ইংরেজি না জানায় পিছিয়ে পড়ছি
- এ টি এম মাহমুদ
- ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৯:৪০
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর আজকের বৈশ্বিক সংস্কৃতির এই যুগে শিক্ষা মানে অবশ্যই ইংরেজিতে ভালো দখল। এটা সবারই জানা, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সবটাই ইংরেজির দখলে। তা ছাড়া আজকের আধুনিক শিক্ষিত তরুণদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা এবং প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। সেটার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে এর মধ্যে একটি বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বৈশ্বিক সংস্কৃতি। আজকের তরুণরা বিশ্বের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সীমারেখা মুছে ফেলে এক বৈশ্বিক সমাজের সদস্য হতে চায়। বিশেষ করে শিক্ষার বিষয়টিকে আর মোটেও শুধু পশ্চিমা বিশ্বে হাতের মুঠোবন্দী বলে মানতে চায় না। বিশ্বমানের শিক্ষার অধিকার আর সুযোগ কাজে লাগাতে চায় আজকের তারুণ্য।
তবে আমাদের দেশের তরুণদের জন্য ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথে আর্থিক বাধার চেয়ে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়ায় ইংরেজি শিক্ষার দুর্বলতা। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপের সুবিধা দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ওইসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার সুযোগ কাজে লাগানোর পথে আর্থিক দুর্বলতা কোনো বাধা হিসেবে থাকছে না। আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের ইংরেজি শিক্ষার দৈন্য।
শুধু বিদেশে উচ্চশিক্ষাই নয়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ভর্তি পরীক্ষার সময় ফুটে ওঠে ভর্তিচ্ছুদের ইংরেজি জ্ঞানের করুণ চিত্র।
উচ্চশিক্ষার বিষয়টি ছাড়াও দেশে এবং বিদেশের চাকরি বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রেও ইংরেজি শেখার দুর্বলতা একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, শুধু ইংরেজি শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণেই অন্য যোগ্যতা খুব ভালোভাবে থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে চাকরির ক্ষেত্রে ভারতীয়, পাকিস্তানি, শ্রীলঙ্কান বা নেপালিদের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। এই চিত্র শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, উন্নত অনেক দেশেই এ বিষয়টি দেখা যায়।
এ দেশের অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীও ইংরেজিতে দুর্বল থেকে যাচ্ছে শুধু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি শেখানোর ত্রুটির কারণে। আমাদের পাঠ্যবইয়ে প্রচুর ভুল এবং দুর্বল ইংরেজির সন্নিবেশ রয়েছে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা ভুল ইংরেজি শিখছে, যা জাতি হিসেবে আমাদের পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।
এ মুহূর্তে পাঠ্যপুস্তক থেকে দুর্বল এবং ভুল ইংরেজি দূর করার বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ যত্মশীল নন। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও এ ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা দেখা যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারে হাত দেয়া হয়েছে। এটি একটি শুভ লক্ষণ। তবে সমস্যা হলো আমাদের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ সেকেলে ইংরেজি শেখাতেই অভ্যস্ত। আবার শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে মূল বইয়ের চেয়ে গাইড বইয়ের ওপর বেশি ভরসা রাখে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ইংরেজির ভিত্তিগত (বেসিক) জ্ঞানের অভাব থেকেই যাচ্ছে।
স্কুল-কলেজে পাঠ্যের জন্য অনুমোদিত গ্রামার এবং ট্রান্সেলেশন বইগুলোর দিকে লক্ষ করলেই শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে দুর্বলতার একটি বড় কারণ দৃষ্টিগোচর হয়। ভুল ও অচল ইংরেজির অজস্র উদাহরণ দেখা যায় এসব গ্রামার বইয়ে।
উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায় : গ্রামার বইয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়, ‘আই ইট রাইস’ এবং ‘রাইস ইজ ইটেন বাই মি’। এগুলো আসলে অচল ইংরেজি। এভাবেই এ দেশের শিক্ষার্থীরা ভুল এবং দুর্বল ইংরেজি শিখছে।
কেউ যদি ইংল্যান্ড কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বলে ‘আই ইট রাইস’ তাহলে ওই দেশের মানুষ প্রথমে একটু বিস্মিত হবে। পরে তারা বিষয়টি কিছুটা বুঝতে পারলে এটা নিয়ে হাসবে, মজা করবে। কারণ আমরা বাংলায় যেমন বলি ‘আমি ভাত খাই’ এটা বাইরে অচল। কারণ আমরা শুধু ভাত খাই না। সঠিক ইংরেজি হবে, ‘আই হ্যাভ মাই মিল’।
একইভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়, ‘দি ক্লাস উইল বি স্টার্টেড অ্যাট ৯:০০ এ এম’। কিন্তু সঠিক ইংরেজি হবে, ‘দি ক্লাস উইল স্টার্ট অ্যাট ৯ ইন দ্য মর্নিং’। আমাদের পাঠ্যবইয়ে এরকম আরো অজস্র-সহস্র ভুল ইংরেজির উদাহরণ রয়েছে।
আমাদের দেশের ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা বহু যুগ ধরেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের কারিকুলাম অনুসরণ করে চলেছে। ওই শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষই ছিল কোনো রকমের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী তৈরি করা।
অথচ আজকের যুগে ইংরেজির অনেক আধুনিকায়ন ঘটেছে। এটা শুধু ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোতেই নয়, ইংরেজি শিক্ষার এই যুগোপযোগী ধারা অনুসরণ করে উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে চলেছে আমাদের প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালও।
আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা ইংরেজি শেখানোর ক্ষেত্রে সংজ্ঞা আর মুখস্থ কিছু বিষয়ই সাধারণত অনুশীলন করায়। যুগ যুগ ধরে এ পদ্ধতিই চলে আসছে।
অন্য দিকে, শিক্ষার্থীরা ইংরেজির ব্যবহারগত দিকটি ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর অনিবার্য ফল হিসেবে আমাদের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে দুর্বল থেকে যাচ্ছে। এমনকি এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারীরাও ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ মেধাবৃত্তি পেতে ব্যর্থ হচ্ছে শুধু এই একটি বিষয়ে দুর্বলতার জন্য। তারা অন্য বিষয়গুলোতে ভালো করলেও IELTS, SAT, GMAT, GREE, TOEFL, PTE-তে ভালো স্কোর করতে পারছে না। ইংরেজির বেসিক জ্ঞানের দুর্বলতাই এ অবস্থার জন্য দায়ী।
পরিণামে আমাদের দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্বমানের পণ্ডিত বা বিশেষজ্ঞ পেতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আমাদের দেশের প্রতিভাধর তরুণরাও জাতিকে সেই সেবাদানে সক্ষম হতে পারছে না, যে ধরনের সেবাদানের যোগ্যতা অর্জনের সাধ্য তাদের ছিল।
এ ক্ষেত্রে তরুণ শিক্ষার্থীদের হতাশাগ্রস্ত হলে চলবে না। সব বিষয়ে সাফল্যের পর শুধু ইংরেজির কারণে তাদের পিছিয়ে আসা ঠিক হবে না। তাদের উচিত, ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এ বিষয়ে কোর্স করা। এ দেশের কিছু বেসরকারি ভালো প্রতিষ্ঠান সুনাম এবং নির্ভরতার সাথে এই শিক্ষাসেবা দিয়ে আসছে। বিদেশে স্কলারশিপের জন্য ইংরেজির ওই বিষয়গুলোতে কাক্সিক্ষত স্কোর পেতে এসব প্রতিষ্ঠানে কোর্স করে কাক্সিক্ষত ফল পাচ্ছে শিক্ষার্র্থীরা।
তবে তথাকথিত গ্যারান্টি প্রদানকারী কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনো কিছু শেখানোর ব্যাপারে গ্যারান্টি দেয়া আসলে বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়।
ইংরেজি শেখার দৈন্য স্থায়ীভাবে দূর করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই।
সবার আগে কারিকুলাম এবং পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের লেখকদের লেখা গ্রামার এবং ইংরেজির অন্য মূল বই পাঠ্য করতে হবে। সব পর্যায়ের শিক্ষক-প্রশিক্ষকদের জন্য যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। রাষ্ট্রকে এ বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত।
নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে তাকে বিস্তারিত বলেছিলাম। আরো কয়েকজন মন্ত্রীর সাথে আলাপকালেও বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করেছি।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি আশা করা যায় না। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর বিষয়টিকে তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। রাজনৈতিক দলগুলোর অনুধাবন করা উচিত শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর মেরুদণ্ড যত শক্ত ও মজবুত হবে জাতি হিসেবে আমরা ততই দ্রুত উন্নত হতে পারব।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও এটিএম’স এডুকেশন
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা