প্রারম্ভ ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। দেশের শিল্প-বাণিজ্যের ৮৬ শতাংশ জাতীয়করণ করা হয়। ব্যাংক-বীমা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। দেশের সংবিধান সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করা হয় চারটি মৌল নীতির একটি রূপে। এ সময়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই শুধু সমাজতন্ত্রের প্রভাব প্রাধান্য লাভ করেনি, দেশের সামরিক বাহিনীতেও এর গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এ জন্য দায়ী ছিল প্রধানত মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাপদ্ধতির প্রভাব এবং কয়েকজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধার বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারকালে প্রদত্ত এক ভাষণে কর্নেল তাহের বলেছিলেন, ‘সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি লক্ষ্য করেছি, উন্নয়নশীল ও অনগ্রসর দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাহিনী এক বোঝাস্বরূপ। এ ধরনের প্রতিরক্ষা বাহিনী সামাজিক অগ্রগতির পথেও বিরাট প্রতিবন্ধকতা। জাতীয় উৎপাদনে তা কোনো অবদান রাখে না।’ তাই সামরিক বাহিনীকে তিনি উৎপাদনমুখী এক বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে কৃতসঙ্কল্প ছিলেন।
আরেকজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল জিয়াউদ্দীনও বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর দেশে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো হতে পারে দুই রকম। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী প্রতিরক্ষা বাহিনী যদি শুধু দেশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকে, তাহলে তা টিকে থাকবে রাষ্ট্রের ওপর দায়ভাররূপে। এর ব্যয় বহন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত নিঃশেষ হয়ে পড়বে। কোনো এক সময় এই বাহিনী বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এমনকি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নির্যাতনমূলক সংস্থায় রূপ লাভ করবে। তাই প্রতিরক্ষা বাহিনীকে উৎপাদনশীল কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে জনগণের কাছাকাছি অবস্থান করতে হবে।
এই মানসিকতা নিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অধিক দিন টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২ সালে দু’জনই প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। কর্নেল তাহের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) গোপন বাহিনী, গণবাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং কর্নেল জিয়াউদ্দীন বাংলাদেশ সর্বহারা পার্টিতে যোগদান করে তার সামরিক শাখা সংগঠন করেন।
কর্নেল তাহের ও কর্নেল জিয়াউদ্দীন কিভাবে, কোন লক্ষ্যে কখন বিপ্লববাদী রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট হন, তার বিবরণ অন্যত্র রয়েছে [Military Rule and Myth of Democeracy, UPL, 1988]। তাদের সম্পর্কে বিশেষ করে কর্নেল তাহের সম্পর্কে এটুকু বলা যায়, তিনি সামাজিক শক্তিগুলোকে এবং সব প্রতিষ্ঠানকে গণমুখী করতে চেয়েছিলেন ও বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন এক শাণিত অস্ত্ররূপে। এ জন্য তিনি খুবসম্ভব মার্ক্সীয় নীতি ‘পুরনো বাহিনীকে ভেঙে চুরমার করে দাও। তাকে গুঁড়িয়ে দাও এবং নতুনভাবে লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিনির্মাণ করো’ নীতি [Smash the old army, dissolve it and then build it a new] অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্যেই বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে নতুনভাবে সংগঠন করতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন শাখায় ও স্তরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা [Revolutionary Soldiers Sangstha] গঠনের উদ্যোগ নেন ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে। তখনকার পরিস্থিতিও ছিল তার জন্য সুবিধাজনক। এক. তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আকার ছিল খুব ছোট। দুই. সামরিক বাহিনীর মধ্যে তেমন ঐক্য ছিল না। ছিল না নির্দেশদানের ঐক্যবদ্ধ সূত্র, কেননা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগতদের মধ্যে ছিল এক ধরনের দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা। তিন. সামরিক বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করার সরকারি প্রয়াস ছিল না বললেও চলে। এক দিকে রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টি এবং এই বাহিনীর প্রতি সরকারের দুর্বলতা, অন্য দিকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর পুনর্গঠন ও উন্নয়নে সরকারের অনীহা দেশের সামরিক বাহিনীর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক করে তোলে। চার. একজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধারূপে কর্নেল তাহেরের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল আকাশছোঁয়া। পাঁচ. জাসদের তরুণ নেতৃত্ব, বিশেষ করে জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প ও তরুণ নেতৃত্ব কর্তৃক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জের মানসিকতা কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা সামরিক বাহিনীর মধ্যে সৃষ্টি করে নতুন উন্মাদনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ড কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনাকে কিছুটা ব্যাহত করে। জাসদের নেতারা এবং তাহের আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তনে খুশি হন বটে, কিন্তু সেই নির্মম হত্যাকাণ্ড কর্নেল তাহের ভালো চোখে দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনো হত্যাকাণ্ড বা সামরিক অভ্যুত্থান জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক হবে না। তাহের শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু তার সরকারের তীব্র সমালোচনা করতেন। ‘সমগ্র জনতার মধ্যে আমি প্রকাশিত’ শীর্ষক তার আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বিবৃতির ২৯ পৃষ্ঠায় তিনি শেখ মুজিবের বাকশাল ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখেছিলেন : ‘গণতন্ত্রকে নোংরাভাবে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। জনগণ হয়েছে পদদলিত এবং ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত করুণ এবং দুঃখজনক যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা একনায়করূপে দেখা দিয়েছেন।’ কর্নেল তাহের শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা করতেন বলে সেই হত্যাকাণ্ডকে না-পছন্দ করেছেন। যারা এ কাজে অংশগ্রহণ করেন, তাদের কোনো মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না বলে তিনি সেই হত্যাকাণ্ডকে ঘৃণা করেছেন। তার কথায়, ‘সবচেয়ে উত্তম পন্থা হতো জনগণকে প্রতারিত করার জন্য বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে উৎখাত করা।’ তার মতে, ১৫ আগস্টের পর যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই সরকারের কোনো উন্নততর চিন্তাভাবনা বা আদর্শ ছিল না। সরকার পরিবর্তনে যা হয়েছিল, তা শুধু রুশ-ভারত সম্প্রসারণবাদের হাত থেকে বাংলাদেশকে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের ফলে ‘দেশটিকে বেসামরিক একনায়কত্ব থেকে তুলে এনে সামরিক আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্বে নিমজ্জিত করা হয়।’
১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর খবর শোনে কর্নেল তাহের নিজেই ঢাকা রেডিও স্টেশনে যান এবং নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের সাথে কথা বলে কয়েকটি সুপারিশ পেশ করেন। যেসব সুপারিশ তিনি পেশ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ১. চতুর্থ সংশোধনী আইন তাৎক্ষণিক বাতিলকরণ। ২. সব রাজবন্দীকে মুক্তিদান। ৩. বাকশাল ব্যতীত অন্য সব দলের নেতাদের সমন্বয়ে একটি গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন। ৪. নতুন জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কর্নেল তাহেরের এসব সুপারিশ তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার সাথে ছিল সঙ্গতিপূর্ণ। রাজবন্দীদের মুক্তি দিলে তখন বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে পারতেন জাসদের কয়েক হাজার নেতাকর্মী। জাতীয় সরকার গঠিত হলে রাজনৈতিক দল হিসেবে তখন জাসদের প্রভাব হয়ে উঠত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জাসদ তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হতেও পারত। সর্বোপরি সময় পেলে এবং প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হলে যে আদর্শে কর্নেল তাহের ও তখনকার জাসদ অনুপ্রাণিত ছিল, তা বাস্তবায়নের পথ সুগম হতো। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফদের সামরিক অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের ও জাসদের সেই পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করা হয়। তাই ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করার সব পদক্ষেপ নেন কর্নেল তাহের এবং জাসদের নেতারা। খালেদ মোশাররফদের সামরিক অভ্যুত্থান ছিল জাসদ ও গণবাহিনীর কর্মপরিকল্পনা বানচাল করার লক্ষ্যে।
কর্নেল তাহের এবং জাসদের নেতৃবৃন্দ তখনকার সামাজিক চেতনায় যে দু’টি ধারা প্রবাহিত হচ্ছিল, সে সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন না। সমাজতান্ত্রিক চেতনায় তারা এত বেশি উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন যে, তারই পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা যেভাবে সমান্তরাল গতিতে প্রবাহিত হয়ে সাধারণ জনগণ, এমনকি যে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা রচিত হচ্ছিল, সেই বাহিনীর সাধারণ সিপাহিদের মন-মানসিকতাকেও প্রভাবিত করেছিল গভীরভাবে, সে সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। ভারত বা পাকিস্তানের জন্মকাহিনী যেভাবে রচিত হয়েছিল, সুতীক্ষè, বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনার তীর ঘেঁষে বাংলাদেশের জন্ম কিন্তু তেমনভাবে হয়নি। বাংলাদেশ প্রাণ পেয়েছে রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে। তাই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ‘আমার দেশ’, ‘আমাদের জাতি’, ‘আমাদের বাংলাদেশ’ প্রভৃতি শব্দ উচ্চারিত হয়েছে নতুন ব্যঞ্জনায়, নতুন বোধিতে, নতুন দ্যোতনায়। যেহেতু এক গণযুদ্ধের ফসল হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যেহেতু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের আগেই এই ভূখণ্ডে জাতীয়তার সূত্র সুদৃঢ় হয়েছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতিরাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, তাই আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের চেতনা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, জাতীয়তাবাদী গণচেতনাও বিকশিত হয়েছে তেমনি প্রবল পরাক্রমে। সামরিক বাহিনীর মধ্যে ভারতবিরোধী চিন্তাভাবনা এই চেতনাকে আরো শক্তিশালী করে। রক্ষীবাহিনী সংগঠন, এই বাহিনী গঠনে ভারতের প্রত্যক্ষ মদদ, এই বাহিনীর প্রতি সরকারের দুর্বলতা, প্রতিরক্ষাবাহিনীর উন্নয়ন ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের অনীহা, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিজয়োল্লাস, পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া সব অস্ত্রশস্ত্র ভারতে পাচারÑ এসবই বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে ভারতবিরোধী মানসিকতাকে ভীষণভাবে সঞ্জীবিত করে। সিপাহি-জনতার মধ্যে এই ভারতবিরোধী চেতনা চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জয়যুক্ত করে। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারী খালেদ মোশাররফ এই চেতনার মোকাবেলায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হন। প্রথম আঘাতে সেই অভ্যুত্থান ঘায়েল হয়ে পড়ে।
এ ক্ষেত্রে এটিও উল্লেখযোগ্য, গণবাহিনীপ্রধান কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ৩ নভেম্বর তিনি যেভাবে গৃহবন্দী হয়েছিলেন, তাকে সেই গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত করতে অগ্রসর হননি। তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন খালেদ মোশাররফের ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ উদ্যোগকে নস্যাৎ করতে। এ জন্য যেসব সেøাগান তখন বেশি কার্যকর হওয়ার কথা, যেমনÑ ‘ভারতের দালাল’, ‘রুশ-ভারতের দালাল’, ‘জয় বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ সেসব সেøাগানই ব্যবহার করা হয়েছিল। তা ছাড়া তখন গণবাহিনীর জন্য জিয়াউর রহমানের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। একাত্তরের অনিশ্চিত দিনগুলোয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন বিভ্রান্ত ও সম্বিৎহীন, ওই সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী জিয়া, একজন সার্থক মুক্তিযোদ্ধা জিয়া, একজন সেক্টর কমান্ডার জিয়ার প্রয়োজন ছিল তখন গণবাহিনীর কাছে সবচেয়ে বেশি। পরের ইতিহাস সবার জানা। আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের বাণী জাতীয়তাবাদী চেতনার কাছে মøান হয়ে আসে। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবে এভাবে জাতীয়তাবাদী জিয়াউর রহমান উঠে আসেন রাষ্ট্রক্ষমতার আলোকোজ্জ্বল আবর্তে এবং তিনি জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে তা গ্রহণ করেন এক জাতিরাষ্ট্রের মহানায়ক হিসেবে। হ
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement