০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১,
`

‘সাড়ে চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী জামাইবরণ মেলা

মেলা শুরুর আগে গ্রামে গ্রামে শুরু হয় লাঠি খেলা - নয়া দিগন্ত

বগুড়ার শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী মেলা ২৬ মে রোববার থেকে শুরু হয়েছে। তিথি অনুযায়ি প্রতি বছর জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে উপজেলা সদরের অদূরে কেল্লাপোশী নামকস্থানে ৪৬০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এ মেলার আয়োজন করা হয়। স্থানীয়দের ভাষায়, যাকে ‘জামাইবরণ’মেলাও বলা হয়ে থাকে।

মেলাকে ঘিরে গ্রামে গ্রামে চলে রকমারি আয়োজন। মেলার অন্তত সপ্তাহখানেক আগ থেকেই গ্রামের লোকজন নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। নতুন পুরনো বলে কথা নেই। মেলা উপলক্ষ্যে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে আনেন। বিশেষ করে নতুন জামাই-বউকে নিয়ে সবাই ভিন্ন আনন্দে মেতে ওঠেন। শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে জামাই বাবুকে মোটা অঙ্কের সেলামীও দেয়া হয়। সেই সেলামী আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাই বাবুরা মেলা থেকে খাঁসি কিনে শ্বশুর বাড়িতে আনেন। এমনকি বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি করে মিষ্টান্ন সামগ্রী, সবচেয়ে বড় মাছ, মহিষের মাংস, রকমারি খেলনা কেনেন।

এছাড়া শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে মেলা ঘুরে ফিরে দেখেন। তাদের সার্কাস, নাগোরদেলা, হুন্ডা, যাদু, পতুল নাচ খেলা দেখিয়ে দিনব্যাপি আনন্দ শেষে ছাতা, ছোটদের কাঠের ও ঝিনুকের তৈরী খেলনা সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন। আর গ্রাম্য মানুষরা সেই মেলা থেকে রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের সামগ্রী, বড় বড় ঝুড়ি, চুন সারা বছরের জন্য কিনে রাখেন।

এদিকে প্রতিটি মেলার পিছনেই কিছু না কিছু লোকগাঁথা কথা থাকে। কেল্লাপোশী মেলা সম্পর্কে তেমনি একটি লোক গাঁথার কথা জানা যায়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এ মেলা হয়ে আসছে বলে কথিত আছে। এ সম্পর্কে জানা যায়, বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ওরশজাত এবং একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ওরশজাত পুত্রের নাম ছিল গাজী মিয়া আর দত্তক পুত্রের নাম কালু মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির সন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মন নগরে আসেন।

সেখানে ব্রাহ্মন রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন। একপর্যায়ে তারা দু’জন দু’জনকে ভালবেসে ফেলেন। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার নিকট যান। মুকুট রাজা ফকির বেশী যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করেন। এতে গাজী মিয়া দারুন আঘাত পান। তিনি মুকুট রাজার নিকট থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোশী নামক একটি দূর্গ নির্মাণ করেন।

পরে রাজার সাথে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার এবং তার কন্যাকে বিয়ে করেন। আর তিথি অনুযায়ি ওই দিনটি ছিল জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দূর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপি আনন্দ উৎসব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসায়। ওই দিনগুলোকে অম্লান করে রাখতে প্রতি বছর জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে তিন দিনব্যাপি মেলা বসে। আর এই মেলা উপলক্ষে এলাকাবাসি নতুন জামাইকে ঘরে এনে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। এছাড়া নিকট আত্মীয়স্বজনের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গন।

অপরদিকে মেলা শুরুর প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার খেলা। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রংয়ে সাজিয়ে সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫-২০জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাক-ঢোল, গান-বাজনার নানান সরঞ্জামাদি আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরে খেলা দেখায়। মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে ওই মাদার খেলা।

জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গনে গিয়ে তা শেষ করে। মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনা কাটার ধুম। দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফলমূল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুঠির শিল্প সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস, রকমারি মসলা।

এ মেলায় প্রায় কোটি টাকার দ্রব্যাদি কেনাবেচা হয়। আর মেলাকে কেন্দ্র করে ইজারার নামে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। প্রতিবছর এই চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে থাকে। এদিকে প্রশাসন মেলার শৃংখলা রক্ষায় বিশেষ পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করে থাকে। কিন্তু লাখো মানুষের ভীড়ে তাদের কার্যক্রম দায়সাড়া হয়ে পড়ে। ফলে চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি রোধ করা যায় না। যে মেলা সাড়ে ৪৬০বছরের বাঙালি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, সেখানে মানুষ প্রশাসনের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শেরপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) বুলবুল ইসলাম বলেন, গ্রামীণ এই মেলার অনুমতি দেয়া হলেও মেলায় কোন সার্কাস, যাত্রা,জুয়া বা বিচিত্রা চলবে না। যেহেতু মেলাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঘটে। তাই সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement