গৃহবিবাদে লণ্ডভণ্ড জাতীয় পার্টি, কী করতে যাচ্ছেন এরশাদ?
- আশরাফ আলী
- ২৪ মার্চ ২০১৯, ০৮:২৪, আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৯, ০৯:২৬
আবারো শুরু হয়েছে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে চরম অস্থিরতা। দলটির সেই পুরনো গৃহবিবাদ এখন তুঙ্গে। দলের নেতৃত্ব নিয়ে বিবদমান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে তৃণমূলপর্যায়ে। পার্টির কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে নিজের সহোদর জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দেয়ার পর মাত্র ১৮ ঘণ্টার মাথায় সংসদের বিরোধী দলের উপনেতার পদ থেকেও তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। একই সাথে তিনি তার স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে মনোনীত করেন। এর মধ্য দিয়ে জাপায় সেই পুরনো গৃহবিবাদ ফের চরম আকার ধারণ করেছে। গতকাল শনিবার বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সাংগঠনিক নির্দেশনায় এরশাদ কাদেরের অব্যাহতি ও রওশনের এ পুনঃনিয়োগের কথা জানান। এর আগে শুক্রবার মধ্য রাতে আরেক সাংগঠনিক নির্দেশনায় তিনি জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই মহাসচিবের পদ থেকে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে বাদ দেয়ার মধ্য দিয়ে এরশাদের জাপায় শুরু হয় অস্থিরতা। এই অস্থিরতার নতুন মাত্রা পায় শুক্রবার মধ্য রাতের একটি প্রেসরিলিজকে কেন্দ্র করে। ওই রাতে জাতীয় পার্টির বনানীর অফিস থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংগঠনিক নির্দেশ নামে যে প্রেসরিলিজ পাঠানো হয়, সেখানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্টির কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছেন বলে জানানো হয়। সাংগঠনিক নির্দেশে এরশাদের উদ্ধৃতি দিয়ে আরো জানানো হয়, ইতঃপূর্বে এরশাদ তার ছোট ভাই জি এম কাদেরকে পার্টির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছিলেন। এরশাদের অবর্তমানে পার্টির সব সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা প্রদান করেন জি এম কাদেরকে। কিন্তু জি এম কাদের তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ তার নির্দেশনায় জানান। আর সেই কারণে দলের কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে জি এম কাদেরকে তিনি অব্যাহতি দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন।
হঠাৎ করে এরশাদের এই নির্দেশনা সংবলিত প্রেসরিলিজ বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানল ও অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই জাতীয় পার্টির তৃণমূলপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে শুক্রবার মধ্য রাত থেকে দেশে বিদেশে অবস্থানরত জাতীয় পার্টির ঘনিষ্ঠ অনেকেই প্রথমে এই প্রেসরিলিজকে ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিতে শুরু করেন। অনেকেই আবার এই প্রেসরিলিজকে সঠিক উল্লেখ করে এর জন্য দলের অনেক নেতাকে দায়ীও করেন।
শনিবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ স্বাক্ষরিত ওই সাংগঠনিক নির্দেশে সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার পদ থেকে জি এম কাদেরকে অপসারণ করে বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা এবং পার্লামেন্টারি পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে আমি প্রধান বিরোধী দলের উপনেতার পদ থেকে গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জিএম কাদের) অপসারণ করছি। এখন প্রধান বিরোধী দলের উপনেতার পদে বেগম রওশন এরশাদকে মনোনীত করা হলো। পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা মোতাবেক এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংসদের স্পিকারের সমীপে প্রস্তাব পেশ করা হলো।
এর আগে শুক্রবার রাতে এক সাংগঠনিক নির্দেশে তাকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দেন জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ। ওই নির্দেশে তাকে দলের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়। ওই সাংগঠনিক নির্দেশে বলা হয়, জাপা চেয়ারম্যান হিসেবে আমি এই মর্মে আমার পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী এবং সংশ্লিষ্ট সব মহলের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই, আমি ইতঃপূর্বে ঘোষণা দিয়েছিলাম যে, আমার অবর্তমানে পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের পার্টি পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করবেন এবং আমি এটাও আশা প্রকাশ করেছিলাম যে, পার্টির পরবর্তী জাতীয় কাউন্সিল তাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবে। কিন্তু পার্টির বর্তমান সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আমার ইতোপূর্বেকার সেই ঘোষণা প্রত্যাহার করে নিলাম। নির্দেশে আরো বলা হয়, যেহেতু কাদের পার্টি পরিচালনা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন, পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে এবং তিনি পার্টির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। পার্টির সিনিয়র নেতারাও তার নেতৃত্বে সংগঠন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এমতাবস্থায় সংগঠনের স্বার্থে পার্টির সাংগঠনিক দায়িত্ব এবং কো-চেয়াম্যানের পদ থেকে গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হলো। তবে তিনি পার্টির প্রেসিডিয়াম পদে বহাল থাকবেন।
যদিও শুক্রবার রাতে ভাই জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর তিনি সংসদে দলের উপনেতার পদে থাকবেন কি না, সে বিষয়ে পার্টির সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন এরশাদ। তবে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে নয়, জি এম কাদেরকে দল থেকে হটিয়ে দিতে এরশাদ ‘একাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন’ বলে জানিয়েছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও এরশাদের একান্ত সহকারী খালেদ আখতার।
এর আগে গত ১ জানুয়ারি এরশাদ এক বিবৃতিতে দলে তার উত্তরসূরি হিসেবে জি এম কাদেরকে মনোনীত করার কথা জানিয়েছিলেন। এরপর এরশাদের অনুপস্থিতিতে কাদেরের দায়িত্ব গ্রহণের পর ‘রওশনপন্থী’ হিসেবে পরিচিত নেতারা নাখোশ মনোভাবও দেখিয়েছেন বিভিন্ন সভায়। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জি এম কাদেরও সেই শীতল সম্পর্কেরই আভাস দিয়েছিলেন। তার আগে ২০১৬ সালেও ছোটভাই কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করলে দলের একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরে দলে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যানে পদ সৃষ্টি করে তাতে স্ত্রী রওশনকে বসান এরশাদ। তারও আগে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে মহাসচিব করেছিলেন এরশাদ। রওশন সমর্থক হিসেবে পরিচিত বাবলুকে কটাক্ষ করে এক মন্তব্যের জন্য তখন একবার ভাই কাদেরকে সতর্ক করে নোটিশ পাঠিয়েছিলেন এরশাদ।
দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের সাথেও জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নানা বৈঠকে দু’জন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে জানতে চাইলে খালেদ আখতার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, রওশন ম্যাডাম এখন দলে অ্যাকটিভ আছেন। তিনি বলেন, স্যারকে ফ্রিলি রাজনীতি করতে দেয়া হচ্ছে না। চাপের মুখে পড়েও তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন। জি এম কাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, যে ভাইয়ের পরিচয়ে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, সেই ভাইকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ জি এম কাদেরের নেই। স্যার সম্পর্কে নানা সময়ে উল্টাপাল্টা কথাও তিনি বলেছেন।
জাতীয় পার্টিতে সদস্য হয়ে হুট করে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা বনে যাওয়া, দলের পুরনো নেতাদের টপকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এখতিয়ার পেয়ে যাওয়া নিয়ে দলে দেখা দিয়েছে কোন্দল। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভায় মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার উপস্থিতিতে এ নিয়ে বাহাসে জড়িয়ে পড়েছিলেন নেতারা।
এ ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ওয়ান-ইলেভেনের আলোচিত সেনাকর্মকর্তা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়েও নাটক কম হয়নি। প্রথমে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে তিনি ভেড়েন জাতীয় পার্টিতে। পরে তিনি চেয়ারম্যানের উপদেষ্টাও বনে যান, এমনকি শেষ পর্যন্ত তিনি পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যও হয়েছেন। তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে পারেন এমন গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে খালেদ আখতার বলেন, তেমন সম্ভাবনা নেই। তবে কে কখন আসল, কে কার লোক, ভেতরে ভেতরে কি প্ল্যান আছে, কে জানে? স্যার (এরশাদ) তো আমাদের কারও কথা শোনেন না।
এ দিকে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া প্রসঙ্গে গোলাম মোহাম্মদ কাদের শুক্রবার রাতে বলেন, আমার কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কারণ বৃহস্পতিবার রাতে আমাকে এরশাদ সাহেব বলেছিলন, তুমি (জি এম কাদের ) খুব ভালো করছো। আমি (এরশাদ ) তো আর বেশি দিন বাঁচব না, তুমি দলটাকে বাঁচিয়ে রেখো। আমি জানি তা তুমি পারবে। তবে শনিবার বিকেলে উপনেতার পদ থেকে অব্যাহতির বিষয়ে জানানোর জন্য জি এম কাদেরকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, শনিবার সকালে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান করেও ভাই এরশাদের সাক্ষাৎ পাননি জি এম কাদের। এ সময় জি এম কাদেরের সাথে মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে এরশাদের সাক্ষাৎ না পেয়ে অনেকটা নিরাশ হয়ে ফিরে যান।
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ থেকেই জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা এক প্রকার লেজে-গোবরে অবস্থায় ছিল। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দলের কয়েকজন শীর্ষনেতার বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠাকে কেন্দ্র করে জাপায় ছিল অস্থিরতা। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দলের দীর্ঘদিনের কাণ্ডারি হিসেবে পরিচিত মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে বাদ দিয়ে অনেকটা তাড়াহুড়া করে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে মহাসচিব মনোনীত করা, জোটগতভাবে নির্বাচন করেও আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আশানুরূপ আসন না পাওয়া, দলের ৪৬ থেকে ২৪টি আসনে নেমে আসা, দলের মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ দশম জাতীয় সংসদে এমপি হওয়া অনেকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের মনোনয়ন না পাওয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের খোঁজখবর না নেয়াসহ নানা কারণে নির্বাচনের পর থেকে দলের সাংগঠনিক অবস্থা একেবারে নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এর মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি দলের কো-চেয়ারম্যান নিজের ছোট ভাই জি এম কাদেরকে দলের ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করে সাংগঠনিক নির্দেশ প্রদান করেন জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদের এই সিদ্ধান্তকে দলের তৃণমূলপর্যায়ের অধিকাংশ নেতাকর্মীর সমর্থন থাকলেও বেঁকে বসেন দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা। তারা এরশাদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মশিউর রহমান রাঙ্গার পাশাপাশি প্রকাশ্যে জি এম কাদেরের বিরোধিতা শুরু করেন। পার্টিতে জি এম কাদের সমর্থকদের অভিযোগ, ওই সিনিয়র নেতারা এরশাদকে ভুল বুঝিয়ে জি এম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও সংসদের উপনেতার পদ থেকে অব্যাহতি দিতে এরশাদকে বাধ্য করেছেন।
এ বিষয়ে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি বলেন, কে কোন পদে থাকবেন সেটা এরশাদ সাহেব ভালো বলতে পারবেন। কেন তাকে সরিয়ে দেয়া হলো সেটা এরশাদ সাহেবই ভালো জানেন। তবে তিনি জি এম কাদেরের সমালোচনা করে বলেন, তিনি (কাদের) কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নয়। পার্টির কোনো নেতার সাথে দেখা করবে না কথা বলবে না তাহলে রাজনীতি কিভাবে হয়। নির্বাচনের আগে বা পরে একবারও নেতাকর্মীদের সাথে বসেননি তিনি।