প্রকৃতির প্রতিদান
- জয়নুল আবেদীন
- ০৪ জানুয়ারি ২০২০, ১৯:৪৯
নিজের কল্যাণ ও অন্যের কল্যাণ। প্রশ্ন করতে পারেন, অন্যের কল্যাণ কামনা করে আমার লাভ কী? লাভ আছে, বিশ্বখ্যাত এমআইটির নিউরোসায়েন্টিস্ট প্রফেসর ফ্রান্সিস স্মিথের ভাষায়, ‘মানুষ যদি আবিষ্কার করতে পারে কেন সে অনন্য, তাহলে হয়তো সে নিজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে না; বরং এখনকার চেয়ে নিজকে বেশি শ্রদ্ধা করবে।’ পৃথিবীকে স্বর্গের অংশ হিসেবে, অনিষ্ট করার পরিবর্তে অন্যের কল্যাণ চাইতে শুরু করবে। কারণ, অন্যের কল্যাণ চাইলে আপনার কল্যাণ হবে, অন্যের অকল্যাণ চাইলে আপনার নিজেরই অকল্যাণ হবে। এটাই হচ্ছে Law of natural gift বা ‘প্রকৃতির প্রতিদান’।
প্রতিটি কাজেই রয়েছে ‘প্রকৃতির প্রতিদান’। ভালো করলে ভালো পাবেন, মন্দ করলে মন্দ পাবেন। খুন করবেন তো নিজে খুন হবেন, গুম করলে গুম হবেন। আপনি বলবেন, সাক্ষী রাখব না। সাক্ষী ছাড়া বিচার করবে কে?’ এক সময়ের দায়রা জজ নরেন্দ্র কুমার দাস কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘প্রকৃতি নির্জীব, চলৎশক্তিহীন ও সর্বংসহা মনে হলেও আসলে তা নয়; বরং প্রকৃতি নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণকারী। প্রকৃতি কারো অণু পরিমাণ অপরাধও সহ্য করে না, বরং সময়ের প্রয়োজনে ঠিকই বিক্ষুব্ধ ও সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অপরাধ ও অপরাধীর প্রতিবিধান হয় প্রকৃতির আদালতে। তবে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্নরাই শুধু তা উপলব্ধি করতে পারেন। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষীর অভাবে আদালতও অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারে না অনেক সময়। কিন্তু ওরা কখনো প্রকৃতির রূঢ়তা ও নির্মম প্রতিশোধ থেকে বাঁচতে পারে না। কোনো-না-কোনোভাবে প্রকৃতিগতভাবেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়ে যায়। অপঘাত, অপমৃত্যু, দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক ও দুরারোগ্য রোগভোগ, দুর্ঘটনা, পারিবারিক ও সামাজিক কলহ-বিবাদ, গণমানুষের রুদ্ররোষ, রাষ্ট্রাচারের বিচ্যুতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারীসহ নানাবিধ প্রতিকূলতার মাধ্যমে শাস্তি পায়। আর এই প্রাপ্য শাস্তি হয়ে থাকে মানুষের কল্পনারও অতীত।
রয়েছে স্মরণীয় ঘটনা। ৮০ বছর আগের কথা। তখন নোয়াখালী, ঢাকা, কুমিল্লা প্রভৃতি এলাকার লোক রেঙ্গুন বা বর্তমান মিয়ানমারে কাজ করতে যেতেন। বিক্রমপুর এলাকার দুই বাল্যবন্ধু ব্যবসা করতে গেলেন মিয়ানমার অর্থাৎ বার্মায়। ব্যবসা করতে করতে অনেক টাকা-পয়সা হাতে আসে। ভাবলেন, যে টাকা-পয়সা হয়েছে তাতেই চলে যাবে বাকি জীবন। দেশে আসতে মনস্থির করেন। এর মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপান রেঙ্গুন আক্রমণ করলে বহু মানুষ হতাহত হয়। তখন দুই বন্ধু বাড়ির পথে। হঠাৎ বৃষ্টি। এ কারণে দুই বন্ধু এক গাছতলায় আশ্রয় নিলেন। বৃষ্টি কমছে না, ক্রমেই বাড়ছে। সামনে পানি জমে গেছে। দুই বন্ধুর মধ্যে একজন হৃষ্টপুষ্ট, অপরজন শুকনা। কথায় বলে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।’ বৃষ্টির কারণে অপেক্ষা করতে করতে হৃষ্টপুষ্ট বন্ধুর মাথায়ও শয়তান ঢুকে গেল। শয়তান পরামর্শ দিলো, বন্ধুকে মেরে তার টাকা-পয়সা তুই নিয়ে নে। দ্বিগুণ ধনসম্পদের মালিক হয়ে যাবি। তখন কেবল সুখ আর সুখ। এখানে মারলে কোনো প্রমাণ থাকবে না। শয়তানের প্ররোচনায় হৃষ্টপুষ্ট বন্ধু শুকনো বন্ধুর গলা চেপে ধরে। শুকনো বন্ধু ভাবল, হৃষ্টপুষ্ট বন্ধু মজা করছে। তাই গলায় চেপে ধরা হাত আলগা করার চেষ্টা করতে করতে বলেন, ‘ছাড়, ছাড়, দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
-‘দম বন্ধ হওয়ার জন্যই ধরেছি। তোকে মেরে তোর সব টাকাকড়ি আমি নিয়ে যাবো।’
-‘আমায় জানে মেরো না, আমার সব টাকা তোমাকে দিয়ে দিই।’
- ‘তা হয় না। বাড়িতে গিয়েই সালিস ডেকে আমাকে অপমান করাসহ তোমার টাকা আদায় করে নেবে। এখানে মেরে গেলে কোনো প্রমাণ থাকবে না। জাপানি সৈনিকের গোলাগুলিতে কত লোক মারা গেছে। বলব, তুইও মারা গেছিস জাপানি সৈনিকের গুলিতে। তোকে মেরে তোর টাকা-পয়সা সব কিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এ খুনের কোনো সাক্ষীই থাকবে না।’
বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে সামনের গর্তে পানি জমে গেছে। জমা পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে বুদবুদ উঠছিল। সেদিকে তাকিয়ে শুকনো বন্ধু- ‘খুনের সাক্ষী বুদবুদ।’ কিন্তু মোটা বন্ধু বলেন, ‘(হাসতে হাসতে) এর কি মুখ আছে? এটা কি কথা বলতে পারে? এটা কী করে সাক্ষী দেবে?’
বন্ধুকে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে সব টাকাকড়ি নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। বানানো গল্প বললেন, জাপানিরা রেঙ্গুন দখল করে হাজার হাজার লোক মেরে ফেলেছে। মেরে ফেলেছে বন্ধুকেও, নিজে কোনো রকমে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছি। শুকনো বন্ধুর বাবা-মা ক’দিন কান্নাকাটি করলেন। তারপর সব শেষ। হৃষ্টপুষ্ট বন্ধু পাশের গাঁয়ে বিয়ে করলেন। বাড়িঘরের কাজ ধরেন। নতুন ঘরের দরজায় বসা অবস্থায় এমনই বর্ষার দিন ছিল। সেদিনের মতোই মুষলধারে বৃষ্টি। এর পানি ঘরের চাল বেয়ে গড়িয়ে ফোঁটা ফোঁটা নিচে পড়ছে। নিচে জমে থাকা পানির ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে সেদিনের মতো বুদবুদ বা ফোটকার জন্ম হচ্ছিল। তা দেখে হৃষ্টপুষ্ট বন্ধু হাসতে হাসতে বললেন, ‘হায় বোকা বন্ধু, ফোটকা আবার সাক্ষ্য দেয় কী করে।’
কাছেই ছিল নতুন বউ। স্বামী যখন ফোটকার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তখন স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন স্ত্রী। এই মুষলধারার বৃষ্টির মাঝে স্বামীর হাসার কারণ কী? কামরূপকামাক্ষ্যার দেশ মিয়ানমার। বহু দিন ছিলেন মিয়ানমারে। নিশ্চয়ই কোনো বান্ধবী রেখে এসেছেন। তা গোপন করে আবার বিয়ে করেছেন। বান্ধবীর কথা মনে পড়াতেই এই হাসি। রহস্য জানতেই হবে। বউ স্বামীর কাছে হাসির রহস্য জানতে চান। স্বামী বুঝতে পারেন, হাসির কারণ হিসেবে একটা কিছু বলতেই হবে। কী বলবেন! বানানো কথা বিশ্বাস করাতে না পারলে সমস্যা বাড়বে। এদিক-ওদিক বলতে গেলে জটিলতা বাড়বে। স্ত্রী তো নিজের মানুষই। স্বামীর ক্ষতি হলে তারও ক্ষতি। এক সময় সব ঘটনা বলে ফেলেন স্ত্রীর কাছে। আর যাবেন কোথায়, স্বামী একজন খুনি, স্বার্থের জন্য যে নিজের বাল্যবন্ধুকে খুন করতে পারে সে নিজের স্ত্রীকেও খুন করতে পারবে। ভাবতে গিয়েই বউ ভয়ে শিউরে ওঠেন। ক’দিন পরই চলে যান বাপের বাড়ি। বাপের পা জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, ‘বাবা, তুমি আমাকে মেরে কেটে টুকরো টুকরো করে পদ্মার পানিতে ভাসিয়ে দাও। কিন্তু ওই খুনির কাছে আর দিও না। তোমাদের জামাই একজন খুনি। যে মানুষ খুন করতে পারে, সে আমাকেও খুন করতে পারবে।’
এক কান, দুই কান- শুরু হয় কানাকানি! জানতে পারে শুকনো বন্ধুর বাবা-মাসহ আত্মীয়স্বজনও। শুরু হয় থানা-পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেফতার, রিমান্ড, স্বীকারোক্তি, সাক্ষী, জেরা ইত্যাদি। শেষ পরিণাম ফাঁসির দণ্ডাদেশ।
অর্থাৎ, পাপের ভরা পূর্ণ হলেই শুরু হয় প্রকৃতির নির্মম প্রতিদান। কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন। লাশের পেট ফেড়ে ইট বেঁধে তিন নদীর মোহনায় লাশ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। পেটফাড়া ইটবাঁধা লাশ ভেসে ওঠার কথা বিজ্ঞানও স্বীকার করে না। লাশ তিন নদীর মোহনা থেকে, বেঁধে রাখা ভারী ইটসহ একে একে ভেসে উঠতে শুরু করে। যে লাশ ভাটির টানে দক্ষিণে ভেসে যাওয়ার কথা, সে লাশ উজান ঠেলে চলে আসে উত্তরে- সর্বোপরি, যে এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়েছিল ঠিক সে এলাকায়।
এ মামলার অন্যতম আসামি সাবেক র্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদ। তার সাথে ঘটনাক্রমে একই হাজতে ছিলেন রাজনীতিক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। একজন খুনের দায়ে, আরেকজন রাজনৈতিক কারণে। নামাজ আদায় করতেন একই মসজিদে। নিয়মিত নামাজ আদায় করেন দু’জনই। একদিন কথা প্রসঙ্গে তারেক সাঈদ বলেছেন, ‘এখন নিয়মিত নামাজ আদায় করি, আল্লাহ আছেন, সর্বান্তকরণে বিশ্বাসও করি। পেট কেটে ইট বেঁধে লাশ ডুবালে ভেসে ওঠার কোনো নজির নেই। সাতটি লাশ যখন একে একে ভেসে উঠতে শুরু করে তখনই টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে স্বীকার করেছি, একজন নিশ্চয়ই আছেন। পাপের ভরা পূর্ণ হলেই তার বিচার শুরু হয়। (তারেক সাঈদ সম্পর্কিত বক্তব্যটি ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জেল থেকে বের হওয়ার পর প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন)
পাপের ভরা যখন পূর্ণ হয় তখনই শুরু হয়ে যায় প্রকৃতির নির্মম প্রতিদান। ধর্ম এবং ইতিহাসের দিকে তাকান। ফেরাউন, নমরুদ থেকে শুরু করে হিটলার পর্যন্ত কেউ রেহাই পায়নি- হয় দুরারোগ্য রোগ যন্ত্রণায়, নয় আত্মহত্যায় কোনো-না-কোনোভাবে প্রকৃতির নির্মমতার শিকার হয়েছে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তানের জন্ম হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আসেন। কার্জন হলের এক সভায় ঘোষণা দিলেন, ‘উর্দু, অনলি উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ একটা জাতির মায়ের ভাষাকে যিনি পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন, তার কবরে বাংলায় লেখা রয়েছে, ‘কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখ। ’
পাকিস্তানে এখন যে শিশুরা জন্মাচ্ছে তারা বাংলা ভাষা জানে না। পাকিস্তানের কোথাও বাংলা ভাষা নেই- জিন্নাহর কবর ছাড়া। পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা সেখানে গিয়ে এই লেখা দেখে বিস্মিত হয়। তখন ভাবতে শুরু করে যে, আরবি নয়, উর্দু নয়, ফার্সি নয়, পাঞ্জাবি নয়, পশতুও নয়- এটা কোন ভাষা? খোঁজ নিতে গিয়েই জানতে পারবে- ‘এটা বাংলা ভাষা। বাঙালির মাতৃভাষা।’ রহস্য সন্ধান করতেই বেরিয়ে পড়ে- ‘জিন্নাহ যে বাংলা ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন, সে ভাষাই এখন মিস্টার জিন্নাহর শেষ শয্যাজুড়ে বসে রয়েছে।’
কথায় বলে, পরের জন্য খাদ করলে সে খাদে নিজেই পড়তে হয়। এ কথার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো, অন্যকে খাদে ফেলার জন্য খোদাইকৃত খাদ লতাপাতা-ডালপালা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। যে খাদ বানাল তার মস্তিষ্কেই খাদে ফেলার পরিকল্পনা সর্বক্ষণ কাজ করছে। তার মস্তিষ্ক সর্বদা খাদের দিকেই নিয়ে যাবে তাকে। একটু অসতর্ক হলেই যার খাদে সেই পড়ে। মন মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করতে পারে কি না, এ সম্পর্কে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নিউরোসায়েন্টিস্ট স্যার জন একলস বলেন, ‘আমরা যখন চিন্তা করি, তখন প্রতিটি চিন্তার সাথে সাথে ব্রেন নিউরনে অবস্থিত কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণু স্থান পরিবর্তন করে। কার্বন হাইড্রোজেন ইত্যাদির পরমাণু হচ্ছে বস্তু আর চিন্তা হচ্ছে বস্তুর অস্তিত্ববিবর্জিত।’
অন্যের মঙ্গল কামনা করলে নিজের মঙ্গল হবে, অন্যের অমঙ্গল কামনা করলে নিজের অমঙ্গল হবে। যার মঙ্গল কামনা করবেন, তার কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চাইবেন না। প্রতিদানের বিনিময়ে উপকার করাকে ‘ইনভেস্টমেন্ট’ করা হয়েছে বলা হয়। প্রতিদানের প্রত্যাশায় ইনভেস্টমেন্ট নয়, দান চাই নিঃস্বার্থভাবে। কেউ আপনার নিন্দা করলে খুশি হবেন। বেশি নিন্দা করলে এটা ভেবে বেশি খুশি হবেন যে, আপনি কোনো-না-কোনোভাবে তার উপকার করেছিলেন।
সমাজ সংস্কারক, অসাম্প্রদায়িক, বিধবার বিয়ের প্রবর্তনসহ পরোপকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন থেকে নেয়া ঘটনা। একবার তিনি বৈঠকখানায় বসে বই পড়ছেন। এমন সময় এক লোক এসে বিদ্যাসাগরকে বললেন, অমুক ব্রাহ্মণ আপনার খুব নিন্দে করেছে। তিনি শুনে বললেন, আমি বিশ্বাস করি না, কারণ তার কোনো উপকার করিনি। তখন লোকটি বলে, প্রতিজ্ঞাপূর্বক বলছি স্যার, নিন্দা করার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম, নিজ কানে শুনেছি।
লোকটি দৃঢ়ভাবে বলার পর, বিদ্যাসাগর ঘরে গিয়ে একটা পুরনো ডায়েরি খুঁজে আনলেন। ‘দানবীর’ হিসেবে বিখ্যাত বিদ্যাসাগর যখন যাকে যা দিতেন, তা ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। পুরনো ডায়েরির পাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে ১৫ বছর আগের ডায়েরিতে নাম পেলেন ‘অমুক’ ব্রাহ্মণের। কন্যাদায়গ্রস্ত ‘ব্রাহ্মণ’ টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিলেন না। ৫ টাকা দান নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। তখনকার দিনের পাঁচ টাকা এখন অনেক টাকার সমান। প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়া অন্যের মঙ্গল করলে দেখবেন, প্রকৃতির প্রতিদান হিসেবে এমন একজনের সাহায্য লাভ করবেন, যা আপনি কল্পনাও করতে পারেননি।
যে অন্যের ক্ষতি করে সে কখনো ভালো থাকে না, থাকতে পারে না। ক্ষতির পরিমাণ যত বড় প্রকৃতির প্রতিদানের পরিমাণও তত ভয়াবহ। রবার্ট ক্লাইভ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কয়েকজন সৈন্য নিয়ে একটি বিশাল এবং সমৃদ্ধ দেশ তলিয়ে দিয়েছিলেন ২০০ বছরের জন্য। শৈশব থেকেই ছিলেন কুটিল চরিত্রের। এ কারণে শিক্ষাজীবনে কিছুই করতে পারেননি। সামান্য কেরানি হিসেবে চাকরিজীবন শুরু। ষড়যন্ত্রের অল্প দিনেই নায়কের বেশে ১৭৫৩ সালে দেশে ফেরেন। একবার চেয়েছিলেন, জননেতা হতে পারেননি। কুটিল চক্রান্তের দ্বারা বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটি জনপদ মুহূর্তের মধ্যে বিরানভূমিতে পরিণত করেছিলেন। একটি সমৃদ্ধ দেশের কোষাগার লুটপাট করে নিঃস্ব থেকে হয়েছেন বিশ্ব ধনী। তিনটি জাহাজ বোঝাই করে এ দেশের ধন, রত্ন, হীরা, জহরত, চুনি, পান্না নিয়ে যান। ক্লাইভ লন্ডনে গেলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে সম্পদ আত্মসাতের। জমিদারির পর জমিদারি ক্রয় করে ১৭৬৭ সালে ক্লাইভ হিসাব করে দেখেন তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য ৪০১১০২ পাউন্ড। সবই লুটের সম্পদ। সবই ছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের শোষণ, মিত্রদের সাথে প্রতারণা, মহল লুট, দেওয়ানির দায়িত্ব পালন, বাদশাহ শাহ আলম, নবাব মোহাম্মদ শাহ, নবাব সিরাজউদ্দৌলাদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থ। ক্লাইভের দেশপ্রেমের ভান দেখে পার্লামেন্টে ডক্টর স্যামুয়েল জনসন বলেছিলেন, ‘সব স্কাউন্ড্রেলেরই শেষ আশ্রয় হলো দেশপ্রেম।’
শুরু হয় ‘প্রকৃতির প্রতিদান’। ক্লাইভের ছিল মাথা পেটানোর রোগ। জুতা দিয়ে সারাক্ষণ মাথা না পেটালে অস্থির হয়ে পড়তেন। ষড়যন্ত্রকারী ও লুণ্ঠনকারী ছাড়াও ক্লাইভ ছিলেন লম্পটের চূড়ামণি। আক্রান্ত হন গুরুতর যৌনব্যাধিতে। এসবের নিবৃত্তি হিসেবে মহৌষধ ছিল আফিম। সেই আফিমই তাকে শেষবারের মতো ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর নিজের গলা নিজে কর্তনের মাধ্যমে চিরদিনের ঘুম পাড়িয়েছিল। পাপের ভরা পূর্ণ হলে প্রকৃতির হাত থেক কেউ রেহাই পায় না। কেউ না।
প্রকৃতির প্রতিদানসহ ব্রেনের শক্তি এবং ব্রেনের সাথে মনের সম্পর্ক সম্পর্কে মানুষ জানে না বলেই ভুল করে থাকে। পরের ক্ষতির চিন্তা করতে করতে নিজের ক্ষতি ডেকে আনা হয়। বৈজ্ঞানিকদের মতে, ‘এখনো ব্রেন সম্পর্কিত জ্ঞান এবং মানুষের মধ্যে ব্যবধান এক মহাসমুদ্রের। এই মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে ব্রেন সম্পর্কিত পূর্ণজ্ঞান লাভ করতে পারলেই মানুষ দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গকে ব্যবহার করতে পারবে; এখনকার অনেক সীমাবদ্ধতা ও অসুবিধাকে অতিক্রম করতে পারবে এবং নিজের জন্য সৃষ্টি করতে পারবে সাফল্য ও সম্ভাবনার নতুন মাত্রা।’ এমআইটি-এর নিউরোসায়েন্টিস্ট প্রফেসর ফ্রান্সিস স্মিথের ভাষায়- ‘মানুষ যদি আবিষ্কার করতে পারে কেন সে অনন্য, তাহলে হয়তো সে নিজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে না; বরং এখনকার চেয়ে নিজকে বেশি শ্রদ্ধা করবে।’
ধ্যান বা মেডিটেশনের আরেক পরিচয় ‘সায়েন্স অব লিভিং’। মানে, বেঁচে থাকার বিশেষ জ্ঞান। এই বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সুকুমার রায়ের ‘ষোলআনাই মিছে’ কবিতায় উল্লিখিত, কলকাতার বাবুর মতো। শখের বশে নৌকায় উঠে বাবু মশাই মাঝিকে জগতের তাবৎ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন। সূর্য কেন ওঠে, চাঁদ কেন বাড়ে-কমে? কিন্তু মূর্খ মাঝি কি আর এসব জ্ঞানগর্ভ কথার উত্তর দিতে পারেন? তখন বাবু মশাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভরে বৃদ্ধ মাঝিকে বলেন,
‘বলব কি আর বলব তোরে কি তা,
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।’
এমন সময় নদীতে ঝড় ওঠে। মাঝি বাবুকে জিজ্ঞেস করেন, সাঁতার জানো বাবু? বাবু, ‘নারে মাঝি না, সাঁতার তো জানি না।’ আর যায় কোথায়!
‘বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবনখানা ষোলআনাই মিছে!’
আপনি সব জানলেন, ডক্টর হলেন, এমবিএ করলেন, পিএইচডি করলেন। কিন্তু সায়েন্স অব লিভিং জানলেন না। নৌকা যদি ডুবে যায়, তখন কী অবস্থা হবে?
(কোয়ান্টাম মেথড কোর্স ৪৬৫-এ শহীদ আর বোখারী মহাজাতকের গত ১৫ ডিসেম্বর প্রদত্ত বক্তব্যের আলোকে)
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা