০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১,
`

সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব

-

এ বিশাল পৃথিবী যখন ঘন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল, জাহেলিয়াতের ভয়াল অন্ধকার যখন ক্রমেই গ্রাস করে নিচ্ছিল সমগ্র পৃথিবীকে। যখন গোত্রে গোত্রে ছিল দলাদলি, হানাহানি ও রক্তারক্তির প্রবল স্রোতধারা, মানুষে মানুষে ছিল রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও আভিজাত্যের দুর্লঙ্ঘনীয় প্রাচীর। ঠিক তেমনি বিভীষিকাময় মুহূর্তে মহান রাব্বুল আল আমিন সিরাজুম মুনিরার চির উজ্জ্বল রোশনি দিয়ে রাহমাতুল্লিল আল আমিন হিসেবে ধরণীর বুকে প্রেরণ করেন সাইয়্যেদুল মুরসালিন তাজেদারে দুনিয়া আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা:কে। সিরাজুম মুনিরার সেই উজ্জ্বল রোশনির আলোকে তিনি পথহারা মানবজাতিকে পৌঁছে দেন হেদায়েতের চির উজ্জ্বল সরণিতে।

রাব্বুল ইজ্জতের পক্ষ থেকে তিনি মানবতার সামগ্রিক জীবনের জন্য এমন আদর্শবাণী ও শিক্ষা নিয়ে আসেন, যা ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মানুষদের পরিণত করে ইতিহাসের সর্বোত্তম স্বর্ণমানবে, যা মানবতাকে সন্ধান দিলো ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের সামগ্রিক সফলতার এক সোনালি স্মরণীয় মানুষের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজজীবন ও রাজনৈতিক জীবন ধীরে ধীরে হয়ে উঠল সুস্থ, সুন্দর, প্রশান্ত ও কল্যাণময়। মানুষে মানুষে গড়ে উঠল সাম্য, মৈত্রী, মানবতা, একাত্মতা ও ভ্রাতৃত্বের মহান বন্ধন। মানবসমাজে সঞ্চালিত হলো শান্তি, সততা ও মমতার শীতল বায়ু। যাঁর বিরুদ্ধে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ, তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য, ভদ্রতা, শালীনতা, মানবসেবা ও পরোপকারিতা সব মানুষের কাছে ছিল পরিচিত। তাঁর লজ্জাশীলতা কুমারী তরুণীকেও হার মানাত, তাঁর আমানতদারি ও বিশ্বস্ততা চরম শত্রুর মনেও বন্ধুত্বের আবেগ সৃষ্টি করত।

তাঁর স্পষ্টবাদী বিজ্ঞ ফয়সালা নিষ্ঠুর জালিমের মনেও সৃষ্টি করত অব্যাহত কম্পন, তাঁর নির্ভরযোগ্য অভিভাবকত্ব ছিল এতিম-বিধবাদের ভরসাপূর্ণ আশ্রয়। আত্মীয়দের সুখ-দুঃখের চিরসাথী ছিলেন তিনি। কেউ কোনো দিন মুখ খুলে বলতে পারেনি যে, তিনি কখনো কোনো অসঙ্গত কথা বলেছেন; কারো সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন এবং জীবনে কোনো মুহূর্তে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। মূলত রাসূল সা: ছিলেন সার্বজনীন সর্বগুণের আধার। যাঁর সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক কুরআন মজিদে ইরশাদ করেছেন- ‘হে হাবিব! নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ কী অতুলনীয় মর্যাদা তাঁর! অতি স্বল্প সময়েই সত্যবাদিতার জন্য তিনি সাদেক, ন্যায়নিষ্ঠা ও নির্মল চরিত্রগুণে ‘আল আমিন’ উপাধিতে ভূষিত হন। নবীজী যে চরিত্রের উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এ চরিত্রে কালিমা লেপন করা সম্ভব নয়। মানুষ এ চরিত্র থেকে আদর্শ গ্রহণ করবে। তাই তাঁর পৃথিবীতে আগমন থেকে ওফাত পর্যন্ত পুরো জীবন নিষ্কলুষ পবিত্রতার বাস্তব উদাহরণ।

মূলত তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, জাতিকে তিনি মানবতার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা ছিল। যার কোনো বিকল্প নেই। দুনিয়ার আরো বহু মনীষী, ধর্মগুরু, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক ও জাতীয় নেতার আবির্ভাব হয়েছে; কিন্তু তাদের কীর্তি-অবদানের আলোচনা হুজুরে পাক সা:-এর মোবারক জিন্দেগির আলোচনা অনুপাতে হাজার ভাগের এক ভাগও ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। হুজুর সা:-এর ব্যক্তিগত, পার্থিব, সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের বহু আলোচনা হয়েছে।

তাঁর গুণাবলি যাচাই করা হয়েছে অমুসলিম ও বিরোধীদের সমালোচনার কষ্টিপাথরে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লেখা হয়েছে তাঁর জীবনী। ইসলামবিদ্বেষী অন্য ধর্মাবলম্বী কঠোর সমালোচকরাও হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মহত্ত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে মুসলমান, অমুসলিম সব বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক এ কথা অকপটে স্বীকার করেছেন, নবী মুহাম্মদ সা:ই সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং তিনিই ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ সাফল্যে সফল। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক লেখক মাইকেল এইচ হার্ট তার সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ দি হান্ড্রেডে যে পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন মনীষীর জীবনী আলোচনা করেছেন।

সেখানে ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সা:কে সবার শীর্ষে স্থান দিয়েছেন। সুতরাং এতদসত্ত্বেও যারা মহানবী সা: সম্পর্কে ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না যেমন অধিকৃত ফিলিস্তিনের জবরদখলকারী নরকের কীট অভিশপ্ত ইহুদি সম্প্রদায় সম্প্রতি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম মহামানব হজরত মুহাম্মদ সা: ও আল্লাহর মহাবাণী পবিত্র কুরআনের মারাত্মক অবমাননা করে বড় জঘন্য, কুৎসিত ও কুরুচিপূর্ণ পোস্টার প্রকাশ করে আল খলিল শহরে যত্রতত্র সেঁটেছে। মূলত এরা ধর্ম, কৃষ্টি, সদাচার তথা সৎ গুণাবলি ও মানবতার চরম শত্রু বৈ কিছুই নয়। তারা তাদের এরূপ হীন আচরণ দিয়ে মূলত প্রকৃতির সাথেই লড়াই করে চলছে।

অমুসলিমদের মুখে মহামানব হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে কয়েকজন অমুসলিম মনীষীর প্রশংসাবাণী প্রদত্ত হলো-
এ জি লিওনার্দ : তিনি বলেন, পৃথিবীতে বাস করে যদি কোনো মানুষ আল্লাহকে দেখে থাকেন, যদি কোনো মানুষ ভালো ও মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করে থাকেন, তা হলে এ কথা নিশ্চিত সত্য যে, আরবের নবী মুহাম্মদ সা: সেই ব্যক্তি। মুহাম্মদ সা: যে কেবল সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন তা নয়; বরং এ যাবৎ মানব ইতিহাসের যত মানুষের জন্ম হয়েছে, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানব একমাত্র তিনি (অনুপম আদর্শ : ৪৫১)।

ড. গিবন : বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক ড. গিবন ‘রোমান সাম্রাজ্যের পতন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বস্তুতপক্ষে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আনীত শরিয়ত সর্বলোকের জন্য প্রযোজ্য। এ শরিয়ত এমন বুদ্ধিবৃত্তিক মূলনীতি ও এ ধরনের আইনগত ভিত্তিতে রচিত যে, সমগ্র বিশ্বে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না (মা’আরিফুল কুরআন, খণ্ড-১ পৃ. ১৬৩)।

অ্যাডওয়ার্ড মুদন্ট : তিনি জেনেভা ইউনিভার্সিটির স্বনামধন্য অধ্যাপক। পয়গম্বরে ইসলামের প্রতি তার শ্রদ্ধাঞ্জলি নি¤œরূপ, ‘চরিত্র গঠন ও সমাজসংস্কার ক্ষেত্রে তিনি (হজরত মুহাম্মদ সা: যে সাফল্য লাভ করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে মানবতার মহাদরদি বলে বিশ্বাস করতে হয়’ (আয়নায় হাকিকত নুসা)।

ড. গেসটাউলি : তিনি ‘আরব সভ্যতা’ গ্রন্থে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘ইসলামের সেই উম্মি নবীর ইতিবৃত্ত বড় আশ্চর্যজনক। তৎকালে কোনো বৃহৎ শক্তি যে জাতিকে নিজের আওতায় আনতে পারেনি, সেই উচ্ছৃঙ্খল জাতিকে তিনি এক আওয়াজে বশীভূত করেন। অতঃপর সেই জাতিকে এমন স্তরে নিয়ে যান, যার মাধ্যমে পরাশক্তিগুলো তছনছ হয়ে যায়। বর্তমানকালেও সেই উম্মি নবী কবরে অবস্থান করে লাখ লাখ আল্লাহর বান্দাকে ইসলামের কালেমার ওপর অটল রেখেছেন’ (মা’আরিফুল কুরআন, প্রথম খণ্ড পৃ. ১৬২)।

টমাস কার্লাইল : তিনি বলেছেন, ‘তাঁর (মুহাম্মদ সা:) চিন্তাধারা ছিল অতি পবিত্র এবং চরিত্র ছিল অসম্ভব উন্নত। তিনি ছিলেন কর্মতৎপর সংস্কার, যাঁকে আল্লাহ মানুষকে হেদায়াতের জন্য নিযুক্ত করেছেন। তাঁর বাণী তো আল্লাহরই বাণী। মুহাম্মদ সা: অক্লান্ত প্রচেষ্টার সাথে সত্যের প্রচার করেন। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে তাঁর অনুসারী আছে। আর এতে সন্দেহ নেই, তাঁর সততাই জয়যুক্ত হয় (আল-মিনহাজুলওয়াজেহ)।

জর্জ বার্নার্ড শ : তিনি অতি তেজস্বী ভাষায় মহানবী সা:-এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন- আমাদের মধ্যযুগীয় পাদ্রিরা হয় অজ্ঞতার কারণে, দুঃখজনক বিদ্বেষের ফলে পয়গম্বরের মহান ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর প্রচারিত ইসলাম ধর্মকে কালো অবয়বে উপস্থাপন করেছেন। আমি পূর্ণ দিবাদৃষ্টিতে এ কথা ঘোষণা করতে চাই যে, হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও মুক্তিদাতা। বরং আরো স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বিশ্বের শাসন ও একনায়কত্ব যদি আজ মুহাম্মদ সা:-এর মতো কামেল পুরুষের হাতে সোপর্দ করা হয়, তবে এই পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার এভাবে সমাধান হয়ে যেত যে, গোটা বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার দোলনায় পরিণত হতো’ (দারুল উলুম দেওবন্দ, সেপ্টেম্বর সংখ্যা-৯৭৭)।

জি এম রডওয়েল : ‘বিশ্বস্ত সূত্রে প্রমাণিত যে, মুহাম্মদ সা:-এর যাবতীয় কাজ এই মহৎ প্রেরণায় অনুপ্রাণিত যে, মানবজাতি যেন অজ্ঞতা ও মূর্খতা এবং মূর্তিপূজা থেকে মুক্তি পায়। তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা ছিল নিগূঢ় সত্য তথা আল্লাহর একত্বের বহুল প্রচার’ (আয়নায়ে হাকিকতে মূসা)।


ইন্দিরা গান্ধী : তিনি বলেন, ইসলাম নিজের সোনালি যুগে একগুঁয়েমি ও বৈষম্যবাদ থেকে পবিত্র ছিল। ইসলাম সমগ্র বিশ্বের প্রশংসা লাভ করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো যখন প্রাচ্যে এক নক্ষত্রের উদয় হয়। এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যার আলোকে অন্ধকার পৃথিবী আলোকিত হয়ে ওঠে। ইসলাম মিথ্যা নয়। হিন্দু ভাইদের তা অধ্যয়ন করা দরকার। তা হলে তারা আমার মতো ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবেন। আমি দৃঢ়বিশ্বাসের সাথে বলছি, ইসলাম তরবারি দিয়ে প্রসার লাভ করেনি; বরং এর মূলে আছে রাসূলে আরবির দূঢ় প্রত্যয়, প্রমাণ, নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দান এবং অপরাপর মহৎ গুণাবলি। তাঁর এসব গুণ মানবাত্মাকে বশীভূত করেছে। আমি নিজে দেখেছি, যারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেও সে ধর্মের অধিকারগুলো লাভ করতে পারেনি, মাত্র মুসলমানদের সাথে একসূত্রে গেঁথে যায়।

তিনি ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে এক বাণীতে বলেন- ‘ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জন্ম ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইসলামের প্রচারে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এক নবতর ধারণার উন্মেষ ঘটেছে। ’

লেখক : মুহাদ্দিস, দারুল উলুম মইনুল ইসলাম, হাটহাজারী


আরো সংবাদ



premium cement