মহাজোটে আসন বণ্টন নিয়ে অসন্তোষ
আওয়ামী লীগসহ সরকারের অংশীদার ৭ দল; শরিকদের মধ্যে বঞ্চিত ৬ দল; বর্তমান সরকারে বাদ পড়েছে ২ দল- মনিরুল ইসলাম রোহান
- ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:০৬, আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৬:৪৬
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ডিসেম্বরের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়লেও এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট-মহাজোটের আসন বণ্টন হয়নি। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে শরিকদের মধ্যে ৭০টি আসন বণ্টনের যে আভাস দেয়া হয়েছে তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। এ নিয়ে জোটের শরিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
গত শনিবার আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সম্পাদকমণ্ডলীর জরুরি বৈঠক শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জোট গঠন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে, যা এ মাসের শেষ দিকে বা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দৃশ্যমান হবে। তিনি বলেন, আমাদের জোটের অংশীদলগুলোর জন্য ৬৫ থেকে ৭০ সিট ছেড়ে দেয়ার চিন্তা ভাবনা আছে।
তার ওই বক্তব্যের পরই নড়েচড়ে উঠেছে মহাজোটের অংশী দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়। তাদের ভেতরে ভেতরে একটি চাপা উত্তেজনাও কাজ করছে। জোটের শরিক দলের একাধিক নেতার মতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল দলগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোট গঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে শরিকদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার কারণে বিএনপি নেতৃত্বাধীন একটি বড় জোট নির্বাচনে অংশ না নিলেও সরকার গঠন করতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। নানা বিতর্কের মধ্যে পাঁচটি বছর কেটে যাচ্ছে। সরকারের কঠিন দুঃসময়ে ক্ষমতার অংশীদার না হয়েও একনিষ্ঠভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে শরিক দলগুলো। এক টাকার মধ্যে আওয়ামী লীগ যদি ৫০ পয়সা হয় তাহলে অন্য সব দল ৫০ পয়সা। আর আওয়ামী লীগ যদি ৬০ পয়সা হয় তাহলে অন্যান্য দল ৪০ পয়সা। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে তাই অনেক হিসেবে নিকেশ করে কাজ করতে হবে। জোটের শরিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করেই আগামী নির্বাচনের সমীকরণ মেলানো উচিত হবে।
তারা মনে করেন, আগামী নির্বাচনে ৭০টি আসন যদি জোটের অন্যদের জন্য রেখে দেয়া হয় তাহলে আগের মতো পাওয়া না পাওয়ার একটা হিসেব চলে আসবে। শরিকদের মধ্যে অনেক দলে না পাওয়ার ক্ষোভ রয়েছে। কিছু দল আছে যারা সরকারে স্থানও পায়নি এবং গত প্রায় ১০ বছরে দলীয়ভাবে সরকারের তরফ থেকে তেমন সুযোগ সুবিধা মেলেনি। এখন এই সীমিত আসনের মধ্যে যদি মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টিকে ৪০টি আসন এবং অন্য শরিকদলকে ৩০টি আসন ভাগ করে দেয়া হয় তাহলে কেউই তা মেনে নেবে না।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ১৪টি দল নিয়ে গঠিত হলেও এতে মূলত দল রয়েছে ১৩টি। জোট প্রধান আওয়ামী লীগ এবং জাসদ (ইনু), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপি (মঞ্জু), তরিকত ফেডারেশন, জাসদ (আম্বিয়া) ও ন্যাপ (মোজাফফর) এই ৭টি দল সরকারের অংশীদার। এরমধ্যে জোটের অন্যতম শরিক জাসদের দুই অংশে সংরক্ষিত আসনসহ ছয়জন এমপি রয়েছে। জাসদ একাংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনু সরকারের প্রভাবশালী তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। বিভক্ত হওয়ার আগে গত নির্বাচনে জাসদ ১৫টির মতো আসন দাবি করেছিল।
এবার জাসদ (ইনু) ৩০টির মতো আসন দাবি করার চিন্তা করছে। এ প্রসঙ্গে জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আকতার নয়া দিগন্তকে বলেন, এখনো ওইভাবে আলোচনা করছি না। আগে নির্বাচনটা কিভাবে হবে, কারা অংশ নেবে এ বিষয়টা পরিষ্কার হওয়ার পরই আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে একটা সমাধানে আসা যাবে।
জাসদের অন্য অংশের প্রার্থীরা ৩০টির মতো আসনে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। জোটের আরেক অংশীদার ওয়ার্কার্স পার্টি সংরক্ষিত আসনসহ ছয়টি এমপির পদ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয় দলটি। পাশাপাশি মন্ত্রিসভায়ও ঠাঁই পেয়েছেন দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এবার ৩৫ থেকে ৪০টি আসনে তাদের প্রার্থীরা কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
জোটের আরেক শরিক তরিকত ফেডারেশন গত নির্বাচনে ১২টি আসন দাবি করে দুইটি পেয়েছিল। বর্তমান সরকারে তাদের দুইজন এমপি প্রতিনিধিত্ব করছে। এবার ৩০টির মতো আসনে শক্তিশালী প্রার্থী কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি। তিনি বলেন, যে আসনগুলোতে প্রার্থী মনোনয়ন দিলে জিতে আসবে সেই আসনগুলোতে ছাড় দেয়া উচিত। এভাবেই প্রধানমন্ত্রী মূল্যায়ন করবেন বলে আশা করি।
আরেক শরিক জাতীয় পার্টি-জেপির (মঞ্জু) দুইজন এমপি সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন। জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। জোটের অন্যতম শরিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে (মোজাফফর) একটি সংরক্ষিত আসনের এমপি পদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। তারা আগামী নির্বাচনে ৩০টি আসনে প্রার্থী দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন ন্যাপের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো: ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, এখনো চূড়ান্ত বিচারের সময় আসেনি। যতক্ষণ না চূড়ান্ত আলাপ-আলোচনা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না কে কত আসন পাচ্ছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সরকারের অংশীদার থেকে ছিঁটকে পড়েন। তবে আগামী নির্বাচনের জন্য কমপক্ষে ১০টি আসনে তাদের প্রার্থী কাজ করছেন বলে জানা গেছে। গণতন্ত্রী পার্টিরও একই অবস্থা। নবম সংসদে একটিমাত্র সংরক্ষিত আসনের এমপি পদ নিয়ে খুশি থাকতে হয়েছিল তাদের। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা ও হারিয়েছে। এবার ১৫ থেকে ২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার লক্ষ্যে দলটি কাজ করছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া শরিকদের অন্যতম গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাসদ ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র জোট গঠনের পর কখনোই সরকারের অংশীদার হতে পারেনি। এদের মধ্যে গণ আজাদী লীগ ৩০টি, গণতান্ত্রিক মজদুর পাটি ১০টি, বাসদ ২০টি এবং কমিউনিস্ট কেন্দ্র ১০টি আসনে তাদের প্রার্থী কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে গণ আজাদী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এস কে সিকদার নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তিনি জোটের অন্য শরিকদের সাথে নিয়ে কাজ করতে চান। প্রধানমন্ত্রীর এ কথায় আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।
মহাজোটের অংশীদার হিসেবে আছে জাতীয় পার্টি (এরশাদ)। বর্তমান সরকারে জাতীয় পার্টির ৪০ জন এমপি রয়েছে। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছেন। এ ছাড়াও বর্তমান সরকারে জাতীয় পার্টির দুইজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুস সবুর আসুদ নয়া দিগন্তকে বলেন, গত নির্বাচনে ৬০টি আসন দাবি করেছিলাম। আগামী নির্বাচনে আমাদের ১০০ আসনের দাবি রয়েছে। আলাপ আলোচনা চলছে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
২০০৪ সালে ২৩ দফা দাবিতে ১১ দলীয় জোটের সাথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-মশাল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-কুড়েঘর) এই তিনটি দল মিলে গঠিত হয় ১৪ দলীয় জোট। পরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মাহবুব) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এই চারটি দল ১৪ দলীয় জোট থেকে বের হয়ে যায়। তবে, বাসদের একাংশ ১৪ দলীয় জোটে থেকে যায়। ফলে জোটে দলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১টি। কিছু দিন পর গণফোরাম জোট ত্যাগ করলে দলের সংখ্যা হয় ১০টি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে জাতীয় পার্টি (জেপি) ও তরিকত ফেডারেশন ক্ষমতাসীন জোটে অন্তর্ভুক্ত হলে দলের সংখ্যা হয় ১২টি। সম্প্রতি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (মশাল) দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে দুই অংশই জোটের সাথে যুক্ত থাকায় জোটে বর্তমানে ১৩টি দল রয়েছে।